জ্বালানি তেলের দাম না কমা পর্যন্ত ট্রাক-কাভার্ডভ্যানের ধর্মঘট অব্যাহত থাকবে
স্টাফ রিপোর্টার: টানা ৬৫ ঘণ্টা পর ধর্মঘট প্রত্যাহার করা হয়েছে। জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে পরিবহন মালিকদের দাবির মুখে বাস-মিনিবাসের ২৭ শতাংশ ভাড়া বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)। গতকাল বিকালে বিআরটিএর কার্যালয়ে এ সিদ্ধান্ত হয়। নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী দূরপাল্লার বাসে প্রতি কিলোমিটারে যাত্রী প্রতি ভাড়া বেড়েছে ৩৮ পয়সা। আর মহানগরে প্রতি কিলোমিটারে বেড়েছে ৪৫ পয়সা। এছাড়া বাসে সর্বনিম্ন ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে ১০ টাকা, মিনিবাসে ৮ টাকা। বাসের সঙ্গে লঞ্চে কিলোমিটার প্রতি ভাড়া বাড়ানো হয়েছে ৩৫ শতাংশ। গতকাল সকাল সাড়ে ১১ টায় বিআরটিএ’র কার্যালয়ে নতুন ভাড়া সমন্বয়ের বৈঠকে বসেন বিআরটিএ চেয়ারম্যান নূর মোহাম্মদ মজুমদার ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির নেতারা। দীর্ঘ বৈঠকের পর বিকালে বাস ভাড়া বাড়ানোর সিদ্ধান্ত আসে। পরে পরিবহন মালিকরা ধর্মঘট প্রত্যাহার করে নেন। এদিকে দূরপাল্লার বাস ভাড়া প্রতি কিলোমিটারে ১ টাকা ৪২ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ১ টাকা ৮০ পয়সা করা হয়েছে। এতে প্রত্যেক যাত্রীকে কিলোমিটার প্রতি ৩৮ পয়সা বাড়তি গুনতে হবে। পূর্বের চেয়ে নতুন সমন্বিত ভাড়া বেড়েছে ২৭ শতাংশ। অন্যদিকে মহানগরে বাসের ভাড়া প্রতি কিলোমিটারে ১ টাকা ৭০ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ২ টাকা ১৫ পয়সা করা হয়েছে। কিলোমিটারে ভাড়া বেড়েছে ৪৫ পয়সা। আগের চেয়ে নতুন সমন্বিত ভাড়া বেড়েছে ২৬ দশমিক ৫ শতাংশ। এছাড়া মহানগরে মিনিবাসের প্রতি কিলোমিটারে ভাড়া ১ টাকা ৬০ পয়সা বাড়িয়ে সেটি ২ টাকা ৫ পয়সা করা হয়েছে।
বৈঠক শেষে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) চেয়ারম্যান নূর মোহাম্মদ মজুমদার জানান, দূরপাল্লায় ভাড়া বেড়েছে ২৭ শতাংশ। মহানগরে ভাড়া বেড়েছে ২৬ দশমিক ৫ শতাংশ। আমরা ভাড়া বৃদ্ধির প্রস্তাবটি মন্ত্রণালয়ে পাঠাবো। এরপর প্রজ্ঞাপন জারি হবে। প্রজ্ঞাপন জারি হলে বর্ধিত এ ভাড়া কার্যকর হবে। তিনি আরও বলেন, জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির প্রেক্ষিতে পরিবহন মালিকদের দাবির মুখে বাসের ভাড়া বাড়ানো হয়েছে। তবে যেসব গাড়ি সিএনজিতে চলে সেসবের ভাড়া বাড়বে না।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্লাহ সাংবাদিকদের জানান, বিআরটিএ’র চেয়ারম্যানের সঙ্গে আমাদের বৈঠক হয়েছে। বৈঠকে বাসের নতুন ভাড়া নিয়ে ফলপ্রসূ সিদ্ধান্ত হয়েছে। দেশের মানুষের ভোগান্তির কথা চিন্তা করে বিআরটিএ থেকে নতুন ভাড়ার সিদ্ধান্ত মেনে নিয়েছে। সোমবার থেকে নতুন ভাড়া কার্যকর হবে। বাড়তি ভাড়া আদায়ের বিষয়ে আমাদের নজরদারি থাকবে।
তিনি বলেন, জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির পর নতুন ভাড়া নির্ধারণ হওয়ায় আমরা ধর্মঘট প্রত্যাহার করে নিয়েছি। বিকাল থেকে বাস চলাচল করবে। এ সময় তিনি রাজধানীসহ সারাদেশের বাস চালু করতে মালিক-শ্রমিকদের প্রতি আহ্বান জানান।
তিনি আরও বলেন, ২০১৩ সাল থেকে এ পর্যন্ত ৮ বছরে জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে। টায়ার, টিউব ও খুচরা যন্ত্রাংশের দাম বাড়ছে, শুধু সেগুলোরই পুরোপুরি ভাড়া আমরা পাইনি। আমার মনে হয় নতুন ভাড়ার মধ্যে তেলের দামের বিষয়টি আসেনি। আমরা তেলের দামসহ যদি ধরি, তাহলে বাসের ভাড়া আরও অনেক বাড়ে। কিন্তু আমরা জনগণের কথা চিন্তা করে সর্বশেষ জায়গায় ভাড়া মেনে নিয়েছি। যে ভাড়ার কথা বলা হয়েছে তা সোমবারের মধ্যে গেজেট হয়ে যাবে। এর থেকে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করা হবে না।
এদিকে, জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির প্রতিবাদে অঘোষিত ধর্মঘট ডেকে সারা দেশে অস্থিরতা সৃষ্টি হলেও জ্বালানি তেলের দাম নিয়ে কোনো কথা বলেননি সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব। এর আগে জ্বালানি তেলের দাম লিটারে ১৫ টাকা করে বৃদ্ধি করেছে সরকার। এর প্রতিবাদে বৃহস্পতিবার মধ্যরাত থেকে সারাদেশে তিনদিন ধরে পরিবহন ধর্মঘট শুরু হয়। পরিবহন মালিকরা শুরু থেকেই ভাড়া সমন্বয় বা ডিজেলের দাম কমানোর দাবি জানিয়ে আসছিলেন। এরই মধ্যে ডিজেল ও কেরোসিনের দাম বাড়ানোর কারণে গণপরিবহনের ভাড়া পুনঃনির্ধারণের বিষয়ে গত বৃহস্পতিবার বিআরটিএ’কে চিঠি দেয় বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি। তবে শুক্র ও শনিবার সরকারি ছুটির দিন হওয়ায় কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি বিআরটিএ। গতকাল সকাল সাড়ে ১১টায় বৈঠকে বসেন উভয়পক্ষের কর্মকর্তারা। বৈঠকে সরকারি কমিটির সদস্য, পরিবহন নেতা, জ্বালানি বিভাগ, বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি), কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) এবং সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিরা অংশ নেন।
লঞ্চের ভাড়া বাড়লো ৩৫ শতাংশ: জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে লঞ্চের ভাড়া ৩৫ দশমিক ২৯ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। এতে প্রতিকিলোমিটারে যাত্রী প্রতি ভাড়া বেড়েছে ৬০ পয়সা করে। লঞ্চ ভাড়া বাড়ানোর পর ধর্মঘট প্রত্যাহার করে নিয়েছেন মালিকরা। রোববার সন্ধ্যায় বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) কার্যালয়ে লঞ্চ মালিকদের বৈঠকে ভাড়া বাড়ানো ও ধর্মঘট প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত হয়।
ভাড়া পুনঃনির্ধারণী বৈঠকে লঞ্চভাড়া ১০০ কিলোমিটার পর্যন্ত ১ টাকা ৭০ পয়সার পরিবর্তে ২ টাকা ৩০ পয়সা ও ১০০ কিলোমিটারের ঊর্ধ্বে ১ টাকা ৪০ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ২ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। জনপ্রতি সর্বনিম্ন ভাড়া ১৮ টাকা থেকে বাড়িয়ে ২৫ টাকা করা হয়েছে। এর আগে বিআইডব্লিউটিএ’র চেয়ারম্যান কমোডর গোলাম সাদেকের সভাপতিত্বে বৈঠক শুরু হয়। বৈঠকে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ চলাচল সংস্থার সভাপতি মাহবুব উদ্দিন আহমদ ও সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট বদিউজ্জামান বাদল, বাংলাদেশ লঞ্চ মালিক সমিতির মহাসচিব শহিদুল ইসলাম ভূঁইয়া, নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের উপসচিব আমিনুর রহমান, বিআইডব্লিউটিএ’র কর্মকর্তা ও লঞ্চ মালিকরা উপস্থিত ছিলেন। এর আগে বুধবার রাতে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে ডিজেল ও কেরোসিনের দাম বাড়ানোর বিষয়টি জানায় জ্বালানি মন্ত্রণালয়। লিটারে ১৫ টাকা বাড়ানোর ঘোষণা আসে। রাতেই তা কার্যকর হয়। এর ফলে ডিজেল ও কেরোসিন তেলের নতুন দর হয় প্রতি লিটার ৮০ টাকা যা এতদিন ছিল ৬৫ টাকা। এর অনির্দিষ্টকালের জন্য গণপরিবহন ও পণ্যবাহী যানবাহন বন্ধ রাখার ঘোষণা দেন মালিক ও শ্রমিকরা। অঘোষিত পরিবহন ধর্মঘটে কার্যত: অচল হয়ে পড়ে দেশ। কর্মজীবীরা বাস বন্ধ থাকায় বিপাকে পড়েন। পথে পথে বাড়ে সীমাহীন দুর্ভোগ। ভোগান্তি আর দুর্দশা। বিশেষ করে অফিসগামী, চাকরি প্রত্যাশী ও বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি পরীক্ষার্থীরা ভোগান্তির শিকার হন। ধর্মঘটের কারণে অনেকেই চাকরি ও ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিতে পারেননি। চিকিৎসা নিতে আসা রোগীরাও বিপাকে পড়েন। শিশু ও বয়স্কদের পড়তে হয় সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতিতে। অনেকে বিকল্প উপায়ে কয়েক গুণ বাড়তি ভাড়া দিয়ে নিজ নিজ গন্তব্যে পৌঁছান। কেউ কেউ সিএনজিচালিত অটোরিকশা, রিকশা, লেগুনা, ভ্যান, কাভার্ডভ্যানে চড়েও কর্মস্থল ও গন্তব্যে যান।
এদিকে বাস ধর্মঘট প্রত্যাহার হলেও পণ্য পরিবহন সংগঠনগুলোর ধর্মঘট প্রত্যাহার হয়নি। জ্বালানি তেলের দাম না কমা পর্যন্ত ট্রাক-কাভার্ডভ্যানের ধর্মঘট অব্যাহত থাকবে বলে জানিয়েছে পণ্য পরিবহন মালিক-শ্রমিক ঐক্য পরিষদ। বাংলাদেশ ট্রাক-কাভার্ডভ্যান ও ট্যাংক লরি-প্রাইম মুভার মালিক শ্রমিক সমন্বয় পরিষদের আহ্বায়ক রুস্তম আলী খান বলেন, গণপরিবহন মালিকদের সঙ্গে সরকারের ভাড়া বৃদ্ধির সমন্বয় হয়েছে। তারা ধর্মঘট প্রত্যাহার করেছে। তবে জ্বালানি তেলের দাম কমানোর দাবিতে আমাদের চলমান ধর্মঘট নিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে এখনো কেউ কথা বলেনি। আমরা ধর্মঘট চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমরা ভাড়া সমন্বয় চাচ্ছি না। চাই তেলের বর্ধিত দাম কমানো হোক। তিনি আরও বলেন, বিষয়টি নিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে আমাদের আলোচনা চলছে। তিনি আমাদেরকে আশ্বস্ত করেছেন।