স্টাফ রিপোর্টার: নতুন বছরের প্রথম দিনে উৎসব করে শিক্ষার্থীদের হাতে বই তুলে দেয়া হলেও তথ্যগত ভুল এড়াতে পারেনি জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। পাঠ্যবইয়ের ভুল নিয়ে শুরু হয় আলোচনা-সমালোচনা। এমতাবস্থাায় মাধ্যমিক স্তরের নবম শ্রেণির তিনটি বইয়ে ৯টি ভুলের সত্যতা স্বীকার করে সংশোধনী দিয়েছে এনসিটিবি মঙ্গলবার এনসিটিবির প্রধান সম্পাদক অধ্যাপক সন্তোষ কুমার ঢালী স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে ভুল সংশোধন করে এনসিটিবির ওয়েবসাইটে দেয়া হয়েছে। পুরোনো কারিকুলামের নবম-দশম শ্রেণির বাংলাদেশের ইতিহাস ও বিশ্বসভ্যতা, বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয় এবং পৌরনীতি ও নাগরিকতা বইয়ে এই ভুলগুলো হয়েছিলো। এদিকে, নতুন শিক্ষাক্রমের আলোকে লেখা সপ্তম শ্রেণির বিজ্ঞান ‘অনুসন্ধানী পাঠ’ বইয়ে হুবহু অনুবাদের যে অভিযোগ উঠেছে, তা সত্য বলে স্বীকার করে নিয়েছেন বইটির রচনা ও সম্পাদনার সঙ্গে যুক্ত থাকা অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবাল ও অধ্যাপক হাসিনা খান। দায় স্বীকার করে একটি যৌথ বিবৃতি দিয়েছেন তারা।
ভুলগুলোর মধ্যে নবম-দশম শ্রেণির বাংলাদেশের ইতিহাস ও বিশ্বসভ্যতা বইয়ের ১৮১ পৃষ্ঠায় অবরুদ্ধ বাংলাদেশ ও গণহত্যাবিষয়ক অংশে প্রথম লাইনে বলা হয়েছিল, ‘২৬ শে মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশজুড়ে পাকিস্তান সামরিক বাহিনী নির্যাতন, গণহত্যা আর ধ্বংসলীলায় মেতে উঠেছিল।’ এখন সংশোধনীতে বলা হয়েছে, ‘১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশজুড়ে পাকিস্তান সামরিক বাহিনী নির্যাতন, গণহত্যা আর ধ্বংসলীলায় মেতে ওঠে।’
একই বইয়ের ২০০ পৃষ্ঠায় একটি অংশে সংসদীয় পদ্ধতির সরকারব্যবস্থাা নিয়ে বলা হয়েছিল, ‘মুক্তিযুদ্ধের সূচনালগ্নে গঠিত বাংলাদেশ সরকারের রাষ্ট্রপতি ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বাংলাদেশের সরকারব্যবস্থাার ধরন কী হবে, এই সম্পর্কে তখনো কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়নি। স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পরদিনই ১৯৭২ সালের ১১ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু মন্ত্রিসভায় দীর্ঘ আলোচনার পর ‘অস্থাায়ী সংবিধান আদেশ’ জারির মাধ্যমে দেশে সংসদীয় পদ্ধতির সরকার প্রবর্তন করেন। ১২ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রধান বিচারপতি আবুসাদাত সায়েমের নিকট প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। একই দিনে রাষ্ট্রপতি হিসেবে নিয়োগ লাভ করেন বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী।’ এখন সংশোধনীতে বলা হয়েছে, প্রকৃতপক্ষে ওই সময় প্রধানমন্ত্রী হিসেবে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে শপথ পড়িয়েছিলেন ওই সময়ের নতুন রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী।
একই বইয়ের ২০২ পৃষ্ঠায় আরেকটি সংশোধনীতে সংবিধান প্রণয়ন ১৯৭২ এর পটভূমি অংশের প্রথম অনুচ্ছেদের পর নিচের লেখা যুক্ত করতে বলা হয়েছে। তা হলো, ‘সংবিধান প্রণয়নে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শিক অবস্থান প্রতিফলিত হয়েছিল। সংবিধান প্রণয়নের ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুর সার্বক্ষণিক দিকনির্দেশনা ছিল। তিনি সংবিধান কমিটিকে বিভিন্ন মৌলিক বিষয়ে প্রত্যক্ষ নির্দেশনা দিয়েছিলেন।’
২০৩ পৃষ্ঠায় সংবিধানের বৈশিষ্ট্যবিষয়ক একটি অংশে ভুল করে বলা হয়েছিল, পঞ্চম ভাগে জাতীয় সংসদ। এখন সংশোধনী দিয়ে বলা হয়েছে, ‘পঞ্চম ভাগে আইনসভা’ হবে।
বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয় বইয়ে তিনটি ভুলের সংশোধনী দিয়েছে এনসিটিবি। এই বইয়ের ৬ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছিল, ’৫৪ সালের নির্বাচনে ৪টি দল নিয়ে যুক্তফ্রন্ট গঠিত হয়। তাতে বইয়ে ৪টি দলের নামও দেওয়া হয়েছিল। এখন সংশোধনীতে বলা হয়েছে, ’৫৪ সালের নির্বাচনে ৫টি দল নিয়ে যুক্তফ্রন্ট গঠিত হয়। দল পাঁচটি হলো আওয়ামী লীগ, কৃষক শ্রমিক পার্টি, নেজামে ইসলাম, গণতন্ত্রী দল ও পাকিস্তান খেলাফতে রব্বানী পার্টি।
একই বইয়ের ১৬ পৃষ্ঠায় ঢাকার রাজারবাগ পুলিশ ক্যাম্প ও পিলখানা ইপিআর ক্যাম্প বলে উল্লেখ করা হয়েছিল। যা হবে রাজারবাগ পুলিশ লাইনস ও পিলখানা ইপিআর সদর দপ্তর। সংশোধনীতে তা উল্লেখ করা হয়েছে।
একই বইয়ের ২৮ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছিল, ‘সাধারণ মানুষের মৌলিক অধিকার সংরক্ষণ এ সংবিধানের প্রধান বৈশিষ্ট্য।’ এখানে সংশোধনীতে লেখা হয়েছে, ‘সাধারণ মানুষের মৌলিক মানবাধিকার সংরক্ষণ এ সংবিধানের প্রধান বৈশিষ্ট্য।’ আগে ভুল করে ‘মানবাধিকার’ শব্দটি বাদ পড়েছিল।
পৌরনীতি ও নাগরিকতা বইয়ে দুটি ভুল সংশোধন করা হয়েছে। এর মধ্যে ৫৭ পৃষ্ঠায় হওয়া একটি ভুলের সংশোধন দিয়ে বলা হয়, ‘রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা ও কাজ’ এর ১ ক্রমিকের অনুচ্ছেদে প্রতিস্থাাপিত হবে…‘রাষ্ট্রপতি রাষ্ট্রের প্রধান। সরকারের সকল শাসনসংক্রান্ত কাজ তার নামে পরিচালিত হয়। তিনি প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্র ব্যতীত তার সকল দায়িত্ব পালনে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী কাজ পরিচালনা করেন। তিনি মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রীদের নিয়োগ করেন। রাষ্ট্রের শীর্ষস্থাানীয় কর্মকর্তাদের (মহা হিসাবরক্ষক, রাষ্ট্রদূত ও অন্যান্য উচ্চপদস্থা কর্মকর্তা) নিয়োগের দায়িত্বও রাষ্ট্রপতির। প্রতিরক্ষা কর্ম বিভাগসমূহের সর্বাধিনায়কতা রাষ্ট্রপতির উপর ন্যস্ত। তিন বাহিনীর (সেনা, বিমান ও নৌবাহিনী) প্রধানদের তিনিই নিয়োগ দেন।’
একই বইয়ে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা ও কাজের বিষয়েও একটি সংশোধনী দেয়া হয়েছে। এতে বলা হয়, ‘প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা ও কাজ’-১ ক্রমিকের অনুচ্ছেদটি প্রতিস্থাাপিত হবে… ‘প্রধানমন্ত্রী মন্ত্রিপরিষদের প্রধান। প্রধানমন্ত্রীর কর্তৃত্বে সংবিধান অনুযায়ী প্রজাতন্ত্রের নির্বাহী ক্ষমতা প্রয়োগ করা হয়। তিনি মন্ত্রিসভার সদস্যসংখ্যা নির্ধারণ করেন ও মন্ত্রীদের মধ্যে দপ্তর বণ্টন করেন। তিনি যেকোনো মন্ত্রীকে তার পদ থেকে অপসারণের পরামর্শ দিতে পারেন।’
এদিকে, নতুন শিক্ষাক্রমের আলোকে লেখা সপ্তম শ্রেণির বিজ্ঞান ‘অনুসন্ধানী পাঠ’ বইয়ে হুবহু অনুবাদের যে অভিযোগ উঠেছে, তা সত্য বলে স্বীকার করে নিয়েছেন বইটির রচনা ও সম্পাদনার সঙ্গে যুক্ত থাকা অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবাল ও অধ্যাপক হাসিনা খান। দায় স্বীকার করে একটি যৌথ বিবৃতি দিয়েছেন তারা।
বিবৃতিতে বলা হয়েছে- সারা দেশে ২০২৩ সালে চালু হওয়া নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির বিজ্ঞান পাঠ্যপুস্তক ছাপা হয়েছে এবং শিক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছে দেয়া হয়েছে। সম্প্রতি সপ্তম শ্রেণির বিজ্ঞান ‘অনুসন্ধানী পাঠ’ বইটির ব্যাপারে একটি অভিযোগ তাদের নজরে এসেছে।
অভিযোগে উল্লেখ করা হয়েছে, এই বইয়ের কোনো কোনো অধ্যায়ের অংশবিশেষ ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক এডুকেশনাল সাইট থেকে নিয়ে হুবহু অনুবাদ করে ব্যবহার করা হয়েছে। বইয়ের এই নির্দিষ্ট অংশটুকু এবং ওয়েবসাইটটির একই লেখাটুকু তুলনা করে অভিযোগটি আমাদের কাছে সত্য বলেই প্রতীয়মান হয়েছে।
বিবৃতিতে তারা বলেন, ‘একই পাঠ্যপুস্তক রচনার সঙ্গে অনেকে জড়িত থাকেন, যাদের শ্রম ও নিষ্ঠার ফল হিসেবে বইটি প্রকাশিত হয়। বিশেষত জাতীয় পাঠ্যপুস্তক রচনার ক্ষেত্রে এসব লেখকের কাছ থেকেই একধরনের দায়িত্বশীলতা আশা করা হয়। সেখানে কোনো একজন লেখকের লেখা নিয়ে এ ধরনের অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেলে তা আমাদের টিমের জন্য হতাশার এবং মন খারাপের কারণ হয়। ওই অধ্যায়ের আলোচিত অংশটুকু লেখার দায়িত্বে আমরা দুজন না থাকলেও সম্পাদক হিসেবে এর দায় আমাদের ওপরও বর্তায়, সেটি আমরা স্বীকার করে নিচ্ছি। অবশ্যই পরবর্তী সংস্করণে বইটির প্রয়োজনীয় পরিমার্জন করা হবে।’
বিবৃতিতে আরও বলা হয়, এ বছর বইটির পরীক্ষামূলক সংস্করণ চালু হয়েছে এবং সামনের শিক্ষাবর্ষ থেকে এতে যথেষ্ট পরিমার্জন ও সম্পাদনার সুযোগ রয়েছে। কাজেই উল্লিখিত অভিযোগের বাইরেও যে কোনো যৌক্তিক মতামতকে যথেষ্ট গুরুত্বের সঙ্গে নেয়া হবে এবং সে অনুযায়ী পাঠ্যবইয়ের প্রয়োজনীয় পরিবর্তন বা পরিমার্জন করা হবে।
এ বিষয়ে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক ফরহাদুল ইসলাম বলেন, তারা (অধ্যাপক জাফর ইকবাল ও অধ্যাপক হাসিনা খান) হুবহু অনুবাদের বিষয়ে তাদের দায় স্বীকার করেছেন। তবে এমনটা করা উচিত নয়।
তিনি বলেন, নতুন শিক্ষাক্রমের যে কোনো পাঠ্যপুস্তক প্রথম বছর পরীক্ষামূলকভাবে যায়। আমাদেরও গেছে। এরপর যখন আমরা পরিমার্জন পর্যায়ে যাব, তখন সারাদেশের শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে মতামত নিব। সব পক্ষের মতামত ও মাঠ পর্যায়ের তথ্যও নিব। এরপর পরীক্ষামূলক সংস্করণ বাদ দিয়ে পরিমার্জিত সংস্করণ শুরু করব। যদি কোনো ভুল ধরা পড়ে, সেটাও সংশোধন করা হবে। এরপর আগামী বছর সংশোধিত বই পাঠানো হবে।
প্রসঙ্গত, সম্প্রতি সপ্তম শ্রেণির বিজ্ঞান ‘অনুসন্ধানী পাঠ’ বইয়ের একটি অংশে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক এডুকেশনাল সাইট থেকে নিয়ে হুবহু গুগল ট্রান্সলেটর দিয়ে অনুবাদ করে ব্যবহার করার অভিযোগ ওঠে। বইটি রচনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল, ড. হাসিনা খান, ড. মোহাম্মদ মিজানুর রহমান খান, ড. মুশতাক ইবনে আয়ূব, রনি বসাক। আর সম্পাদনার দায়িত্বে ছিলেন মুহম্মদ জাফর ইকবাল।