স্টাফ রিপোর্টার: বিদ্যমান নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা পরিবর্তনের পক্ষে মতো দিয়েছে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) সংলাপে অংশ নেয়া বেশিরভাগ দল। তবে বিএনপিসহ ৯টি দল এই সংলাপে অংশই নেয়নি। ইসির নিবন্ধিত ৩৯ দলের মধ্যে এখন পর্যন্ত ২৬টি দল সংলাপে অংশ নিয়েছে। আগামীকাল রোববার ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও সংসদের প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টির সঙ্গে সংলাপের কথা রয়েছে। গত ১৭ জুলাই থেকে শুরু হওয়া সংলাপে অন্তত ১৮টি দল চলমান নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে নানা প্রস্তাব দিয়েছে। এর মধ্যে চারটি দল তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনা বা নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের সুপারিশ করেছে। ভোটের সময় স্বরাষ্ট্র, জনপ্রশাসনসহ কয়েক মন্ত্রণালয় ইসির অধীনে নিয়ে আসার প্রস্তাব দিয়েছে ১৩টি দল। চারটি দল নিবন্ধিত দলগুলোর সমন্বয়ে নির্বাচনকালীন সরকার গঠনের সুপারিশ করেছে। এমনকি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের শরিক রাশেদ খান মেননের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি, দিলীপ বড়–য়ার সাম্যবাদী দল ও তরীকত ফেডারেশনও বর্তমান অবস্থার পরিবর্তন চেয়েছে। তারা ভোটের সময় স্বরাষ্ট্র, জনপ্রশাসন ও স্থানীয় সরকার বিভাগ ইসির হাতে রাখার প্রস্তাব দিয়েছে। এছাড়া তপশিল ঘোষণার পরে সংসদ ভেঙে দেয়া, মন্ত্রিপরিষদকে অকার্যকর রাখা, রিটার্নিং কর্মকর্তার দায়িত্ব ডিসিদের না দেয়া এবং ইভিএম ব্যবহারের বিরুদ্ধে জোরালো বক্তব্য উঠে এসেছে সংলাপে।
২০১১ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের পর দেশে ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে দশম সংসদ ও ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে একাদশ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। দলীয় সরকার ও সংসদ বহাল রেখেই তখন ভোট গ্রহণ করা হয়। বিদ্যমান পদ্ধতি বহাল রেখেই আগামী সংসদ নির্বাচন চায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। অন্যদিকে বিএনপিসহ সমমনারা দলীয় সরকারের পদত্যাগ ও নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার গঠনের দাবি জানিয়ে আসছে।
দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের কর্মপদ্ধতি ঠিক করতে ভোটের দেড় বছর আগেই রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে এ সংলাপের আয়োজন করেছে ইসি। এতে ইসির নিবন্ধিত সব রাজনৈতিক দলের সবাইকে পর্যায়ক্রমে অংশ নেয়ার আমন্ত্রণ জানানো হয়। সর্বশেষ বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) এতে অংশ নিতে অস্বীকৃতি জানায়। জাতীয় পার্টি-জেপি ও ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি-ন্যাপ সময় পরিবর্তনের অনুরোধ জানিয়ে ইসিতে চিঠি দিয়েছে। আগস্টের পরে বাকি দলগুলোর সঙ্গে সংলাপে বসার পরিকল্পনা রয়েছে ইসির। গণফোরাম, জমিয়তে উলামায়ে বাংলাদেশ ও খেলাফত আন্দোলন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনা বা নির্বাচনের সময় নিরপেক্ষ সরকারের দাবি তুলেছে। ১৩টি দলের পক্ষ থেকে নির্বাচনের সময় স্বরাষ্ট্র, জনপ্রশাসনসহ কয়েক মন্ত্রণালয় নির্বাচনকালীন ইসির অধীনে নিয়ে আসার প্রস্তাব করা হয়েছে। তবে এসব প্রস্তাব বাস্তবায়নে সংবিধান সংশোধন প্রয়োজন বলে মনে করছেন সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার। তার মতে, এসব প্রস্তাব নিয়ে ইসির উদ্যোগ নেয়ার সুযোগ রয়েছে। এ সংলাপে এক ধরনের ঐকমত্য সৃষ্টি হয়েছে বলেও মনে করেন তিনি।
আগামী সংসদ নির্বাচনে ইসির করণীয় সম্পর্কে দলগুলোর পরামর্শ নেয়ার জন্য এই সংলাপ হলেও ঘুরেফিরে নির্বাচনকালীন সরকারই সবচেয়ে বেশি আলোচিত হয়েছে। তবে এর সমাধান দেয়ার সাংবিধানিক সুযোগ ইসির হাতে নেই বলে মনে করছে সংস্থাটি। প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়ালও বলেছেন, সংবিধানের মধ্যে থেকেই ইসিকে দায়িত্ব পালন করতে হবে। নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত সরকারের কাছে তুলে ধরা হবে। রাজনৈতিক দলগুলোকে নিজেদের মধ্যে ঐকমত্য সৃষ্টির আহ্বান জানিয়ে সিইসি বলেছেন, এটা করতে পারলে সংবিধান কোনো বাধা নয়। জনগণের প্রয়োজনে সংবিধান সংশোধনও করা যেতে পারে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, আপাতদৃষ্টিতে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে সৃষ্ট চলমান বিরোধ একটি ইস্যুতে আটকে রয়েছে। একপক্ষ বলছে, দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। অন্যপক্ষ বলছে, বিদ্যমান সংবিধানের আলোকে দলীয় সরকারের অধীনেই নির্বাচন হতে হবে। সিইসিও সংলাপে বারবার বলেছেন, রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান রাজনৈতিকভাবে করতে হবে। সংবিধান ও আইন পরিবর্তন হলে তা মেনে চলতে ইসি বাধ্য।
তবে ইসির এ অবস্থানকে দায় এড়ানোর চেষ্টা বলে মনে করছেন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ-টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান। রাজনৈতিক দলের এসব প্রস্তাবকে যৌক্তিক আখ্যা দিয়ে তিনি বলেছেন, নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নষ্ট হয়েছে। সবার জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করার পরেই ইসিকে তফসিল ঘোষণা করতে হবে।
তিনি বলেন, সংবিধানের দোহাই দিলে চলবে না। সংবিধান তো পাথর নয়। পরিবর্তন হতে হতেই বর্তমান সংবিধান এই স্থানে এসেছে। ইসিও জানে, এসব প্রস্তাব বাস্তবায়ন করতে না পারলে নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না। ইসির ওপর জনমনে আস্থা বাড়ানোর জন্য হলেও তাদের উচিত এসব সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব সরকারের কাছে সুপারিশ আকারে তুলে ধরা। তার মতে, নির্বাচনের আগে এসব প্রস্তাব বাস্তবায়নের যথেষ্ট সময় রয়েছে। তাই এখনই উদ্যোগ নেয়া উচিত। ইসি কার্যালয়ের আইন শাখার কর্মকর্তারা মনে করছেন, বিদ্যমান আইন ও বিধি অনুযায়ী ইসির সাধ্যের মধ্যে থাকা বেশকিছু অভিন্ন দাবি এসেছে রাজনৈতিক দলগুলোর কাছ থেকে। যেমন রিটার্নিং কর্মকর্তার দায়িত্ব ডিসিদের হাতে দেয়ার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে আটটি রাজনৈতিক দল। এসব দলের প্রস্তাব হচ্ছে, ইসির নিজস্ব কর্মকর্তাদের এই দায়িত্ব দেয়া হোক। একটি দলের পক্ষ থেকে এই দায়িত্ব জেলা জজদের দেয়ার সুপারিশ করা হয়েছে।
ইভিএমের বিরুদ্ধে ১৩ দল: বহুল আলোচিত ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ব্যবহারের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে ১৩টি রাজনৈতিক দল। ৭টি দলের মতে অবশ্য ‘ইভিএমের ব্যবহার সময়ের দাবি’। এ মেশিন ব্যবহারের পক্ষে মত দিয়ে জাতীয় গণতান্ত্রিক আন্দোলন-এনডিএমসহ কয়েকটি দল বলেছে, সঠিক প্রতীকে ভোট পড়ার বিষয়টি নিশ্চিত করতে ইভিএমে পেপার অডিট ট্রেইল সংযুক্ত করতে হবে। তবে ইভিএমের বিপক্ষে সরাসরি মতো দিয়েছে বাংলাদেশ কংগ্রেস, ইসলামী ফ্রন্ট, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, খেলাফত মজলিস, গণফ্রন্ট, বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি, খেলাফত আন্দোলন, মুসলিম লীগ, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি, গণফোরাম, জাকের পার্টি ও জমিয়তে উলামায়ে বাংলাদেশ।
নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে প্রস্তাব: তিনটি দল সংবিধান অনুযায়ী বিদ্যমান সরকার ব্যবস্থা বহাল রাখার পক্ষে মত দিয়েছে। আর ৬টি রাজনৈতিক দল নির্বাচনের সময় সংসদ ভেঙে দেওয়ার দাবি জানিয়েছে। অন্তত আটটি রাজনৈতিক দল জেলা প্রশাসকদের নির্বাচনে রিটার্নিং কর্মকর্তা নিয়োগের বিরোধিতা করেছে। তাদের মধ্যে ৬টি দল ইসির জনবল থেকেই রিটার্নিং কর্মকর্তা নিয়োগের প্রস্তাব করেছে। এনডিএম ও বাংলাদেশ কংগ্রেস নির্বাচনের সময় জনপ্রশাসনকে ইসির নিয়ন্ত্রণে নেয়া এবং জেলা প্রশাসক ও পুলিশ প্রশাসনে রদবদল আনার সুপারিশ করেছে। বাংলাদেশ কংগ্রেস নির্বাচনের সময় স্বরাষ্ট্র, জনপ্রশাসন ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় ইসির তত্ত্বাবধানে পরিচালনার প্রস্তাব করেছে।
বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি নির্বাচনকালে স্বরাষ্ট্র, জনপ্রশাসন ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় নির্বাচন কমিশনের অধীনে ন্যস্ত করার প্রস্তাব করে। ভোটের আগের তিন মাস ও পরের তিন মাস কর্মকর্তাদের বদলি, শাস্তি, পদোন্নতি বিষয়ে ইসি সিদ্ধান্ত নেবে বলে তাদের প্রস্তাবে উল্লেখ করা হয়।
ইসলামী ফ্রন্ট নির্বাচনের সময় স্থানীয় সরকার, জনপ্রশাসন, স্বরাষ্ট্র, প্রতিরক্ষা ও অর্থ মন্ত্রণালয়; বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক মুক্তিজোট স্বরাষ্ট্র ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় এবং বিপ্লবী ওয়ার্কার্সপার্টি স্বরাষ্ট্র, জনপ্রশাসন, অর্থ, তথ্য ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় ইসির প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণে নেয়ার প্রস্তাব করেছে। খেলাফত মজলিস, তরীকত ফেডারেশন, সাম্যবাদী দল (এমএল), গণফ্রন্ট, খেলাফত আন্দোলন, ইসলামিক ফ্রন্ট, মুসলিম লীগও প্রায় একই ধরনের প্রস্তাব করেছে। ভোটের সময় ইসির চাহিদা অনুযায়ী নির্বাহী বিভাগকে তাদের অধীনে ন্যস্ত করার প্রস্তাব দিয়েছে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ।
ইসলামী ঐক্যজোট (আইওজে), সাম্যবাদী দল (এমএল) এবং বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচনের সময়ে বিদ্যমান সরকার ক্ষমতায় থাকার পক্ষে বলে মত দিয়েছে। তবে তিনটি দলই এ সময় সরকারের কার্যক্রম সীমিত রাখার প্রস্তাব করেছে। ইসলামী ঐক্যজোট ও সাম্যবাদী দল বলেছে, নির্বাচনকালীন সরকার শুধু রুটিন কাজ করবে। বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির প্রস্তাব হচ্ছে, সংবিধান অনুযায়ী বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচন হবে। নির্বাচনের সময় সরকার দৈনন্দিন কাজ করবে এবং উন্নয়নমূলক কাজ থেকে বিরত থাকবে। এ সময় মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যরা প্রটোকল পাবেন না।
নিবন্ধিত সব দল নিয়ে নির্বাচনকালীন সরকার গঠনের প্রস্তাব করেছে বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক মুক্তিজোট ও বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি। দলনিরপেক্ষ বা অন্তর্বতীকালীন সরকার গঠনের প্রস্তাব দিয়েছে বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পাটি, খেলাফত মজলিস ও খেলাফত আন্দোলন। সংসদে প্রতিনিধিত্বকারীদের নিয়ে সরকার গঠনের প্রস্তাব দিয়েছে গণফ্রন্ট ও মুসলিম লীগ।
সংসদ ভেঙে দেয়া: নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করতে তপশিল ঘোষণার পরে সংসদ ভেঙে দেয়ার দাবি জানিয়েছে সাংস্কৃতিক মুক্তিজোট, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, খেলাফত আন্দোলন, মুসলিম লীগসহ কয়েকটি দল।
সংলাপ বর্জন: সংলাপে অংশ নেয়নি বিএনপি, বাংলাদেশ মুসলিম লীগ (বিএমএল), বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জেএসডি), বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ), লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি), চরমোনাই পীরের দল ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) ও বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি।