স্টাফ রিপোর্টার: দেশে ফের ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে করোনাভাইরাস। পাল্লা দিয়ে বাড়ছে সংক্রমণ ও মৃত্যু। দৈনিক শনাক্তের হার প্রায় ১৭ শতাংশ। গত ২৪ ঘণ্টায় দেশে আক্রান্তদের মধ্যে আরও ৬০ জনের মৃত্যু হয়েছে। যা দেড় মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ। একদিনে নতুন করে আরও ৩ হাজার ৯৫৬ জনের দেহে করোনা সংক্রমণ ধরা পড়েছে। এটা ২ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ। ফলে স্থানীয় হাসপাতালগুলোতে করোনা রোগীদের ভিড় আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। অনেক হাসপাতালে ধারণক্ষমতার চেয়ে রোগী বেশি। শয্যা সংকটে চিকিৎসা ব্যবস্থাও ব্যাহত হচ্ছে। ঢাকাতেও ক্রমশ বাড়ছে সংক্রমণ।
এ পরিস্থিতিতে সরকার প্রাণঘাতী এ ভাইরাসের সংক্রমণ রোধে চলমান বিধিনিষেধের (লকডাউন) মেয়াদ বাড়িয়েছে আরও এক মাস । ছয় শর্তে ১৫ জুলাই মধ্যরাত পর্যন্ত বিধিনিষেধ কার্যকর থাকবে। তবে কোথাও সংক্রমণ পরিস্থিতি আরও অবনতি ঘটলে কারিগরি কমিটির সঙ্গে পরামর্শ করে স্থানীয় প্রশাসন সংশ্লিষ্ট এলাকায় কঠোর লকডাউন দিতে পারবে। এদিকে ১৩ জুন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার কথা থাকলেও করোনার জন্য সরকার সেখান থেকে সরে এসেছে। ৩০ জুন পর্যন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছুটি বৃদ্ধি করা হয়েছে। করোনার কারণে এসএসসি ও এইচএসপি পরীক্ষা নিয়েও বিকল্প চিন্তা করছে মন্ত্রণালয়। ২৬ এপ্রিল থেকে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সীমান্ত বন্ধ করে দেয়া হয়। পরে চার দফা সময় বাড়িয়ে ৩০ জুন পর্যন্ত বন্ধের মেয়াদ বৃদ্ধি করা হয়েছে। সরকারের এতো উদ্যোগের পরও মানুষের মাঝে সচেতনতা বাড়ছে না। ফলে সংক্রমণ বেড়েই চলেছে।
ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট শনাক্ত হওয়ার পর সীমান্তবর্তী এলাকায় বাড়তে থাকে সংক্রমণ। এজন্য ভারতের সঙ্গে সীমান্ত বন্ধের মেয়াদ চার দফায় বাড়ানো হয়েছে। এতে সীমান্ত এলাকায় সংক্রমণ কিছুটা কমলেও চুয়াডাঙ্গা, মেরেহপুর, ঝিনাইদ, সাতক্ষীরা, মাগুরা, নড়াইল, কুষ্টিয়া, যশোরে ফের ঊর্ধ্বমুখী। সেই সঙ্গে বাড়ছে মৃত্যুও। ২৪ ঘণ্টায় রাজশাহী ও খুলনা বিভাগে ৩১ জনের মৃত্যু হয়েছে। করোনা সংক্রমণ সীমান্তবর্তী এলাকা থেকে এখন ঢাকার দিকে ছুটে আসছে। রাজধানীর হাসপাতালগুলোতে বাড়ছে করোনা রোগীর সংখ্যা।
এদিকে করোনার থাবা মারাত্মক রূপ নিলেও সাধারণ মানুষের মধ্যে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার প্রবণতা তেমন দেখা যাচ্ছে না। সরকার ঘোষিত কঠোর বিধিনিষেধের কোনো তোয়াক্কাই করছেন না তারা। অলিগলি সর্বত্রই মানুষের জটলা। স্বাস্থ্যবিধি মানতে সরকারের উদ্যোগও তেমন চোখে পড়ছে না। সবকিছু এমন ঢিলেঢালা চললে ভবিষ্যতে কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে বলে আশঙ্কা স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের।
৪ মে করোনায় মৃত্যুর মিছিল আর একটু দীর্ঘ ছিলো। সেদিন মারা গেছেন ৬১ জন। দেড় মাস পর বুধবার মৃত্যু হয় ৬০ জনের। আগের দিন মারা যান ৫০ জন। এ নিয়ে দেশে করোনায় মোট মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৩ হাজার ২৮২। ২৪ ঘণ্টায় পরীক্ষা বিবেচনায় সংক্রমণের হার ১৬ দশমিক ৬২ শতাংশ। এদিন নতুন করে ৩ হাজার ৯৫৬ জনের দেহে করোনা সংক্রমণ ধরা পড়েছে। যা ২ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ। ২২ এপ্রিল এরচেয়ে বেশি ৪ হাজার ১৪ জনের মধ্যে সংক্রমণ ধরা পড়েছিলো। মঙ্গলবার করোনা শনাক্ত হয়েছিলো ৩ হাজার ৩১৯ জন। সবমিলিয়ে দেশে শনাক্ত রোগীর সংখ্যা ৮ লাখ ৩৭ হাজার ২৪৭। সরকারি হিসাবে আক্রান্তদের মধ্যে ২৪ ঘণ্টায় আরও ২ হাজার ৬৭৯ জন সুস্থ হয়ে উঠেছেন। এ পর্যন্ত সুস্থ হয়েছেন ৭ লাখ ৭৩ হাজার ৭৫২ জন।
বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের প্রথম সংক্রমণ ধরা পড়েছিলো গত বছর ৮ মার্চ। তা ৮ লাখ পেরিয়ে যায় এ বছর ৩১ মে। সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউয়ের মধ্যে ৭ এপ্রিল রেকর্ড ৭ হাজার ৬২৬ জন নতুন রোগী শনাক্ত হন। প্রথম রোগী শনাক্তের ১০ দিন পর গত বছরের ১৮ মার্চ দেশে প্রথম মৃত্যুর তথ্য নিশ্চিত করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এ বছর ১১ মে তা ১২ হাজার ছাড়িয়ে যায়। এর মধ্যে ১৯ এপ্রিল রেকর্ড ১১২ জনের মৃত্যু হয়। বুধবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, ২৪ ঘণ্টায় সারা দেশে ৫১৩টি ল্যাবে ২৩ হাজার ৮০৭টি নমুনা পরীক্ষা হয়েছে। এ পর্যন্ত পরীক্ষা হয়েছে ৬২ লাখ ৪২ হাজার ৭৮৬টি নমুনা। এর মধ্যে সরকারি ব্যবস্থাপনায় নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে ৪৫ লাখ ৫৫ হাজার ৩০৭টি আর বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় ১৬ লাখ ৮৭ হাজার ৪৭৯টি। ২৪ ঘণ্টায় নমুনা পরীক্ষার বিবেচনায় শনাক্তের হার ১৬ দশমিক ৬২ শতাংশ, এ পর্যন্ত মোট শনাক্তের হার ১৩ দশমিক ৪১ শতাংশ। শনাক্ত বিবেচনায় সুস্থতার হার ৯২ দশমিক ৪২ শতাংশ এবং মৃত্যুর হার ১ দশমিক ৫৯ শতাংশ। এক দিনে যারা মারা গেছেন, তাদের ৩৬ জন পুরুষ আর নারী ২৪ জন। তাদের ৪৬ জন সরকারি হাসপাতালে, নয়জন বেসরকারি হাসপাতালে এবং পাঁচজন বাসায় মারা গেছেন। তাদের মধ্যে ২৩ জনের বয়স ছিলো ৬০ বছরের বেশি, ১৬ জনের বয়স ৫১ থেকে ৬০ বছরের মধ্যে, ১০ জনের বয়স ৪১ থেকে ৫০ বছর, সাতজনের বয়স ৩১ থেকে ৪০ বছর, একজনের ২১ থেকে ৩০ বছর এবং তিনজনের বয়স ১১ থেকে ২০ বছরের মধ্যে। মৃতদের মধ্যে আটজন ঢাকা বিভাগের, আটজন চট্টগ্রাম বিভাগের, ১৭ জন রাজশাহী বিভাগের, ১৪ জন খুলনা বিভাগের, ছয়জন সিলেট বিভাগের, চারজন রংপুর বিভাগের এবং তিনজন ময়মনসিংহ বিভাগের বাসিন্দা ছিলেন। এ পর্যন্ত মৃত ১৩ হাজার ২৮২ জনের মধ্যে ৯ হাজার ৫৪৩ জন পুরুষ এবং ৩ হাজার ৭৩৯ জন নারী।
লকডাউনের মেয়াদ বাড়ল ১ মাস, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের আদেশ জারি: ছয় শর্তে ১৬ জুন মধ্যরাত থেকে ১৫ জুলাই মধ্যরাত পর্যন্ত বিধিনিষেধের (লকডাউন) মেয়াদ বৃদ্ধি করা হয়েছে। এ সময়ের মধ্যে স্বাস্থ্যবিধি মেনে সব অফিস, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান খোলা থাকবে। ব্যাংক লেনদেনের সময় আরও আধা ঘণ্টা বাড়ানো হয়েছে। এতে সকাল ১০ থেকে বেলা সাড়ে ৩টা পর্যন্ত লেনদেন চলবে ব্যাংকে। তবে অভ্যন্তরীণ কাজের সমন্বয়ের জন্য ব্যাংকগুলো বিকেল ৫টা পর্যন্ত খোলা থাকবে। বুধবার বিধিনিষেধ সংক্রান্ত আদেশ জারি করেছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ।
এতে বলা হয়, ছয় শর্তে বিধিনিষেধ দেয়া হলো- ১. কোভিড-১৯ এর উচ্চ ঝুঁকিসম্পন্ন জেলার জেলা প্রশাসকরা (ডিসি) সংশ্লিষ্ট কারিগরি কমিটির সঙ্গে আলোচনা করে নিজ নিজ এলাকায় সংক্রমণ প্রতিরোধে বিধি মোতাবেক লকডাউনসহ কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবেন। ২. সব সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও বেসরকারি অফিস, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান স্বাস্থ্যবিধি মেনে খোলা থাকবে। ৩. সব পর্যটনকেন্দ্র, রিসোর্ট, কমিউনিটি সেন্টার ও বিনোদনকেন্দ্র বন্ধ থাকবে। ৪. জনসমাবেশ হয় এ ধরনের সামাজিক (বিবাহোত্তর অনুষ্ঠান/ওয়ালিমা, জন্মদিন, পিকনিক, পার্টি ইত্যাদি), রাজনৈতিক ও ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান বন্ধ রাখতে হবে। ৫. আবাসিক হোটেল, রেস্তোরাঁ ও খাবারের দোকানগুলো সকাল ৬টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত খাদ্য বিক্রয়/সরবরাহ (টেকওয়ে/অনলাইন) করতে পারবে এবং আসন সংখ্যার অর্ধেক সেবাগ্রহীতাকে সেবা দিতে পারবে। এবং ৬. সব ধরনের গণপরিবহণ যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি প্রতিপালন সাপেক্ষে ধারণক্ষমতার অর্ধেক যাত্রী নিয়ে চলাচলের বিষয়টি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ নিশ্চিত করবে।
করোনার সংক্রমণ উদ্বেগজনক হারে বাড়তে থাকায় চলতি বছরের ৫ এপ্রিল সকাল ৬টা থেকে লকডাউন শুরু হয়। সেই শিথিল লকডাউন ছিলো অনেকটাই অকার্যকর। পরে ১৪ এপ্রিল ভোর ৬টা থেকে ৮ দিনের কঠোর লকডাউন দেওয়া হয়। পরে সাত দফায় নানা শর্ত দিয়ে চলাচলে বিধিনিষেধের মেয়াদ বাড়ানো হয়। সর্বশেষ ৬ জুন বিধিনিষেধের মেয়াদ আরও ১০ দিন বাড়িয়ে আদেশ জারি করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। সেই মেয়াদ শেষ হয় বুধবার মধ্য রাতে। এর আগে বন্ধ থাকলেও সর্বশেষ ২৩ মে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে বিধিনিষেধ বাড়ানোর প্রজ্ঞাপনে স্বাস্থ্যবিধি মেনে আন্তঃজেলা বাস, লঞ্চ এবং ট্রেনসহ সব ধরনের গণপরিবহণ চলার অনুমতি দেয়া হয়। একই সঙ্গে হোটেল-রেস্তোরাঁগুলো আসন সংখ্যার অর্ধেক মানুষকে সেবা দেয়ার অনুমতি পায়। জেলার মধ্যে গণপরিবহণ আগে থেকেই চালু ছিলো। এছাড়া লকডাউনে আগে থেকেই স্বাস্থ্যবিধি মেনে দোকান ও শপিংমল সকাল ১০টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত খোলা ছিলো। খোলা ছিলো শিল্প-কারখানা। এছাড়া জরুরি সেবা দেয়া প্রতিষ্ঠানগুলো যথারীতি সীমিত পরিসরে চলছিলো।