ধিকিধিকি আগুন বেরুচ্ছে : নিখোঁজদের খোঁজে স্বজনদের ছোটাছুটি আর্তনাদ
স্টাফ রিপোর্টার: নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের হাসেম ফুডস অ্যান্ড বেভারেজ কোম্পানির সেজান জুসের কারখানার চারিদিকে এখন পোড়া ধ্বংসস্তুপ। বাতাসে ভাসছে পোড়া গন্ধ। এ ধ্বংসস্তুপের ভেতর থেকেই বেরুচ্ছে ধোঁয়া। ধিকিধিকি জ্বলছিল আগুন। পোড়া ভবনটি ধীরে ধীরে ধসে পড়তে শুরু করেছে। এ অবস্থায় ভবনটিকে ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করেছে ফায়ার সার্ভিস। দিনভর অনুসন্ধানে ভবন থেকে গতকাল নতুন আর কোনো লাশের অস্তিত্ব পায়নি। অনুসন্ধান শেষে সন্ধ্যায় পোড়া ভবনে উদ্ধার অভিযান সমাপ্ত ঘোষণা করেছে ফায়ার সার্ভিস। এ সময় ফায়ার সার্ভিস জানায়, ভবনটিতে ফায়ার ফাইটিংয়ের কোনো ব্যবস্থাই ছিলো না। ভবনের আয়তন ও লোকজন অনুসারে পাঁচটি সিঁড়ির দরকার ছিলো। ভবন নির্মাণে বিল্ডিং কোড মানা হয়নি। চার তলার সিঁড়ি নেট দিয়ে আটকানো ও তালাবদ্ধ থাকায় এতোবেশি প্রাণহানি ঘটেছে। কারখানার ভেতর থেকে উদ্ধার হওয়া ৫২ মরদেহের মধ্যে ৬০ ভাগই শিশু শ্রমিক বলে জানা গেছে।
এদিকে শনিবার সকাল থেকেই স্বজন হারানোদের ছোটাছুটি আর আর্তনাদে ঘটনাস্থলে ছিল বিষাদমাখা পরিবেশ। নিখোঁজদের সন্ধানে তারা ধ্বংসস্তুপের সামনে ভিড় করতে থাকে। কারও মা, কারও স্ত্রী আবার কারও পিতার খোঁজে গিয়ে আহাজারি করতে থাকেন। শনিবার সরেজমিন আগুন লাগা ভবনে গিয়ে দেখা গেছে চারিদিকে শুধু পোড়া ধ্বংসস্তুপ। চলছিল ফায়ার সার্ভিসের উদ্ধার অভিযান ও ডাম্পিং কার্যক্রম। ভবনের ছয়তলার আগুন নিভলেও ধ্বংসস্তুপের ভেতর থেকে ধিকিধিকি আগুন বের হচ্ছিলো। আবারও সেখানে পানি ঢেলে নিভিয়ে দেয়া হয়। ধোঁয়া বের হচ্ছিলো বিকেল পর্যন্ত। এর আগে দুপুরে ছাদের একাংশ ধসে পড়তে শুরু করে। এ সময় ভবনটিকে বিপজ্জনক বলে জানান ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। তারা জানান, সকাল থেকে ভবনে উদ্ধার কাজ চলার একপর্যায়ে দুপুর থেকে একপাশ ভেঙে পড়তে শুরু করে। যে কোনো সময় বড় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।
ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের নারায়ণগঞ্জ জেলার উপ-পরিচালক আবদুল্লাহ আল আরেফিন জানান, ভবনটিকে এখন বিপজ্জনক হিসেবে ঘোষণা দেয়া হচ্ছে। আগুনে ভবনের অনেক ক্ষতি হয়েছে, এটি যে কোনো সময় ধসে পড়তে পারে।
প্রেস ব্রিফিংয়ে ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক (অপারেশন) জিল্লুর রহমান বলেন, অগ্নিকা-ের সৃষ্টি হওয়া এ ভবনটিতে ত্রুটি ছিল। ভবন নির্মাণে মানা হয়নি কোনো নির্দেশনা। এছাড়া ভবনে পর্যাপ্ত কোনো ফায়ার এক্সিট পয়েন্ট ছিল না। ছিল না কোনো অগ্নিনির্বাপণের ব্যবস্থা। আমরা আগুন নেভানো শেষে কয়েকটি ফ্লোর তালাবদ্ধ অবস্থায় দেখতে পেয়েছি। আমাদের উদ্ধার অভিযান শেষ হলে আগুনের সূত্রপাত ও অনিয়ম সম্পর্কে আরও বিস্তারিত জানা যাবে।
জেলা পুলিশ সুপার (এসপি) জায়েদুল আলম বলেন, ভবনটি ত্রুটিপূর্ণ ছিল। এ ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে রূপগঞ্জ থানায় আটজনকে আসামি করে হত্যা মামলা করা হয়েছে। এ ঘটনায় চেয়ারম্যান আবুল হাশেমসহ আটজনকেই গ্রেফতার করা হয়েছে।
এদিকে, এখন পর্যন্ত ৫৪ জনের কোনো খোঁজ মেলেনি। নিহতের স্বজনরা দিগি¦দিক হয়ে কারখানা ও বিভিন্ন হাসপাতালে খোঁজাখুঁজি করছেন। নিখোঁজরা হলেন-মহিউদ্দিন, পিতা গোলাম, সাং ভোলা চরফ্যাশন; শামীম, পিতা-ফকরুল, সাং ভোলা চরফ্যাশন; হাফেজা, পিতা ইসমাইল, সাং ভোলা; ফিরোজা বেগম, পিতা হাকিম আলী, সাং নারায়ণগঞ্জ; নাইম, পিতা তাহের উদ্দিন, সাং করিমগঞ্জ সদর, কিশোরগঞ্জ; শাহিদা, পিতা স্বপন, সাং কিশোরগঞ্জ; কম্পা বর্মণ, পিতা পর্বা বর্মণ, সাং মৌলভীবাজার, সিলেট; রাকিব, পিতা তাইজ উদ্দিন; খাদিজা, পিতা কাইয়ুম, গ্রাম শেওরা, কিশোরগঞ্জ; শান্তামণি, পিতা জাকির হোসেন, নেত্রকোনা; অমৃতা বেগম, স্বামী সেলিম, নবীগঞ্জ; আকিমা, পিতা কাইয়ুম, কিশোরগঞ্জ; হিমা, পিতা-কবির হোসেন, সাং খালিয়াঝুড়ি, নেত্রকোনা; স্বপন, পিতা মনকার, রংপুর; শাহানা, স্বামী মাহাতাব উদ্দিন, সাং জালিয়াপাড়া, কিশোরগঞ্জ; আমেনা, স্বামী রাজীব, সাং গোলাকান্দাইল খালপাড়া, রূপগঞ্জ; মিনা খাতুন, পিতা আবদুর রশিদ, কিশোরগঞ্জ; ফাতেমা আক্তার, পিতা সুজন, কিশোরগঞ্জ; পারভেজ, পিতা আহসান উল্লাহ মিজী, সাং হাইমচর, চাঁদপুর; মাহবুব, সেকশন ম্যানেজার, পিতা গকুল, সাং তেঁতুলিয়া, বাঘা, রাজশাহী; রিপন মিয়া, পিতা সেলিম মিয়া, গাজীপুর; নোমান মিয়া, পিতা মান্নান মিয়া, চরফ্যাশন, ভোলা; নাজমা বেগম, স্বামী আফজাল হোসেন, রূপগঞ্জ; মোহাম্মদ আলী, পিতা শাহাদাত খান, সাং হাটখালী; হুসাইন, পিতা ফজলু, চরফ্যাশন, ভোলা; জিহাদ মো. শওকত, জামালপুর; সেলিনা, স্বামী মো. সেলিম, মিঠামইন, কিশোরগঞ্জ; সুমাইয়া, ভুলতা; রিমা, স্বামী জসিম উদ্দিন, রূপগঞ্জ; রাকিব, পিতা কবির, চরফ্যাশন, ভোলা; ফারজানা, পিতা সুরুজ আলী; নাজমুল, পিতা চাঁন মিয়া, কিশোরগঞ্জ; তাছলিমা, পিতা বাচ্চু মিয়া, কিশোরগঞ্জ; রাকিব, চরফ্যাশন, ভোলা; আকাশ, পিতা-বাহার, নোয়াখালী; রাশেদ, পিতা আবুল কাশেম, নোয়াখালী; বাদশা, পিতা এনায়েত, ফরিদপুর; ইউসুফ, সাকিল, জাহানারা, রাহিমা, নুসরাত জাহান টুকটুকি, রাবেয়া, মাহমুদা, তাকিয়া আক্তার, ইসরাত জাহান, শাহানা, সাজ্জাদ হোসেন সজীব, লাবণ্য আক্তার, করিমা, সুপান, আসিফ। সবাই উপজেলার গোলাকান্দাইল এলাকা ও নতুন বাজার এলাকায় বিভিন্ন বাড়িতে ভাড়া থেকে ওই কারখানায় কাজ করতেন।
এদিকে শনিবার বিকেল ৫টায় ফায়ার সার্ভিসের উদ্ধার কাজ সমাপ্ত ঘোষণা করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন ঢাকা ফায়ার সার্ভিসের ডিডি দেবাশীষ রায়।
গত বৃহস্পতিবার (৮ জুলাই) বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলার ভুলতার কর্ণগোপ এলাকায় সজীব গ্রুপের মালিকানাধীন হাসেম ফুড অ্যান্ড বেভারেজের ছয়তলা কারখানা ভবনে ভয়াবহ অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটে। শুক্রবারও আগুন বিষাদমাখা পরিবেশ আর বিভীষিকাময় পরিস্থিতি তৈরি করে। সন্ধ্যা ৭টার দিকে যখন আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হন ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা ততক্ষণে কেটে যায় ২৬ ঘণ্টা। তখনো পাঁচ ও ছয় তলায় তল্লাশি চালানো বাকি ছিল। আগুন লাগার পরপর ভবন থেকে লাফিয়ে পড়ে প্রাণ হারান তিন শ্রমিক। সব মিলে এ পর্যন্ত প্রাণহানি ঘটে ৫৩ জনের।
নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে সজীব গ্রুপের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান হাসেম ফুড লিমিটেড কোম্পানিতে ৬০ ভাগই ছিল শিশু শ্রমিক। অতি মুনাফার লোভে প্রতিষ্ঠার শুরু থেকেই নিয়োগ দেয়া হয়েছিল শিশু শ্রমিক এমন অভিযোগ উঠেছে। সরকারি নিয়মনীতি উপেক্ষা করে কারখানা কর্তৃপক্ষ শিশু শ্রমিক দিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করিয়ে আসছে। কারখানার ভেতর থেকে উদ্ধার হওয়া ৫২ মরদেহের মধ্যে ৬০ ভাগই শিশু শ্রমিক বলে অসমর্থিত একটি সূত্র নিশ্চিত করেছে। তবে শিশু শ্রমিক দিয়ে কাজ করানো হলেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এ পর্যন্ত কোনো পদক্ষেপ নেয়নি বলে অভিযোগ উঠেছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, হাসেম ফুড কারখানায় নিয়োজিত শ্রমিকদের মধ্যে অধিকাংশই শিশু। এদের কারও বয়স ১০ বছর। কারও ১২ বছর। আবার কারও বয়স ১৪ বছর। স্বল্প বেতনে এসব শ্রমিক কারখানায় কাজ করত। কারখানা কর্তৃপক্ষ অতি মুনাফার লোভে সবসময় শিশু শ্রমিক নিয়োগ দিত বলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন শ্রমিক জানান।
তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, ঘটনার দুইদিন আগে হাসেম ফুড কারখানায় চাকরি নেয় ১২ বছরের শিশু শান্তামণি। মা ও বড় ভাইয়ের আয়ে সংসারের স্বচ্ছতা ফিরে না আসায় শান্তামণিও কাজে যোগ দেয়। ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে আগুনে পুড়ে শান্তামণির স্বপ্ন ছাই হয়ে যায়। শুধু শান্তামণি নয়। তার মতো ইসরাত জাহান (১৪), বিশাখা রানী (১২), শাহানা (১৩), নাঈম (১৪), হিমু (১১), মুন্না (১৪), কম্পা রানী বর্মণ (১৪), তাকিয়া (১৪), তাছলিমা (১৬) সহ একাধিক শিশু শ্রমিক ওই চতুর্থ তলায় কাজ করতো। অগ্নিকান্ডের ঘটনার পর থেকেই তারা নিখোঁজ ছিল। শুক্রবার বিকেল ৩টার দিকে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা চতুর্থ তলার আগুন নির্বাপণ শেষে একে একে লাশ নিচে নামিয়ে আনেন। তখন নিহতদের স্বজনরা কান্নায় ভেঙে পড়েন। নিহতদের লাশ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে পাঠানো হয়েছে। অগ্নিকান্ডের ঘটনায় জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে গঠিত তদন্ত কমিটির সদস্য ও রূপগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শাহ নুসরাত জাহান বলেন, আমরা তদন্ত করছি, সব অভিযোগ আমলে নিয়ে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।
উল্লেখ্য, গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় রূপগঞ্জের হাসেম ফুডস লিমিটেড কারখানায় অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটে। ঘটনার দিন তিনজনের লাশ উদ্ধার করা হয়। শুক্রবার আরও ৪৯ জনের পোড়া লাশ উদ্ধার করে ফায়ার সার্ভিস।