স্টাফ রিপোর্টার: গাজীপুরে শান্তিপূর্ণ ভোটের পর কিছুটা ছন্দপতন হয়েছে বরিশালে। এ সিটির ভোটে দিনভর নানা অনিয়মের অভিযোগ আসার পাশাপাশি প্রার্থী ও তার কর্মী-সমর্থকের ওপর হামলা, মারধরের ঘটনাও ঘটেছে। যদিও নির্বাচন কমিশন এসব ঘটনাকে বিচ্ছিন্ন উল্লেখ করে জানিয়েছেন, নির্বাচন সুষ্ঠু এবং শান্তিপূর্ণ হয়েছে। সকাল থেকেই ভোটের মাঠে আওয়ামী লীগের প্রার্থীর কর্মী-সমর্থকদের আধিপত্য দেখা যায় ভোটকেন্দ্রে। কিছু কিছু কেন্দ্রে এজেন্টদের প্রবেশ করতে দেয়া হয়নি বলে অভিযোগ করেন প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরা। আওয়ামী লীগের প্রার্থীর মূল প্রতিদ্বন্দ্বী ইসলামী আন্দোলনের প্রার্থী সৈয়দ মুহাম্মদ ফয়জুল করীম একটি ভোটকেন্দ্রে গিয়ে হামলার শিকার হন। হামলার পর তাকে রক্তাক্ত অবস্থায় দেখা যায়। বিভিন্ন কেন্দ্রে কর্মী-সমর্থকদের ঘেঁষতে দেয়া হয়নি বলে অভিযোগ করেন হাতপাখার প্রার্থী। হামলা ও ভোটে অনিয়মের অভিযোগ তুলে বিকেলেই বরিশাল এবং খুলনার ভোটের ফল প্রত্যাখ্যান করে ইসলামী আন্দোলন। দলের আমীর মুফতি রেজাউল করীম বরিশালে সংবাদ সম্মেলনে ফল প্রত্যাখ্যান করে বলেন, রাজশাহী ও সিলেটের নির্বাচনও বয়কট করবেন তার দলের প্রার্থীরা। হামলার ঘটনার প্রতিবাদে শুক্রবার জেলা ও মহানগরে বিক্ষোভ কর্মসূচিরও ঘোষণা দেন ইসলামী আন্দোলনের আমীর। গতকাল সোমবার ভোট চলাকালীন অবস্থায় কমপক্ষে ১০টি কেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায় বিশৃঙ্খল পরিবেশ। এসব ভোটকেন্দ্রে প্রকাশ্যে ঘোষণা দেয়া হয়, মেয়রের ভোট একটি প্রতীকে দিতে হবে। প্রতিটি কেন্দ্রের বাইরে অবস্থান নেন নৌকার সমর্থকরা। দাঁড়াতেই দেননি হাতপাখার কর্মীদের। বিভিন্ন স্থানে হাতপাখার প্রার্থীর লোকজন সরতে না চাইলে হাতাহাতির ঘটনা ঘটে। আর ইভিএমে হওয়া অন্যান্য নির্বাচনের মতো এই নির্বাচনেও ছিলো ধীরগতি ভোগান্তি। সব কেন্দ্রে মেলেনি হাতপাখার এজেন্ট। তারা অভিযোগ করেন, অনেক কেন্দ্র থেকে হুমকি দিয়ে বের করে দেয়া হয় তাদের। আওয়ামী লীগের প্রার্থী আবুল খায়ের আব্দুল্লাহ সকালে নিজের ভোট দেয়ার পর নির্বাচন শান্তিপূর্ণ হচ্ছে উল্লেখ করে নিজের জয়ের ব্যাপারে আশাবাদ ব্যক্ত করেন। বিকেলে তার প্রধান নির্বাচনী সমন্বয়ক প্রশ্ন তোলেন চরমোনাই’র পীরের সমর্থক, হাতপাখার কর্মীরা কীভাবে লাঠি ও রামদা নিয়ে বরিশালে প্রবেশ করলো। সকালেই ভোট প্রদান করেন হাতপাখা প্রতীকের প্রার্থী সৈয়দ মুহাম্মদ ফয়জুল করীম। জয়ের ব্যাপারে শতভাগ আশাবাদী হওয়ার কথা জানান। বলেন, প্রথম ৩০ মিনিটের ভোটের পরিবেশে আমরা সন্তুষ্ট। তিনি বলেন, আমি জয়ের বিষয়ে শতভাগ আশাবাদী। বরিশালবাসী ভোটদানের জন্য উন্মুখ হয়ে আছে। কিন্তু ইভিএমে যেহেতু ভোট সেহেতু কি হয় বলা যায় না। ক্যালকুলেটরে যেমন ৪+৪ দিলে ৮ হয়। সেভাবে সেট করা থাকে। ইভিএমে যেন ৪+৪= ৯ না হয়। ভোট কারচুপি হলে আমরা আন্দোলন করবো, আদালতে যাবো। ভোট প্রদান করে কর্মী-সমর্থকদের নিয়ে চলে যান তিনি। সকাল থেকেই বরিশালে ভোট নিয়ে উৎসবমুখর পরিবেশ ছিল। ভোটাররা বড় লাইনে দাঁড়িয়ে ভোট দেন। কিন্তু এরপর বিভিন্ন স্থানের পরিস্থিতি খারাপ হতে থাকায় বদলে যায় দৃশ্যপট। কাশিপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রের বাইরে থাকা ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের কর্মীরা অভিযোগ করেন তাদের দাঁড়াতে দিচ্ছে না আওয়ামী লীগের কর্মীরা। হাতপাখার কর্মী মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, আমরা দাঁড়ালেই সরিয়ে দিচ্ছে। ওরা আট-দশজন গেটের সামনে সবসময় দাঁড়িয়ে আছে। আশেপাশে আছে আরও কয়েকজন। আমরা গেটের সামনে গেলেই তাড়িয়ে দিচ্ছে। তিনি আরও বলেন, পুলিশকে জানালেও কোনো কাজ হচ্ছে না। গেটের সামনে নৌকার আইডি কার্ড বুকে ঝুলিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা আলী হোসেন বলেন, আমরা কেন বাধা দেবো? এই কথা বলার সময় হাতপাখার কর্মীরা এলে পেছনে থাকা কর্মীরা হইচই করে তাদের তাড়িয়ে দেন। এ সময় বলতে শোনা যায় এই সাংবাদিক আছে, এখন থাক। দায়িত্বরত পুলিশ সদস্য এ সময় বলেন, এমন কোনো অভিযোগ আমরা পাই নাই। অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেবো। এই কেন্দ্রে অবস্থান করার সময় ব্যাপক বিশৃঙ্খল পরিবেশ লক্ষ্য করা যায়। বেলা ১১টার দিকে ভোট দিতে লাইনে দাঁড়িয়ে ছিলেন সেলিনা ইয়াসমিন। এমন সময় পুলিশের সামনে নৌকার আইডি কার্ডধারী কর্মী মো. তৌফিক হুমকি দিয়ে যান সেলিনা ইয়াসমিনকে। বলেন, বাইর হ’, তোর শনি আমি ছুটামু। জানতে চাইলে সেলিনা বলেন, আমি ভোট দেয়ার জন্য দাঁড়াইছি। আমাকে এসে শাসিয়ে গেল। বলে আমি নাকি টাকা দিচ্ছি। আমি দাঁড়িয়েছি ভোট দেয়ার জন্য। এই ভোটারকে শাসানো মো. তৌফিকের কাছে জানতে চাইলে বলেন, উনি সবার পকেটে টাকা দিয়ে বলতেছে হাতপাখায় ভোট দেন। তিনি বলেন, আপনারা যে সংস্থার লোক হন না কেন, নৌকার বিরুদ্ধে কাজ করলে আমরা মানবো না। বেলা ১২টার দিকে দরগাবাড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে বেধড়ক পিটিয়ে হাতপাখার কর্মী-সমর্থকদের কেন্দ্র ছাড়া করেন নৌকার সমর্থকরা। মারমুখী ভূমিকায় থাকা অবস্থায় পাশেই ছিলেন ম্যাজিস্ট্রেট। কেন্দ্রটিতে ভোটাররা দীর্ঘ লাইন দিয়ে ভোটের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। ছিলো তীব্র রোদ। এ সময় হাতপাখার এক সমর্থক ভিডিও করছিলেন। নৌকার আইডি কার্ড ঝুলানো কয়েকজন এগিয়ে গিয়ে বলেন, এ তুই ভিডিও করিস কেন? তোর এখানে কি, তুই এখানে কি করিস? বলেই হামলা শুরু করেন। মারতে থাকেন কিল-ঘুষি। তার সঙ্গে থাকা অন্যরা এগিয়ে এলে তাদেরকেও আঘাত করা হয়। এরপর নৌকার ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কর্মীরা পেটাতে পেটাতে দূরে নিয়ে যান। তবে সেখানেই ছিলেন একাধিক পুলিশ সদস্য ও ম্যাজিস্ট্রেট। তারা ফিরে এসে বলতে থাকেন, আর কেউ জামায়াত-শিবির আছে এখানে। এরপর একটি গেটের ভেতরে হাতপাখার কর্মী-সমর্থকদের ওপর চড়াও হন তারা। পেটানো শেষে পুলিশ এসে পরিস্থিতি শান্ত করেন। সরিয়ে দেন সকলকে। হামলার সময় ছুটে আসেন দায়িত্বরত বিজিবি সদস্যরা। কিন্তু হাতপাখার কর্মী-সমর্থকরা অভিযোগ করেন বিজিবিকে অন্য রাস্তায় নিয়ে যান ম্যাজিস্ট্রেট। দুপুরে নগরীর সাবেরা খাতুন স্কুল কেন্দ্রে যান সৈয়দ ফয়জুল করীম। তিনি সেখানে আওয়ামী লীগের কর্মীদের জটলা নিয়ে কথা বলতে গেলে হামলার শিকার হন। হামলায় তার ঠোঁট ফেটে রক্তাক্ত হন। এই খবর ছড়িয়ে পড়ার পর বিভিন্ন প্রান্তে থাকা কর্মীরা উত্তপ্ত হয়ে ওঠেন। সেই কেন্দ্রটিতে গিয়ে দেখা যায় বিপুল সংখ্যক ইসলামী আন্দোলনের নেতাকর্মী। তারা ঘটনার বর্ণনায় বলেন, এই কেন্দ্রে হুজুর আসার পর তারা বলেছে কোন মার্কায় ভোট দেয়া যাবে না। শুধু ভোট দিতে হবে নৌকায়। হুজুর বলেছেন, কেন? তখনই তার ওপর হামলা করা হয়। তার মুখ দিয়ে রক্ত ঝরতে থাকে। এসময় তারা আরও অভিযোগ করেন, আমাদের অনেক সেন্টারেই হামলা করা হয়েছে, মারধর, প্রচারণা ক্যাম্প ভাঙচুর, ছিনতাই করা হয়। এই ঘটনার পর সেখানে আসেন বরিশাল পুলিশ কমিশনার সাইফুল ইসলাম। তিনি সে সময় রিটার্নিং কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলেন। সিসিটিভি ক্যামেরা পরীক্ষা করেন। একজন গণমাধ্যমকর্মীর অভিযোগের প্রেক্ষিতে জানান, কোন পুলিশ সদস্যের কোনো গাফিলতি থাকলে ব্যবস্থা নেয়া হবে। ভোট চলাকালেই ফয়জুল করীমের প্রধান নির্বাচনী ক্যাম্পে গিয়ে দেখা যায়, অসুস্থ হয়ে বিশ্রাম নিচ্ছেন তিনি। এ সময় তিনি বলেন, আপনারা সবাই জানেন কী রকম নির্বাচন হচ্ছে। আমরা শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে থাকবো। দেখতে চাই তারা কতো নিচে নামতে পারে। হামলার প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, প্রশাসন একেবারেই চুপ ছিল। একবার যেহেতু রাস্তায় রক্ত পড়েছে শেষ রক্ত পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাবো। আমরা এই নির্বাচনের পর সরকার পতনের শক্ত আন্দোলনে যাবো। সাগরদী এলাকার একটি ভোট কেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায়, দু’পক্ষের উত্তেজনা চলছে। সে সময় হাতপাখার কর্মী-সমর্থকরা জানান, একটি অটো রিকশাতে করে আমাদের কিছু ভোটার আসছিল। তাদের নামতে পর্যন্ত দেয় নাই। এই সময় আমাদের ধাওয়া দিয়ে সরিয়ে দেয়া হয়। এরপর কেন্দ্রের সামনে দাঁড়িয়ে নৌকার সমর্থনে স্লোগান দিতে থাকেন তারা। সে সময় একপাশে নৌকা ও আরেকপাশে হাতপাখার কর্মীদের দেখা যায়। বেলা তিনটার দিকে বরিশালে বৃষ্টি শুরু হয়। এরপর চরমোনাই থেকে বরিশালে ঢোকার একমাত্র সড়ক পথ স্থানীয় ভাষায় দফদপিয়া ব্রিজ দিয়ে আসতে শুরু করেন হাতপাখার সমর্থকরা। সেখানে গিয়ে দেখা যায় কয়েক হাজার নেতাকর্মী বিভিন্ন দোকানে অবস্থান নিয়েছেন। এছাড়া শহরে প্রবেশের আরও কয়েকটি স্থানে চরমোনাই পীরের সমর্থকদের অবস্থান করতে দেখা যায়। যদিও ভোটের ফল আসতে শুরু করার পর শহরের পরিস্থিতি শান্ত হয়ে আসে।