স্টাফ রিপোর্টার : দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলীয় মনোনয়নের জন্য চার দিনে ৩ হাজার ৩৬২টি ফরম বিক্রি করেছে আওয়ামী লীগ। এর মধ্যে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে প্রশাসনিক বিভাগ অনুযায়ী নির্ধারিত বুথ থেকে মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেছেন ৩ হাজার ২৪১ জন।
অনলাইনে কিনেছেন ১২১ জন। এতে ক্ষমতাসীন দলটির আয় হয়েছে ১৬ কোটি ৮১ লাখ টাকা। এর মধ্যে শেষদিন মঙ্গলবার ৩৪৫টি মনোনয়ন ফরম বিক্রি থেকে আয় হয় ১ কোটি ৭২ লাখ ৫০ হাজার টাকা। ৩০০ আসনের বিপরীতে প্রতিটিতে গড়ে ১১ জনের বেশি মনোনয়নপ্রত্যাশী রয়েছে ক্ষমতাসীন দলে। দলের নেতা-মন্ত্রী ছাড়াও শিক্ষাবিদ, আইনজীবী, সাংবাদিক, চলচ্চিত্র ও ক্রীড়াঙ্গনের জনপ্রিয় তারকাসহ বিভিন্ন পেশাজীবীরা আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন চেয়ে ফরম কিনেছেন।
আগামীকাল বৃহস্পতিবার থেকে দলীয় প্রার্থী বাছাই শুরু করবে আওয়ামী লীগ। ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের তেজগাঁও’র কার্যালয়ে মনোনয়ন বোর্ডের সভাপতি শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে বেলা ১১টা থেকে সভা শুরু হবে। সভার প্রথম দিনে রাজশাহী, রংপুর ও খুলনা বিভাগের সংসদীয় আসনগুলোর মনোনয়ন চূড়ান্ত করা হবে।
আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়ুয়া জানান, আগের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন বোর্ডের সভা দলটির সভাপতির ধানম-ি কার্যালয়ে এবং প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবনে অনুষ্ঠিত হতো। তবে এবার নির্বাচনকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণভবনে রাজনৈতিক কোনো কার্যক্রম করবেন না বলে ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে হবে মনোনয়ন বোর্ডের সভা।
এদিকে আয় বাড়লেও গত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের চেয়ে এবার আওয়ামী লীগের ৬৬১টি দলীয় মনোনয়ন ফরম কম বিক্রি হয়েছে। গত নির্বাচনে চার হাজার ২৩টি ফরম বিক্রি করেছিল আওয়ামী লীগ। ফরমের দাম ছিল ৩০ হাজার টাকা।
এতে মোট আয় হয়েছিল ১২ কোটি ৬ লাখ ৯০ হাজার টাকা। সারা দেশের ৩০০ আসনে প্রতিটির জন্য গত নির্বাচনে প্রায় ১৩ জন করে প্রার্থী ছিল। এর আগে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মোট দুই হাজার ৬০৮ জন আওয়ামী লীগের মনোনয়ন ফরম কিনেছিল। সেবার ফরমের দাম ছিল ২৫ হাজার টাকা। ফরম বিক্রি থেকে আওয়ামী লীগের তহবিলে জমা পড়েছিল প্রায় সাড়ে সাত কোটি টাকা।
শনিবার আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মনোনয়ন ফরম বিক্রি ও জমাদান কার্যক্রম উদ্বোধন করেন। প্রথম ফরমটি তিনিই সংগ্রহ করেন। প্রথম দিন এক হাজার ৭৪টি মনোনয়ন ফরম বিক্রি থেকে দলটির আয় হয় ৫ কোটি ৩৭ লাখ টাকা।
দ্বিতীয় দিনে এক হাজার ২১২টি মনোনয়ন ফরম বিক্রি হয়। এতে দলটির আয় হয় ৬ কোটি ৬ লাখ টাকা। তৃতীয় দিনে দলটি ৭৩৩টি মনোনয়ন ফরম বিক্রি করে।এতে আয় করে ৩ কোটি ৬৬ লাখ ৫০ হাজার টাকা। আর শেষদিন মঙ্গলবার ৩৪৫টি মনোনয়ন ফরম বিক্রি হয়। সব মিলে চার দিনে ৩৩৬২ ফরম বিক্রি করে আওয়ামী লীগের আয় হয় ১৬ কোটি ৮১ লাখ টাকা।
এবার রংপুর বিভাগের ৮টি জেলায় ৩৩টি সংসদীয় আসন রয়েছে। এই বিভাগে এবার মোট ৩০২টি মনোনয়ন ফরম বিক্রি হয়েছে। অর্থাৎ এই বিভাগের প্রতি আসনে গড়ে ৯ জন করে আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশী রয়েছেন। রাজশাহী বিভাগে মোট ৩৯টি সংসদীয় আসন রয়েছে। এই বিভাগে এবার সরাসরি ৪০৯টি ফরম বিক্রি করেছে আওয়ামী লীগ। গড়ে প্রতি আসনে প্রার্থী ১০ জনের বেশি। খুলনা বিভাগে সংসদীয় আসন রয়েছে ৩৬টি। আওয়ামী লীগ দলীয় মনোনয়ন ফরম বিক্রি করেছে ৪১৬টি। গড়ে প্রার্থী প্রায় ১২ জন। বরিশাল বিভাগে ২১টি সংসদীয় আসনের বিপরীতে আওয়ামী লীগের দলীয় ফরম কিনেছেন ২৫৮ জন। এই বিভাগে গড়ে দলীয় মনোনয়নপ্রত্যাশী ১২ জন।
ময়মনসিংহ বিভাগে সংসদীয় আসন রয়েছে ২৪টি। এই বিভাগে মনোনয়ন ফরম বিক্রি হয়েছে ২৯৫টি। ফলে এই বিভাগেও গড়ে প্রার্থী ১২ জন। সবচেয়ে বেশি ৭০টি সংসদীয় আসন রয়েছে ঢাকা বিভাগে। এই বিভাগে সবচেয়ে বেশি ৭৩০টি দলীয় মনোনয়ন ফরম বিক্রি করেছে আওয়ামী লীগ। ঢাকা বিভাগে প্রতিটি আসনে দলটির গড় প্রার্থী ১০ জনের বেশি। সিলেট বিভাগে সবচেয়ে কম ১৯টি সংসদীয় আসন রয়েছে। এর বিপরীতে ১৭২টি মনোনয়ন ফরম বিক্রি করেছে আওয়ামী লীগ। এই বিভাগে গড় প্রার্থী ৯ জন।
চট্টগ্রাম বিভাগে ৫৮টি সংসদীয় আসনে রয়েছে। এই বিভাগের সরাসরি আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেতে ফরম কিনেছেন ৬৫৯ জন। বিভাগটির প্রতিটি আসনে ক্ষমতাসীন দলের গড় সংখ্যা ১১ জনের বেশি।
শনিবার মনোনয়ন ফরম বিক্রির শুরুর দিন থেকে মঙ্গলবার শেষ দিন পর্যন্ত আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়সহ আশপাশের এলাকা পরিণত হয় জনসমুদ্রে। সকাল ৯টা থেকেই রাজধানীর বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে নেতাকর্মীদের ঢল নামতে শুরু করে। বিকাল পর্যন্ত বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মী ও সমর্থকের উপস্থিতির কারণে বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ ও এর আশপাশের সড়কগুলোতে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়।
সরেজমিন দেখা যায়, প্রার্থী ও তাদের অনুসারীরা বড় বড় মিছিল নিয়ে আসছেন। অনেকেই রঙিন ক্যাপ বা টি-শার্ট পরে এসেছেন। অনেকে আবার লাউড স্পিকারে ‘জিতবে আবার নৌকা’ গান বাজিয়ে অফিসে এসেছেন। দিনভর নৌকা মার্কার স্লোগানে প্রকম্পিত ছিল পুরো এলাকা। শেষ সময় বিকাল ৫টার পরও পুরো এলাকায় ছিল নির্বাচনি উৎসবের আমেজ।
এদিকে আওয়ামী লীগের দলীয় ফরম জমা দিয়েছেন তারকা ক্রিকেটার সাকিব আল হাসান। মঙ্গলবার দুপুরের পর কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে নিজে উপস্থিত হয়ে নির্ধারিত বুথে ফরম জমা দেন তিনি। শনিবার সাকিবের পক্ষে একজন প্রতিনিধি ঢাকা-১০, মাগুরা-১ ও মাগুরা-২ আসনের মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেন। এই তিন আসনেই মঙ্গলবার মনোনয়ন ফরম জমা দেন সাকিব আল হাসান। সাকিব কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এলে নেতাকর্মীরা মুহুর্মুহু স্লোগান দিতে থাকেন, তার সঙ্গে ছবিও তোলেন অনেকেই। নড়াইল-২ আসন থেকে দ্বিতীয়বার সংসদ-সদস্য হতে আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন ফরম কিনেছেন জাতীয় ক্রিকেট দলের ওয়ানডে সাবেক অধিনায়ক মাশরাফি মুর্তজা। বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের সহসভাপতি আতাউর রহমান ভূঁইয়া মানিক নোয়াখালী-২ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চান।
বরিশাল-৩ আসন থেকে আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন ফরম কিনেছেন চিত্রনায়ক মাসুম পারভেজ রুবেল। ঢাকা-১৭ ও টাঙ্গাইল-১ আসন থেকে ফরম নিয়েছেন ছোট পর্দার জনপ্রিয় অভিনেতা সিদ্দিকুর রহমান। ফেনী-৩ আসনে অভিনেত্রী শমী কায়সার আওয়ামী লীগের ফরম কিনেছেন। চিত্রনায়িকা মাহিয়া মাহি চাঁপাইনবাবগঞ্জ আসন থেকে নির্বাচন করতে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেছেন। চিত্র নায়িকা শিমলা আওয়ামী লীগের প্রার্থী হতে ঝিনাইদহ-১ আসন থেকে মনোনয়ন ফরম কিনেছেন। মানিকগঞ্জ-২ আসন থেকে আবারও দলের মনোনয়ন পেতে ফরম কিনেছেন কণ্ঠশিল্পী মমতাজ বেগম। ফেনী-৩ আসন থেকে আওয়ামী লীগের হয়ে মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেছেন অভিনয়শিল্পী, সংগঠক ও রাজনীতিবিদ রোকেয়া প্রাচী।
পাবনা-৫ আসন থেকে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের ছেলে মোহাম্মদ আরশাদ আদনান আওয়ামী লীগের মনোনয়ন ফরম কিনেছেন। জনপ্রিয় আইনজীবী সায়েদুল হক ওরফে সুমনও আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়নপ্রত্যাশী। নেত্রকোনা-২ আসন থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন ফরম কিনেছেন ব্যারিস্টার রানা তাজউদ্দিন খান। এছাড়া বিভিন্ন পেশাজীবীর মধ্যে হা-মীম গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও এফবিসিসিআই-এর সাবেক সভাপতি একে আজাদ ফরিদপুর সদর-৩ আসন থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশী। বরিশাল-৬ আসন থেকে ফরম কিনেছেন ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটের সম্মানি সাধারণ সম্পাদক ইঞ্জিনিয়ার এসএম মনজুরুল হক মঞ্জু। ফেনী-২ আসনে সাংবাদিক ইকবাল সোবহান চৌধুরী এবং কুমিল্লা-১০ আসন থেকে নঈম নিজাম আওয়ামী লীগের মনোনয়ন ফরম কিনেছেন।
টাঙ্গাইল-৩ আসনে বিএসএমএমইউর সাবেক উপাচার্য ডা. কামরুল হাসান খান, চট্টগ্রাম-৩ আসনে স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) সভাপতি ডা. জামাল উদ্দিন, রাজবাড়ী-২ আসনে সাবেক সভাপতি ডা. এম ইকবাল আর্সলান, ময়মনসিংহ-৪ আসনে স্বাচিপের সাবেক মহাসচিব ডা. এমএ আজিজ, সিলেট-৩ আসনে বিএমএ মহাসচিব ডা. এহতেশামুল হক চৌধুরী, শরীয়তপুর-১ আসনে সাবেক আইজিপি একেএম শহীদুল হক, কিশোরগঞ্জ-২ আসনে সাবেক ডিআইজি আবদুল কাহার আকন্দ আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশী।
এদিকে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটের শরিক যাদের ইসিতে নিবন্ধন আছে এমন দু-একটি দলের নেতারাও নৌকার প্রার্থী হতে মনোনয়ন ফরম কিনেছেন। নড়াইল-১ আসন থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন ফরম জমা দিয়েছেন ১৪ দলীয় জোটের শরিক গণআজাদী লীগের সভাপতি এস কে সিকদার। আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেছেন বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দল-বাসদের তিন নেতা। তারা হলেন- বাসদের সভাপতি রেজাউল রশিদ খান সিরাজগঞ্জ-৬ আসনে, সদস্য হামিদুল, সুনামগঞ্জ-২ আসনে; সদস্য মো. বকুল হোসেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া-১ আসনে।
ঘোষিত তফশিল অনুযায়ী, আগামী ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। নির্বাচনে প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র দাখিলের শেষ দিন ৩০ নভেম্বর, মনোনয়নপত্র যাচাই-বাছাই হবে ১ থেকে ৪ ডিসেম্বর, মনোনয়ন আপিল ও নিষ্পত্তি ৬ থেকে ১৫ ডিসেম্বর, প্রার্থিতা প্রত্যাহারের শেষ তারিখ ১৭ ডিসেম্বর, প্রতীক বরাদ্দ ১৮ ডিসেম্বর, নির্বাচনি প্রচার-প্রচারণা ১৮ ডিসেম্বর থেকে ৫ জানুয়ারি সকাল ৮টা পর্যন্ত চলবে।