মনোনয়নপত্র জমা দেয়া যাবে ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত বাছাই ১-৪ ডিসেম্বর প্রত্যাহারের শেষ তারিখ ১৭ ডিসেম্বর প্রতীক বরাদ্দ ১৮ ডিসেম্বর
স্টাফ রিপোর্টার: দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। ঘোষিত তারিখ অনুযায়ী, ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি জাতীয় নির্বাচনের ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে। গতকাল বুধবার সন্ধ্যা ৭টায় আগারগাঁওয়ে নির্বাচন কমিশন ভবন থেকে জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল এ তফসিল ঘোষণা করেন। ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী, নির্বাচনে প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র দাখিলের শেষ দিন ৩০ নভেম্বর, মনোনয়নপত্র যাচাই-বাছাই ১ থেকে ৪ ডিসেম্বর, আপিল ও নিষ্পত্তি ৬ থেকে ১৫ ডিসেম্বর, প্রার্থিতা প্রত্যাহারের শেষ তারিখ ১৭ ডিসেম্বর ও প্রতীক বরাদ্দ ১৮ ডিসেম্বর। এর পর থেকে নির্বাচনি প্রচার-প্রচারণা চলবে ৫ জানুয়ারি সকাল ৮টা পর্যন্ত। সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১২৩ দফা (৩) উপদফা (ক)-এর বরাতে এবং নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্ত মোতাবেক দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময়সূচি ঘোষণা করেন সিইসি। এর আগে, বিকেল ৫টায় তফসিল নিয়ে ২৬তম কমিশন বৈঠকে বসেন কাজী হাবিবুল আউয়াল নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন। সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় শেষ হয় বৈঠক। এরপর সিইসি জাতির উদ্দেশে ভাষণে তফসিল ঘোষণা করেন। নির্বাচন প্রশ্নে দেশের সার্বিক রাজনৈতিক নেতৃত্বের মধ্যে মতভেদ পরিলক্ষিত হচ্ছে উলেস্নখ করে প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেন, ‘মতভেদ থেকে সংঘাত ও সহিংসতা হলে তা থেকে সৃষ্ট অস্থিতিশীলতা নির্বাচনপ্রক্রিয়ায় বিরূপ প্রভাব বিস্তার করতে পারে। মতৈক্য ও সমাধান প্রয়োজন।’ সিইসি বলেন, ‘আমি নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে সব রাজনৈতিক দলকে বিনীতভাবে অনুরোধ করব সংঘাত ও সহিংসতা পরিহার করে সদয় হয়ে সমাধান অন্বেষণ করতে।’ সংলাপের মাধ্যমে সমঝোতা ও সমাধান অসাধ্য নয় উলেস্নখ করে সিইসি বলেন, ‘পরমতসহিষ্ণুতা, পারস্পরিক আস্থা, সহনশীলতা ও সহমর্মিতা টেকসই ও স্থিতিশীল গণতন্ত্রের জন্য আবশ্যকীয় নিয়ামক।’
জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে সিইসি উল্লেখ করেন, সরকার আসন্ন সংসদ নির্বাচনকে সুষ্ঠু, অবাধ, নিরপেক্ষ, অংশগ্রহণমূলক ও শান্তিপূর্ণ করার লক্ষ্যে সুস্পষ্ট প্রতিশ্রুতি বারবার ব্যক্ত করেছে। কমিশনও তার আয়ত্তে থাকা সর্বোচ্চ সামর্থ্য দিয়ে এবং সরকার থেকে আবশ্যক সব সহায়তা নিয়ে নির্বাচনকে অবাধ, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ করার বিষয়ে সততা, নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করবে। সংবিধানে সংসদের মেয়াদ পূর্তির আগের ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন আয়োজনের সুস্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে উলেস্নখ করে সিইসি বলেন, ‘এ নির্দেশনা নির্বাচন কমিশন সরকারের নির্বাহী বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারী ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহায়তা নিয়ে সম্পন্ন করে থাকে।’ সিইসি উল্লেখ করেন, নির্বাচন সুষ্ঠু, অবাধ, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক হতে পারে কেবল সংশ্লিষ্ট প্রক্রিয়ায় সংশ্লিষ্ট সবার সমন্বিত সহযোগিতা ও অংশগ্রহণের মাধ্যমেই। রাজনৈতিক দলগুলো গণতান্ত্রিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে প্রার্থী দিয়ে নির্বাচনে কার্যকরভাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলে কেন্দ্রে কেন্দ্রে ভারসাম্য প্রতিষ্ঠিত হয়, নির্বাচন আরও পরিশুদ্ধ ও অর্থবহ হয়। তাতে জনমতেরও শুদ্ধতর প্রতিফলন ঘটে। সিইসি তার ভাষণের শেষ দিকে নির্বাচনপ্রক্রিয়ায় সব রাজনৈতিক দল, প্রার্থী ও জনগণের অংশগ্রহণ ও সক্রিয় সহযোগিতা কামনা করেন। এর আগে, বিকালে অনুষ্ঠিত কমিশনের বৈঠকে চার নির্বাচন কমিশনার মো. আহসান হাবিব খান, রাশেদা সুলতানা, মো. আলমগীর, মো. আনিছুর রহমান এবং ইসি সচিব মো. জাহাংগীর আলম উপস্থিত ছিলেন। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের পথে দেশ: ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর সংসদের প্রথম অধিবেশন বসে ২০১৯ সালের ৩০ জানুয়ারি। সে হিসাবে আগামী ২৯ জানুয়ারির মধ্যে নির্বাচন আয়োজনের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। আসন্ন দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে ভোট দিতে পারবেন ১১ কোটি ৯৬ লাখ ৯১ হাজার ৬৩৩ জন ভোটার। তাদের মধ্যে পুরুষ ভোটার ৬ কোটি ৭ লাখ ৭১ হাজার ৫৭৯ জন এবং নারী ভোটার ৫ কোটি ৮৯ লাখ ১৯ হাজার ২০২ জন। আর তৃতীয় লিঙ্গের ভোটার রয়েছেন ৮৫২ জন। ২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় ভোটার ছিলো ১০ কোটি ৪২ লাখ ৩৮ হাজার ৬৭৭ জন। সে হিসেবে পাঁচ বছরে দেশে ভোটার বেড়েছে এক কোটি ৫৪ লাখ ৫২ হাজার ৯৫৬ জন। বর্তমানে নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত দল আছে ৪৪টি। এসব নিবন্ধিত দল ছাড়াও স্বতন্ত্র প্রার্থীরা নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন। এবারের নির্বাচনে সম্ভাব্য ভোটকেন্দ্র ৪২ হাজার ১০৩টি এবং ভোটকক্ষ ২ লাখ ৬১ হাজার ৯১২। ২০২২ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি শপথ নেন কাজী হাবিবুল আউয়াল কমিশন। চার নির্বাচন কমিশনার হলেন-অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আহসান হাবিব খান, অবসরপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ রাশেদা সুলতানা, অবসরপ্রাপ্ত জ্যেষ্ঠ সচিব মো. আলমগীর ও মো. আনিছুর রহমান। তাদের মেয়াদে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনই হবে সবচেয়ে বড় কর্মযজ্ঞ। রোডম্যাপ ধরে তফসিল আগে-পরের সব ধরনের প্রস্তুতি শেষ হয়েছে। তফসিল ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে রিটার্নিং অফিসার ও সহকারী রিটার্নিং অফিসার নিয়োগ থেকে ভোটের দিন ও ফলাফল গেজেট আকারে প্রকাশ পর্যন্ত কাজের ফর্দ নিয়ে নামবে ইসি। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে ৫৩ দিন সময় দিয়ে তফসিল ঘোষণা করল নির্বাচন কমিশন। এবার ইসিতে নিবন্ধিত দল রয়েছে ৪৪টি, তারাই দলীয়ভাবে ভোট করার সুযোগ পাবে। প্রথম সংসদ নির্বাচনে ৬০ দিন সময় দিয়ে তফসিল হয়েছিলো। তাতে ১৪টি দল অংশ নেয়। ৫৪ দিন সময় দিয়ে দ্বিতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোট হয়। ২৯ দল তাতে অংশ নেয়। তৃতীয় সংসদ নির্বাচনে ৪৭ দিন সময় দিয়ে তফসিল হয়। সেই নির্বাচনে অংশ নেয় ২৮টি দল। চতুর্থ সংসদ নির্বাচনে ৬৯ দিন সময় রেখে তফসিল হয়েছিল। মাত্র ৮টি দল সেই নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল। নব্বইয়ের গণ-আন্দোলনের পর পঞ্চম সংসদ নির্বাচনে সর্বোচ্চ ৭৮ দিন সময় দিয়ে তফসিল হয়েছিল। তাতে ৭৫টি দল অংশ নেয়। ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির ষষ্ঠ সংসদ নির্বাচনে তফসিল দিয়ে তিনবার পরিবর্তন করতে হয়। অধিকাংশ দলের বর্জনের মধ্যে এতে অংশ নেয় ৪১টি দল। সপ্তম সংসদ নির্বাচনে ৪৭ দিন সময় দেয়া হয়। সর্বোচ্চ ৮১টি দল অংশ নেয় তাতে। সবচেয়ে কম ৪২ দিন সময় দিয়ে অষ্টম সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হয়। ৫৪টি দল তাতে অংশ নেয়। নবম সংসদ নির্বাচনেও ৪৭ দিন সময় নিয়ে ভোটের তফসিল ঘোষণা করা হয়। নির্বাচনে অংশ নিতে নিবন্ধন বাধ্যতামূলক করায় কেবল নিবন্ধিত ৩৮টি দল অংশ নেয়। দশম সংসদ নির্বাচনে ৪২ দিন সময় দিলে তফসিল ঘোষণা করে, দল অংশ নেয় ১২টি। বিএনপিসহ সমমনা দলগুলো ভোট বর্জন করে এবং ১৫৩ আসনে বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার রেকর্ড হয়। একাদশ সংসদ নির্বাচনে ৪৬ দিন সময় দিয়ে তফসিল ঘোষণা করার পর এক সপ্তাহ পিছিয়ে নিয়ে পুননির্ধারণ করা হয় ভোটের তারিখ। তাতে ৩৯টি দল ভোটে অংশ নেয়। ইসির তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের ২৯ জানুয়ারির আগের ৯০ দিনের মধ্যে নতুন নির্বাচন অনুষ্ঠানের সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা রয়েছে। সে অনুসারেই তফসিল ঘোষণা করছে নির্বাচন পরিচালনাকারী সাংবিধানিক সংস্থাটি। তবে তফসিল ঘোষণা এই সময়ে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে ভোটের দাবিতে অবরোধ কর্মসূচি পালন করছে বিএনপি ও যুগপৎ আন্দোলনে থাকা রাজনৈতিক দল ও জোটগুলো। বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) আজ বৃহস্পতিবার আধাবেলা হরতাল ডেকেছে। জামায়াতে ইসলামীও একই কর্মসূচি দিয়েছে। ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ রাজনৈতিক সমঝোতা ছাড়া তফসিল ঘোষণার প্রতিবাদে বুধবার নির্বাচন কমিশন অভিমুখে গণমিছিল কর্মসূচি পালন করেছে। এর আগে, যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টিকে চিঠি দিয়ে শর্তহীন সংলাপের আহ্বান জানিয়েছেন। আওয়ামী লীগ ও তার মিত্ররা সংবিধান অনুযায়ী বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচনের কথা বলছে। তফসিল ঘোষণার সময় রাজনৈতিক মতানৈক্যের বিষয়টি উঠে আসে জাতির উদ্দেশে দেয়া সিইসির ভাষণেও। তিনি বলেন, ‘অবাধ, নিরপেক্ষ, অংশগ্রহণমূলক ও উৎসবমুখর নির্বাচনের জন্য কাক্সিক্ষত অনুকূল রাজনৈতিক পরিবেশের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। কিন্তু নির্বাচন প্রশ্নে, বিশেষত নির্বাচনের প্রাতিষ্ঠানিক পদ্ধতির প্রশ্নে, দীর্ঘ সময় ধরে দেশের সার্বিক রাজনৈতিক নেতৃত্বে মতভেদ পরিলক্ষিত হচ্ছে।’ এ সময় সিইসি আরও বলেন, ‘বহুদলীয় রাজনীতিতে মতাদর্শগত বিভাজন থাকতেই পারে। কিন্তু মতভেদ থেকে সংঘাত ও সহিংসতা হলে তা থেকে সৃষ্ট অস্থিতিশীলতা নির্বাচনপ্রক্রিয়ায় বিরূপ প্রভাব বিস্তার করতে পারে।’