স্টাফ রিপোর্টার: আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে রাজনীতিতে ছড়াচ্ছে উত্তাপ। মাঠের বিরোধী দল বিএনপি মাঠ চষে বেড়ালেও এখনো একরকম ‘ঘরবন্দি’ ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। কেন্দ্রীয় নেতা-মন্ত্রীরা সংবাদ সম্মেলন, বিবৃতি কিংবা ভার্চুয়ালি অংশ নিচ্ছেন ঘরোয়া নানা কর্মসূচিতে। বিএনপিকে নানা হুমকি-ধামকি দিলেও পালটা বড় কর্মসূচি নেই দলটির। তাদের মনোযোগ এখন জাতীয় নির্বাচন ও সম্মেলন সামনে রেখে তৃণমূল পর্যন্ত দলকে ঢেলে সাজানোয়। এ লক্ষ্যে গতি বাড়ছে জেলা-উপজেলা-থানা সম্মেলনে। সেখানে কেন্দ্রীয় নেতারা ভার্চুয়ালি বা সরাসরি অংশ নিচ্ছেন। এতে স্থানীয় নেতাকর্মীরা উজ্জীবিত হচ্ছেন। ভোটের আগে তৃণমূলকে চাঙা করতে সব কর্মসূচিতে কেন্দ্রীয় নেতাদের উপস্থিতি আরও বাড়ানো উচিত বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
দুদলের রাজনৈতিক কর্মকা- পর্যালোচনা করে দেখা যায়, বিএনপি জোরালোভাবে মাঠের আন্দোলনে নামলেও আওয়ামী লীগকে এখন পর্যন্ত সেভাবে কোনো কর্মসূচি পালন করতে দেখা যাচ্ছে না। সবশেষ ১৭ আগস্ট সিরিজ বোমা হামলা দিবস উপলক্ষ্যে রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটের সামনে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ আওয়ামী লীগের উদ্যোগে বিক্ষোভ-সমাবেশের আয়োজন করা হয়েছিল। সেদিন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা ‘মাঠে নামার’ ঘোষণাও দিয়েছিলেন। তারা বলেছিলেন, ‘অগ্নিসন্ত্রাসীরা মাঠে নেমেছে। আমরাও আজ থেকে মাঠে নামলাম। কাউকে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টির সুযোগ দেওয়া হবে না।’ দলীয় নেতাকর্মীদের প্রস্তুত হওয়ার আহ্বান জানিয়ে কেন্দ্রীয় নেতারা বলেছিলেন, ‘আপনারা প্রস্তুত তো? খেলা হবে, রাজপথে, আন্দোলনে, নির্বাচনে।’
এরপর কেন্দ্রীয়ভাবে আর বড় কোনো কর্মসূচি হাতে নিতে দেখা যায়নি ক্ষমতাসীনদের। এই সময়ে বিএনপি নেতারা ঢাকা ও ঢাকার বাইরে নানা ইস্যুতে লাগাতার কর্মসূচি নিয়ে মাঠে থাকলেও আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা এবং মন্ত্রিপরিষদ সদস্যরা প্রতিদিনই কথা বলেছেন দলের তৃণমূল সম্মেলন বা ঘরোরা নানা অনুষ্ঠানে। পাশাপাশি দলীয় কার্যালয় বা সেমিনার হলে অংশ নিয়েছেন দিবসভিত্তিক নানা কর্মসূচিতে। নিজ বাসা-অফিসে বসেও করেছেন সংবাদ সম্মেলন। গণমাধ্যমে দিচ্ছেন নানা বক্তব্য-বিবৃতি। ভার্চুয়ালি যোগ দিচ্ছেন ঢাকা বা ঢাকার বাইরের নানা অনুষ্ঠানে। আওয়ামী লীগ নেতারা বলছেন, জাতীয় নির্বাচনের এখনো এক বছরের বেশি সময় বাকি আছে। তাছাড়া বিএনপি এখন যেসব কর্মসূচি পালন করছে, তা তাদের চূড়ান্ত কর্মসূচিও নয়। ফলে এখন পালটা কর্মসূচি দিয়ে পরিস্থিতি উত্তপ্ত করা ঠিক হবে না। তবে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে রাখা হচ্ছে। বিএনপি চূড়ান্ত আন্দোলনে গেলে বা ‘সহিংস কর্মকান্ড’ শুরু করলে তখন মাঠে পালটা কর্মসূচি দেওয়া হবে। তার আগ পর্যন্ত সারা দেশের নেতাকর্মীদের সতর্ক অবস্থানে থাকার আহ্বান জানাচ্ছে দলটি। পাশাপাশি এই সময়ের মধ্যে তৃণমূল পর্যন্ত আওয়ামী লীগ এবং সহযোগী সংগঠনকে ঢেলে সাজানোর কাজও শেষ করতে চান তারা। দলকে শক্তিশালী করে বিএনপির আন্দোলন মোকাবেলা এবং জাতীয় নির্বাচনের প্রস্তুতি এগিয়ে রাখতে চাইছে ক্ষমতাসীনরা।
জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বলেন, বিএনপির একমাত্র লক্ষ্য দেশের আইনশৃঙ্খলার পরিস্থিতির অবনতি ঘটানো। সেই অসৎ উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতে তারা নানা গল্প, রচনা করতেই পারে। আওয়ামী লীগের আন্দোলনের পাশাপাশি যে কোনো দেশবিরোধী কর্মকা- থেকে মানুষকে রক্ষা করতেও প্রস্তুতি থাকে। তিনি আরও বলেন, বিএনপির ফাঁদে আমরা পা দিতে চাই না। তবে যদি মানুষের ওপর হামলা হয়, অতীতের মতো জ্বালাও-পোড়াও শুরু করে, তখন আমাদের জনগণের পাশে দাঁড়াতে হবে। জনগণকে নিয়ে খেলতে চাইলে, তাদেরকে (জনগণ) ফাঁদে ফেলে স্বাভাবিক জীবনযাত্রাকে ব্যাহত করে রাজনৈতিক ফায়দা লুটতে চাইলে, সেটা কি আমরা মেনে নেব? সহ্য করব? জনস্বার্থেই তাদের রুখতে হবে।
বিএনপিকে মোকাবেলায় আপাতত কর্মসূচি না দিলেও জাতীয় সম্মেলন সামনে রেখে আওয়ামী লীগের কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত কাজের ব্যস্ততা বেড়েছে। ডিসেম্বরের মধ্যে তৃণমূল পর্যন্ত দল ঢেলে সাজানোর কাজ করছেন দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা। চলছে জেলা, উপজেলা, পৌর এবং ওয়ার্ড-ইউনিয়েনের সম্মেলনে। ঘোষণা হচ্ছে পূর্ণাঙ্গ কমিটিও। ভেতরে ভেতরে কাজ চলছে গঠনতন্ত্র ও ঘোষণাপত্র সংশোধনের। মেয়াদোত্তীর্ণ সহযোগী ও ভাতৃপ্রতিম সংগঠনগুলোর সম্মেলনের প্রক্রিয়াও শুরু হয়েছে। অন্যদিকে সম্মেলন সামনে রেখে নেতা-কর্মীরা দলীয় কার্যক্রমে তৎপরতা বাড়িয়েছেন। সব মিলিয়ে ঘর গোছানোর কাজেই আপাতত মনোযোগী আওয়ামী লীগ।
জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এস এম কামাল হোসেন বলেন, আমরা ঘরে বসে নেই। আমাদের সাংগঠনিক কর্মকা- চলমান আছে। নেত্রীর (আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা) নির্দেশে আমরা তৃণমূল পর্যন্ত সংগঠনকে ঢেলে সাজাচ্ছি। এর মধ্য দিয়ে সংগঠনকে শক্তিশালী এবং নেতাকর্মীদের উজ্জীবিত ও ঐক্যবদ্ধ করে আমরা জাতীয় সম্মেলন ও নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছি। বিএনপির আন্দোলনে জনগণের সম্পৃক্ততা নেই। তারা সব সময় ষড়যন্ত্র এবং সন্ত্রাস-নৈরাজ্যের পথে হাঁটে। এবারও আন্দোলনের নামে সন্ত্রাস-নৈরাজ্য করলে জনগণই তাদের প্রতিহত করবে।
এদিকে ক্ষমতাসীনরা রাজপথে পুরোপুরি সক্রিয় না থাকলেও সরকারবিরোধী আন্দোলন কেন্দ্র করে মাঠে রয়েছে বিএনপি। নানা কর্মসূচি নিয়ে নেতাকর্মীরা রাজপথে। তৃণমূল ও রাজধানী ঢাকায় বিক্ষোভের পর এখন বিভাগীয় গণসমাবেশ করছে দলটি। এসব কর্মসূচিতে দলের কেন্দ্রীয় থেকে তৃণমূলের সব স্তরের নেতাকর্মী অংশ নিচ্ছেন।
জ্বালানি তেলসহ নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি, নেতাকর্মীদের হামলা ও হত্যার প্রতিবাদ, তত্ত্বাবধায়ক সরকারসহ বেশ কিছু দাবিতে মাঠে রয়েছে বিএনপি। ২২ আগস্ট থেকে তৃণমূলে ধারাবাহিক কর্মসূচি পালন করে। অনেক জায়গায় হামলা-নির্যাতন হলেও কর্মসূচি থেকে পিছু হটেনি দলটি। যেসব এলাকায় বাধা দেওয়া হয়েছে পরে সেখানে ফের কর্মসূচি পালন করে।
তৃণমূল ও রাজধানীর কর্মসূচি শেষ হওয়ার পর বিভাগীয় শহরে সমাবেশের ঘোষণা দেয় বিএনপি। ১০টি বিভাগে গণসমাবেশ কর্মসূচি পালন করছে দলটি। ইতোমধ্যে চট্টগ্রাম ও ময়মনসিংহ বিভাগে এ কর্মসূচি পালন করা হয়েছে। বিভাগীয় গণসমাবেশে ব্যাপক লোকসমাগম হওয়ায় দলে একটা চাঙ্গাভাব তৈরি হয়েছে। নানা বাধা উপেক্ষা করে নেতাকর্মীরা কর্মসূচিতে অংশ নিচ্ছেন।
জানা গেছে, বিভাগীয় সমাবেশ শেষ হওয়ার পর মাঠ দখলে আরও সক্রিয় হবে বিএনপি। সরকার পতনের এক দফা দাবিতে ঘোষণা করা হতে পারে নতুন কর্মসূচি। মাঠ পর্যায়ের নেতাকর্মীদের এমন বার্তা দেওয়া হচ্ছে। কেন্দ্রের বার্তা পেয়ে যেকোনো কর্মসূচি পালনে প্রস্তুতি নিচ্ছে তৃণমূল।
জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, সরকার পতনের আন্দোলনে নেতাকর্মীরা রাজপথে নেমে এসেছে। বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষও এতে অংশ নিচ্ছেন। দিন যত যাচ্ছে বিএনপির কর্মসূচিতে নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষের উপস্থিতি তত বাড়ছে। তিনি বলেন, এ সরকারের পতন না হওয়া পর্যন্ত নেতাকর্মীরা ঘরে ফিরে যাবে না। যত বাধাই আসুক, গণআন্দোলনের মাধ্যমে সরকারের পতন নিশ্চিত করেই এবার ঘরে ফিরবো।