তীব্র বিদ্রোহের মুখে পুতিন : মস্কোর পথে ওয়াগনার বাহিনী

রুশ বাহিনীর সঙ্গে তুমুল লড়াই : দুটি শহর ও একটি সেনা সদর দখল

স্টাফ রিপোর্টার: রাশিয়ার সেনা নেতৃত্বের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছে দেশটির ভাড়াটে বাহিনী ওয়াগনার গ্রুপ। ইতোমধ্যে তারা রাশিয়ার দক্ষিণাঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ দুটি শহর ভোরোনেজ ও রোস্তভ দখলে নিয়েছে। এছাড়া একটি সেনা সদর দপ্তর নিয়ন্ত্রণে নেওয়ারও দাবি করেছে। রেডিওবার্তায় রাজধানী মস্কো অভিযানেরও ঘোষণা দিয়েছে তারা। এরপর থেকে রুশ সেনাদের সঙ্গে ওয়াগনার বাহিনীর তুমুল লড়াই শুরু হয়েছে। বিদ্রোহীদের ওপর কয়েকটি স্থানে বিমান হামলা চালায় রুশ সেনারা। পালটা হামলায় রুশ বাহিনীর তিনটি বিমান বিধ্বস্ত করেছে বিদ্রোহীরা। ‘পুতিনের নিজস্ব সেনা’ নামে পরিচিত এ বাহিনীর হঠাৎ বিদ্রোহে রাশিয়াজুড়ে থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে। দেশটির বড় বড় শহরে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। মস্কো ও সেন্ট পিটার্সবার্গের রাস্তায় রাস্তায় ট্যাংক মোতায়েন করা হয়েছে। ভারী অস্ত্র হাতে নেমেছে সেনাবাহিনী। ভোরোনেজ ও রোস্তভ থেকে মস্কোয় আসা মহাসড়ক বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে শনিবার রুশ প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে বলেন, ওয়াগনার বাহিনীর প্রধান প্রিগোজিন একজন বিশ্বাসঘাতক। তিনি বলেন, শত্রুকে মোকাবিলার জন্য তাদের অস্ত্র দেয়া হয়েছিল। কিন্তু সেই অস্ত্র এখন তারা রাশিয়ার বিরুদ্ধে ব্যবহার করছে। তার বাহিনী দক্ষিণ রাশিয়ায় অত্যাচার চালাচ্ছে। তাদের সমুচিত জবাব দেয়া হবে। ওয়াগনার প্রধান ইয়েভগেনি প্রিগোজিন ছিলেন পুতিনের খুবই ঘনিষ্ঠ। দীর্ঘ এক দশক ধরে বিভিন্ন দেশে রাশিয়ার ছায়াযুদ্ধের সহযোগী ছিল তার বাহিনী। মূলত ইউক্রেন যুদ্ধে গিয়ে রুশ প্রতিরক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে তাদের দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। এ নিয়ে বেশ কয়েকবার ক্ষোভ জানিয়েছিলেন ওয়াগনার প্রধান। রুশ সামরিক নেতাদের সঙ্গেও তার বৈরিতা দিন দিন বাড়ছিল। শুক্রবার তা প্রকাশ্যে রূপ নেয়। প্রিগোজিনের দাবি, ভাড়াটে বাহিনীর সাফল্যে দেশীয় সামরিক নেতারা ঈর্ষান্বিত। তাই তাদের ঠিকমতো অস্ত্র, গোলাবারুদ ও রসদ দেওয়া হচ্ছে না। তিনি বলেন, রাশিয়ার সেনাবাহিনীর ভেতর যে ‘শয়তান’ আছে তাদের থামাতে হবে। আমরা ন্যায় বিচারের জন্য লড়াই করছি। যারাই আমাদের বাহিনীর সামনে দাঁড়াবে তাদেরই ধ্বংস করে দেয়া হবে। আমার সেনারা মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত। ইউক্রেনে রুশ সেনাদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করছিল ওয়াগনারের প্রায় ২৫ হাজার সেনা। শুক্রবার প্রিগোজিন তার দলের সেনাদের ওপর মিসাইল হামলার অভিযোগ করেন রুশ সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে। এরপরই ওয়াগনার সেনাদের বিদ্রোহ শুরু হয়। প্রিগোজিন যারা এ হামলা করেছে তাদের শাস্তি দেওয়ার শপথ নেন। তবে রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় এই মিসাইল হামলার কথা অস্বীকার করে এবং প্রিগোজিনকে সবরকম ‘অবৈধ কার্যক্রম’ বন্ধের আহ্বান জানায়। কিন্তু প্রিগোজিন তার সেনাদের রোস্তভ ও বেলগোরোদসহ রাশিয়ার সীমান্ত অঞ্চলগুলোতে সরিয়ে নিতে শুরু করে। প্রথমে তারা রাশিয়ার দক্ষিণাঞ্চলীয় রোস্তভ শহর দখলে নেয়। পরে পার্শ্ববর্তী ভোরোনেজ শহরও দখলে নেয়। শনিবার তারা রোস্তভ-অন-দনে নামে রাশিয়ার একটি সামরিক সদর দপ্তর দখলে নেওয়ার দাবি করে। এটিকে ইউক্রেনে হামলার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটি হিসাবে ব্যবহার করা হতো। এক টেলিগ্রাম পোস্টে প্রিগোজিন বলেন, এখন সকাল সাড়ে ৭টা (রাশিয়ার স্থানীয় সময়)। আমরা সদর দপ্তরের (সেনা সদর দপ্তর) ভেতরে আছি। এদিন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশিত কয়েকটি ভিডিও ও ছবিতে ওয়াগনার বাহিনীর ওপর রুশ সেনাদের বিমান হামলার চিত্র দেখা গেছে। তবে পালটা হামলায় রুশ সেনাদের তিনটি বিমান বিধস্ত করার দাবি করে ওয়াগনার সেনারা। ইউক্রেনের সীমান্তবর্তী শহরগুলোতে অধিবাসীদের ঘরের ভেতর শান্ত থাকার আহ্বান জানিয়েছেন স্থানীয় গভর্নর। ভোরোনেজ অঞ্চলের গভর্নর সেখানকার বাসিন্দাদের মহাসড়ক এড়িয়ে চলার অনুরোধ জানিয়েছেন। কারণ সে পথে রাশিয়ার মিলিটারি কনভয় আসছে। টেলিগ্রামে তিনি লিখেছেন, পরিস্থিতি আমাদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। এদিকে প্রিগোজিনের হুমকির পর মস্কোর রাস্তায় রাস্তায় ট্যাংক মোতায়েন করা হয়েছে। ভারী অস্ত্র হাতে বিপুলসংখ্যক সেনা নেমেছে। কয়েকটি মহাসড়কে যান চলাচল সীমিত করা হয়েছে। মস্কোর মেয়র জানিয়েছেন, রাজধানীতে সন্ত্রাস-দমনে ব্যাপক পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। শহরবাসীর নিরাপত্তা নিশ্চিতে সেনারা মাঠে নেমেছে। ইন্টারনেট নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে। রাশিয়ার লিপেটস্কের আঞ্চলিক গভর্নর বলেছেন, লিপেটস্ক ও ভোরোনেজ অঞ্চলের মধ্যে সীমান্তে এম ৪ মহাসড়ক বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। মহাসড়কটি মস্কোকে রোস্তভ এবং এর প্রধান শহর রোস্তভ-অন-ডনসহ দক্ষিণ অঞ্চলের সঙ্গে সংযুক্ত করে। পরিস্থিতি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমারা : হোয়াইট হাউজ জানিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার পরিস্থিতি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে এ বিষয় অবহিত করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন তার মুখপাত্র। ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিলের মুখপাত্র অ্যাডাম হজ বলেছেন, আমরা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছি এবং মিত্র ও অংশীদারদের সঙ্গে এই অগ্রগতির বিষয়ে আলোচনা করছি। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ, পোল্যান্ড প্রেসিডেন্ট আন্দ্রেজ দুদাসহ যুক্তরাষ্ট্রের মিত্ররাও ঘটনা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে বলে জানিয়েছে। এদিক ভাড়াটে বাহিনীর আকস্মিক বিদ্রোহের খবরে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি বলেন, এটা শুধু শুরু। রাশিয়ার দুর্বলতা সুস্পষ্ট হয়েছে। মস্কো ইউক্রেনে তার সেনা ও ভাড়াটেদের যত দীর্ঘ সময়ের জন্য রাখবে, দেশের ভেতরে বিশৃঙ্খলা তত বেশি হবে।

Comments (0)
Add Comment