স্টাফ রিপোর্টার: ঢাকায় ১০ ডিসেম্বর বিএনপির গণসমাবেশের স্থান নিয়ে পালটাপালটি অবস্থানে রাজনৈতিক অঙ্গনে উত্তাপ ছড়াচ্ছে। গতকাল মঙ্গলবার ২৬ শর্তে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অনুমতি দেয় ঢাকা মহানগর পুলিশ। কিন্তু নয়াপল্টনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনেই সমাবেশ করতে অনড় অবস্থানে বিএনপি। সমাবেশে কয়েক লাখ লোকসমাগম ঘটাতে মরিয়া দলটি। এজন্য প্রতিদিনই চলছে প্রস্তুতিসভা, মতবিনিময় ও ঘরোয়া বৈঠক। গঠন করা হয়েছে ব্যবস্থাপনা, অভ্যর্থনা, প্রচারসহ সাতটি উপকমিটি। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘আমরা নয়াপল্টনে সমাবেশ করব। এটা আমাদের দলীয় সিদ্ধান্ত। নয়াপল্টন ঘিরেই আমাদের সব প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে। তিনি বলেন, ‘আমরা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশের অনুমতি চাইনি। সেখানেই সরকার কেনো অনুমতি দিলো? তাদের উদ্দেশ্য কী?’ সোমবার রাতে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সভায়ও ঢাকার গণসমাবেশের ভেন্যু (স্থান) নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা হয়। সূত্র জানায়, ভেন্যু নিয়ে সভায় নেতাদের মধ্যে মতবিরোধ দেখা দেয়। অধিকাংশ নেতা নয়াপল্টনেই গণসমাবেশ করার পক্ষে মত দিলেও দুজন নেতা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের পক্ষে কথা বলেন। তবে পরে নয়াপল্টনে সমাবেশ করার আগের সিদ্ধান্তই সভায় বহাল থাকে। অধিকাংশ নেতা মত দেন, বিএনপি নয়াপল্টনের একটি ভেন্যুই চেয়েছে, এটি দলের সিদ্ধান্ত। এ সিদ্ধান্ত থেকে সরে এলে নেতাকর্মীদের মনোবল ভেঙে যাবে। তাছাড়া সরকার কোনো অজানা ‘ভয়’ বা ‘আতঙ্ক’ থেকে বিএনপিকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ঢুকিয়ে সমাবেশ করাতে চাইছে। এর পেছনে একটা রাজনৈতিক দুরভিসন্ধিও রয়েছে। বিএনপিকে দেওয়ালবেষ্টিত সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আবদ্ধ রেখে নিজেদের নিরাপদ রাখা, একই সঙ্গে নয়াপল্টন এলাকায় বড় গণজমায়েতের যে রাজনৈতিক প্রভাব, সেখান থেকে বঞ্চিত করার কৌশল রয়েছে আওয়ামী লীগের। সভায় নেতারা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশ না করার পেছনে যুক্তি দেন, উদ্যান আগের মতো খোলামেলা নেই। চারদিকে দেওয়ালবেষ্টিত উদ্যানে প্রচুর গাছপালা। বসার জায়গাও তুলনামূলকভাবে কম, ঢোকার ফটকগুলো ছোট। ফলে বড় আকারের সমাবেশে নেতাকর্মীদের ঢুকতে এবং বের হতে বেশ কষ্ট হয়। তাছাড়া বিএনপির সমাবেশ ঘিরে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের মূল ফটকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিপুলসংখ্যক সদস্য উপস্থিত থাকেন। অতীতে সেখানে সমাবেশ শেষে বের হয়ে ফেরার পথে অনেক নেতাকর্মীকে আটক করা হয়েছে। এছাড়া সমাবেশ ঘিরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা থেকে ছাত্রলীগের হামলার আশঙ্কাও করেছেন বিএনপির নীতিনির্ধারকরা। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অনুমতি : নয়াপল্টনে ১০ ডিসেম্বর সমাবেশ করতে চেয়ে বিএনপি যে আবেদন করেছিল, ‘যানজট ও নাগরিক দুর্ভোগ সৃষ্টি’র কারণ দেখিয়ে তা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে করার অনুমতি দিয়েছে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)। গতকাল মঙ্গলবার এ অনুমতি দিলেও ডিএমপির চিঠিতে বলা হয়েছে, এই অনুমতিপত্র স্থান ব্যবহারের অনুমতি নয়, স্থান ব্যবহারের জন্য অবশ্যই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে অনুমোদন নিতে হবে। বিএনপিকে দেয়া চিঠিতে সমাবেশের জন্য ২৬টি শর্তের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো-সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের অভ্যন্তরে সমাবেশের যাবতীয় কার্যক্রম সীমাবদ্ধ রাখতে হবে; উদ্যানের বাইরে বা সড়কের পাশে মাইক/সাউন্ডবক্স ব্যবহার করা যাবে না; উদ্যানের বাইরে বা সড়কের পাশে প্রজেক্টর স্থাপন করা যাবে না; উদ্যানের বাইরে, রাস্তায় বা ফুটপাতে কোথাও লোক সমাবেত হওয়া যাবে না; সমাবেশ শুরুর ২ ঘণ্টা আগে লোকজন সমবেত হওয়ার জন্য আসতে পারবে; সমাবেশস্থলের আশপাশসহ রাস্তায় কোনো অবস্থাতেই সমবেত হওয়াসহ যান ও জন চলাচলে কোনো প্রকার প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা যাবে না; পতাকা, ব্যানার, ফেস্টুন বহনের আড়ালে কোনো ধরনের লাঠিসোঁটা, রড ব্যবহার করা যাবে না; মিছিল সহকারে সমাবেশস্থলে আসা যাবে না। নিরাপত্তার জন্য নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় পর্যাপ্তসংখ্যক স্বেচ্ছাসেবক (দৃশ্যমান আইডি কার্ডসহ) নিয়োগ করতে হবে; স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনের নির্দেশনা অনুযায়ী নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় সমাবেশস্থলের অভ্যন্তরে ও বাইরে উন্নত রেজ্যুলেশনযুক্ত সিসি ক্যামেরা স্থাপন করতে হবে; নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় প্রতিটি প্রবেশগেটে আর্চওয়ে স্থাপন করতে হবে এবং সমাবেশস্থলে আগতদের হ্যান্ড মেটাল ডিটেক্টরের মাধ্যমে চেকিংয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। সন্দেহের চোখে দেখছেন বিএনপির নেতারা : বিএনপির দায়িত্বশীল নেতারা জানান, প্রথম দিকে সরকারি দলের প্রভাবশালী নেতা-মন্ত্রী কড়া ভাষায় বিএনপিকে ঢাকায় সমাবেশ করতে না দেয়ার কথা বলেছিলেন। সেখানে হঠাৎ বিএনপিকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশের অনুমতি দিয়ে সরকার এত নমনীয়তা দেখাচ্ছে কেন? স্থায়ী কমিটির এক সদস্য বলেন, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান বড় সমাবেশ করার মতো উপযুক্ত নয়। মাঠে প্রবেশের দুটি ছোট গেট আছে। হাজার হাজার নেতাকর্মী কীভাবে দুটি ছোট গেট দিয়ে প্রবেশ করবে? উদ্যানের বাইরেও হাজার হাজার নেতাকর্মী থাকবেন। মাঠে পর্যাপ্ত জায়গা না থাকায় এবং দেওয়াল দিয়ে ঘেরাও উদ্যানের মূল সমাবেশের সঙ্গে বাইরের নেতাকর্মীরা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বেন। তাছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের শক্ত অবস্থান থাকায় ওইদিক দিয়ে কেউ মাঠে প্রবেশ করবে না। শাহবাগ মোড়েও নেতাকর্মীরা বাধার মুখে পড়তে পারেন। এমন পরিস্থিতিতে কোনো বিশৃঙ্খলা দেখা দিলে তার দায়ভার কে নেবে? বিএনপিকে সমাবেশের অনুমতি দিতে ছাত্রলীগের সম্মেলন এগিয়ে আনা হয়েছে-এই বিষয়টি সরকারের উদারতা নয় বলে মনে করেন দলের নেতারা। তারা বলেন, বিষয়টি তাদের কৌশল। ক্ষমতাসীনদের বক্তব্য ও কার্যক্রম বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, বিএনপিকে একটি গ-ির মধ্যে আটকাতে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশের অনুমতি দেয়া হয়েছে। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, ‘আমরা মনে করি না সরকার কোনো সুস্থ চিন্তায় আছে। তারা যা বলে, করে তার উলটোটা। বিএনপি এ পর্যন্ত আটটি সমাবেশ করেছে। কুমিল্লা ছাড়া সবখানে পরিবহণ ধর্মঘট দিয়ে সরকারি দলই তো জনদুর্ভোগ সৃষ্টি করেছে। সেখানে ঢাকায় এক দিনের সমাবেশের জন্য জনদুর্ভোগের প্রশ্ন আসে কেন?’ বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও ঢাকা মহানগর উত্তরের আহ্বায়ক আমানউল্লাহ আমান বলেন, ‘সরকার ও সরকারি দলের নেতা-মন্ত্রীরা বলছেন, ঢাকায় বিএনপির সমাবেশ ঘিরে পরিবহণ ধর্মঘট হবে না। মুখে একথা বললেও তাদের উদ্দেশ্য ভিন্ন। ঢাকার সমাবেশ বানচাল করার জন্য অতীতের ন্যায় তারা ফের রাস্তায় গাড়িতে আগুন দিয়ে বিএনপির ওপর দায় চাপানোর পরিকল্পনা করছে। কিন্তু বিএনপি কোনো ফাঁদে পা দেবে না। অন্য বিভাগীয় গণসমাবেশগুলোর মতো ঢাকার সমাবেশও শান্তিপূর্ণ হবে।’ উপকমিটি : ঢাকার গণসমাবেশ সফল করতে ৭টি উপকমিটি গঠন করা হয়েছে। বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আব্দুল্লাহ আল নোমানকে আহ্বায়ক ও অ্যাডভোকেট আহমেদ আজম খানকে সদস্য সচিব করে ১১ সদস্য বিশিষ্ট অভ্যর্থনা উপকমিটি। চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আমান উল্লাহ আমান ও আব্দুস সালামকে কো-কনভেনর এবং ঢাকা বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট আব্দুস সালাম আজাদকে সদস্য সচিব করে ১৪ সদস্য বিশিষ্ট ব্যবস্থাপনা উপকমিটি। চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আব্দুস সালামকে আহ্বায়ক ও যুবদলের কেন্দ্রীয় সভাপতি সুলতান সালাউদ্দিন টুকুকে সদস্য সচিব করে ১৬ সদস্য বিশিষ্ট শৃঙ্খলা উপকমিটি। বিএনপির স্বেচ্ছাসেবক বিষয়ক সম্পাদক মীর সরাফত আলী সপুকে আহ্বায়ক ও সহ-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক ইঞ্জিনিয়ার আশরাফ উদ্দিন বকুলকে সদস্য সচিব করে ১৬ সদস্য বিশিষ্ট প্রচার উপকমিটি। বিএনপির প্রচার সম্পাদক শহীদ উদ্দিন চৌধুরীকে আহ্বায়ক এবং সহ-প্রশিক্ষণ বিষয়ক সম্পাদক অধ্যাপক ড. মোর্শেদ খানকে সদস্য সচিব করে ১৫ সদস্য বিশিষ্ট মিডিয়া উপকমিটি। সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক বেনজীর আহমেদ টিটোকে আহ্বায়ক এবং সহ-স্বাস্থ্য বিষয়ক সম্পাদক ডা. দেওয়ান মোহাম্মদ সালাউদ্দিন বাবুকে সদস্য সচিব করে ৮ সদস্য বিশিষ্ট যোগাযোগ উপকমিটি এবং জাসাস সভাপতি চিত্রনায়ক হেলাল খানকে আহ্বায়ক ও সদস্য সচিব জাকির হোসেন রোকনকে সদস্য সচিব করে ৩৫ সদস্য বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক উপকমিটি গঠন করা হয়েছে।