স্টাফ রিপোর্টার: চলতি মাসের শুরুতে দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বাড়ার সময় দিনে সর্বোচ্চ ২০০ থেকে ২২০ টন পর্যন্ত অক্সিজেন সরবরাহ করা হতো। এর মধ্যে ১০০ টন আসত পাশের দেশ ভারত থেকে। বাকিটা দেশেই উৎপাদিত হয়েছে। ২১ এপ্রিলের পর ভারত থেকে অক্সিজেন আমদানি বন্ধ হয়ে গেছে। তাই দেশে অক্সিজেনের সরবরাহ কমেছে। তবে স্বস্তির বিষয় হচ্ছে, করোনা রোগী কমে আসায় অক্সিজেনের চাহিদাও কমে গেছে। কিন্তু রোগী বাড়লে বড় বিপদের শঙ্কা আছে। স্বাস্থ্য অধিদফতর ও সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে অক্সিজেন সরবরাহকারী কোম্পানিগুলোর দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে এটি জানা গেছে। তারা বলছেন, প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে করোনার সংক্রমণ নিম্নমুখী। তাই অক্সিজেনের চাহিদা কমেছে। এছাড়া শিল্প অক্সিজেন তৈরি কমিয়ে মেডিকেল অক্সিজেন তৈরি করা হচ্ছে। এতে আপাতত সংকট এড়ানো গেছে।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, করোনার সংক্রমণের আগে দেশের স্বাস্থ্য খাতে অক্সিজেনের চাহিদা ছিলো দিনে ১০০ থেকে ১২০ টন। ওই সময় আমদানির প্রয়োজন হতো না। করোনার সংক্রমণ শুরু হলে চাহিদা বাড়তে থাকে। শুরু হয় ভারত থেকে আমদানি। চলতি এপ্রিলের শুরুতে দিনে চাহিদা সর্বোচ্চ ২০০ থেকে ২২০ টনে পৌঁছায়। এখন এটি কমে ১৪০ থেকে ১৫০ টনে দাঁড়িয়েছে। এখন পর্যন্ত সরবরাহে ঘাটতি তৈরি হয়নি।
জানা গেছে, দেশের সব সরকারি হাসপাতালে অক্সিজেন সরবরাহ করে বহুজাতিক কোম্পানি লিন্ডে ও দেশীয় কোম্পানি স্পেকট্রা। বেসরকারি হাসপাতালেও তারা সরবরাহ করে। আর শুধু বেসরকারি হাসপাতালে বড় সরবরাহকারী হিসেবে কাজ করছে ইসলাম অক্সিজেন। তিনটি প্রতিষ্ঠান সর্বোচ্চ উৎপাদনের চেষ্টায় দিন-রাত কারখানা চালিয়ে যাচ্ছে। এর বাইরে নতুন করে শিল্প অক্সিজেন তৈরির প্রতিষ্ঠান এ কে অক্সিজেন, ইউনিয়ন অক্সিজেন ও আবুল খায়ের স্টিল মেল্টিং মিল থেকে মেডিকেল অক্সিজেন তৈরির সাময়িক অনুমোদন দেয়া হয়েছে। এরা কিছু কিছু করে অক্সিজেন সরবরাহ করছে বলে জানা গেছে। লিন্ডের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানান, তাদের দুটি কারখানায় উৎপাদন সক্ষমতা দিনে ৯০ টন। চাহিদা বাড়ার পর ভারতে অবস্থিত লিন্ডের কারখানা থেকে তারা অক্সিজেন এনেছেন। দিনে সর্বোচ্চ ৩০ থেকে ৪০ টন পর্যন্ত আমদানি করেছে এ কোম্পানি। সব মিলিয়ে দিনে ১১০ থেকে ১২০ টন পর্যন্ত সরবরাহ করেছেন তারা। আমদানি করা তরল অক্সিজেন এখনো মজুত আছে তাদের কাছে। তাই এখন দিনে ৯০ টনের কিছু বেশি সরবরাহ করছে লিন্ডে। সরকারি নির্দেশে শিল্পে সরবরাহ বন্ধ রেখেছেন তারা। স্পেকট্রা অক্সিজেনের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা জানান, সর্বোচ্চ চাহিদার সময় দিনে ৫০ টনের বেশিও সরবরাহ করেছেন তারা। আমদানি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এখন দিনে ২০ টনের মতো সরবরাহ করছেন। তবে নতুন একটি কারখানায় উৎপাদনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন তারা। জুনের শেষ দিকে এটি চালু হলে দিনে আরও ৩০ টন অক্সিজেন উৎপাদন করতে পারবে স্পেকট্রা। দিনে ৪০ টনের মতো অক্সিজেন উৎপাদনের সক্ষমতা আছে ইসলাম অক্সিজেন কোম্পানির। কিন্তু বিদ্যুতের লোডশেডিংয়ের কারণে ৩০ টন উৎপাদন করতে পারে তারা। তারাও ভারত থেকে আমদানি করে দিনে ৫০ টনের মতো সরবরাহ করেছে। ২০ টন আমদানি বন্ধ হয়ে গেছে। এখন ৩০ টন দিচ্ছে প্রতিদিন। কারখানা সম্প্রসারণের জন ব্যাংকের কাছে অর্থায়ন চেয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।
এ বিষয়ে ইসলাম অক্সিজেন কোম্পানির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মুস্তাইন বিল্লাহ বলেন, কারখানাগুলোকে শতভাগ উৎপাদনে থাকার প্রতিবন্ধকতা দূর করতে হবে। গ্যাস সংযোগ পেলে নিজেরা বিদ্যুত উৎপাদন করে ২৪ ঘণ্টা কারখানা সচল রাখা যায়। আর কম সুদে ঋণ দিয়ে কারখানা সম্প্রসারণের ব্যবস্থা করে দিতে পারে সরকার। দেশের তিনটি বড় অক্সিজেন সরবরাহাকারী প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা জানান, ভাগ্য খুবই ভালো। সংক্রমণ কমার মধ্যে অক্সিজেন আমদানি বন্ধ হয়েছে। ভারতের সংক্রমণ পরিস্থিতি খুব খারাপ। বিভিন্ন দেশ থেকে এখন অক্সিজেন নিচ্ছে দেশটি। তারা বলেন, দেশের প্রথম সারির একটি বেসরকারি হাসপাতালে দিনে গড়ে সাড়ে তিন টন অক্সিজেন লাগে। তাই দেশে উৎপাদন বাড়ানো দরকার। তিনটি প্রতিষ্ঠান চরম চাপের মধ্যে কাজ করছে। কোনো একটি কারখানা বন্ধ হয়ে গেলেই সরবরাহে ঘাটতি তৈরি হতে পারে।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক (হাসপাতাল) ফরিদ হোসেন মিয়া বলেন, কোথাও অক্সিজেনের ঘাটতি নেই, সরবরাহ নিয়ে কোনো অভিযোগও আসেনি। রোগীর চাপ কমায় অক্সিজেনের চাহিদাও কমেছে। এছাড়া ভবিষ্যতের চিন্তা মাথায় রেখে খুব শিগগির শিল্প অক্সিজেন তৈরির কারখানার সঙ্গে বসে কর্মপরিকল্পনা চূড়ান্ত করা হবে।
স্বাস্থ্য অধিদফতর বলছে, দেশে তরল অক্সিজেন উৎপাদনের ঘাটতি থাকলেও গ্যাসীয় অক্সিজেনের ঘাটতি নেই। ভারত থেকে তরল অক্সিজেন আমদানি করা হতো। এটি হাসপাতালের বড় ট্যাংক থেকে পাইপলাইনের মাধ্যমে সরবরাহ করা হয়। আর গ্যাসীয় অক্সিজেন সিলিন্ডারে সরবরাহ করা হয়। বিশেষ পরিস্থিতিতে সিলিন্ডারে করে সংকট মেটানো যাবে বলে মনে করছে স্বাস্থ্য অধিদফতর।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানান, সংক্রমণ কমার ধরন পুরোপুরি সঠিক চিত্র দেয় না। কঠোর বিধিনিষেধের কারণে এটি দেখা গেছে। মানুষ এখন আবার রাস্তায় নামছে। সামনে সংক্রমণ আগের চেয়ে দ্বিগুণ হতে পারে। আগে থেকেই প্রস্তুতি নেয়া দরকার।
এ বিষয়ে রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক বে-নজির আহমেদ বলেন, শেষ মুহূর্তে চাইলেই অক্সিজেন পাওয়া যাবে না। তাই এখন থেকেই সংক্রমণ পরিস্থিতির প্রক্ষেপণ ও অক্সিজেনের উৎপাদন মূল্যায়ন করে কর্মকৌশল তৈরি করা উচিত। দেশে উৎপাদন বাড়াতে না পারলে ভারতের বিকল্প বাজার খুঁজে দেখা প্রয়োজন।