স্টাফ রিপোর্টার: জিনিসপত্রের দাম সহনীয় পর্যায়ে রাখতে শপথ গ্রহণের পরেই সরকার কড়া নির্দেশনা জারি করেছে। নির্দেশনার পর শুরু হয়েছে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের আগাম দৌড়ঝাঁপ। অধিদপ্তরের তরফ থেকে সারাদেশে জোরালো অভিযান চালানোর নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। আগামী ১৫ মার্চ ‘বিশ্ব ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ দিবস’-এর আগেই অধিদপ্তর প্রতিটি জিনিসপত্র নিয়ে গড়ে ওঠা সিন্ডিকেট ভেঙে দিয়ে চমক দেখাতে চায় বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। গোয়েন্দা সংস্থার একটি সূত্রে জানা গেছে, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সর্ম্পকে মানুষের মধ্যে নেতিবাচক মনোভাব সৃষ্টি করতে এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী ব্যাপকভাবে তৎপর ছিলো। তারা পরিকল্পিতভাবে জিনিসপত্রের দাম বাড়িয়েছে। রীতিমতো সিন্ডিকেট করে পুরো বাজার নিয়ন্ত্রণ করেছে। যেসব ব্যবসায়ীরা এমন সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িত ছিলো, তাদের সর্ম্পকে একটি তালিকা তৈরি করা হয়েছে, যা জমা দেয়া হয়েছে খোদ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সংশ্লিষ্ট বিভাগে। তালিকায় কোন ব্যবসায়ী কি ধরনের পরিকল্পনা নিয়ে এবং কি উদ্দেশ্যে বাজার নিয়ে মানুষের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি করে রেখেছেন তার বিস্তারিত তথ্য আছে। কারা কীভাবে এমন সিন্ডিকেটে জড়িত ছিলেন তাদের সর্ম্পকেও তথ্য দেয়া হয়েছে প্রতিবেদনে। দায়িত্বশীল সংশ্লিষ্ট একজন ঊর্ধ্বতন গোয়েন্দা কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, অসাধু ব্যবসায়ীরা এতটাই বেপরোয়া উঠেছিল যে, কোনোভাবেই তাদের নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছিল না। তাদের মদদদাতা সরকার দলীয় লোকজনদের সর্ম্পকেও তথ্য দেয়া হয়েছে সরকারের কাছে। নির্বাচনের আগে সরকার নানাভাবেই দ্রব্যমূল্য সহনীয় পর্যায়ে রাখতে চেষ্টা করেছে। কিন্তু নানা কারসাজির মাধ্যমে সরকারকে সফল হতে দেয়নি। তিনি আরও জানান, এক পর্যায়ে সরকারের তরফ থেকে আমদানির ঘোষণা দেয়া হয়। এতে করে বাজারে স্বল্প সময়ের জন্য ইতিবাচক প্রভাব পড়েছিল। তবে তা দীর্ঘ সময় ধরে টেকসই হয়নি। চেষ্টা করেও ভাঙ্গা যায়নি সিন্ডিকেটগুলোকে। দেশের ভোটারদের অর্ধেকের বেশি নানাভাবে ব্যবসা ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে জড়িত। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ব্যবসায়ীরা তাদের ওপর প্রভাব বিস্তার করার চেষ্টা করেছেন। অনেকাংশে সফলও হয়েছেন। ওই কর্মকর্তা বলেন, বৃহস্পতিবার মন্ত্রীদের শপথ গ্রহণের পরেই শুরু হবে জিনিসপত্রের দাম নিয়ে প্রথম পর্যালোচনা বৈঠক। মানুষ যাতে সহনীয় দামে জিনিসপত্র কিনতে পারে, সরকার সেটি নিশ্চিত করতে চায়। এজন্য সংশ্লিষ্টদের কড়া নির্দেশনাও দেয়া হয়েছে খোদ সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে। নির্দেশনা পেয়ে আরও জোরালোভাবে কাজ শুরু করেছে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। সংশ্লিষ্ট সূত্রে আরও জানা গেছে, সরকার ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তুলতে নানামুখী উদ্যোগ নিয়েছে। কেনাকাটা, ব্যবসা-বাণিজ্য ও আর্থিক লেনদেন অনেকাংশেই বর্তমানে ডিজিটাল প্লাটফর্মে চলে এসেছে। এতে নগদ টাকার লেনদেন কমেছে। নগদ টাকার লেনদেন কমায় নিরাপত্তা ঝুঁকিও কমেছে। কমেছে অপরাধও। তবে অনলাইন কেনাকাটার ক্ষেত্রে নানা ধরনের প্রতারণার ঘটনা ঘটছে। প্রতারণার দায়ে গত বছর সারাদেশে গ্রেপ্তার হয়েছেন ১৫৫ জন। সূত্রটি জানিয়েছে, অনলাইনে কেনাকাটা করতে এক সময় আগে পেমেন্ট বা টাকা পরিশোধ করতে হতো। পরবর্তীতে প্রতারণার বিষয়টি সামনে আসায় সরকার বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে পণ্য হাতে পাওয়ার পর মূল্য পরিশোধের সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা জারি করে। সেই সঙ্গে প্রতারণার সঙ্গে জড়িতদের গ্রেফতার করে শাস্তি নিশ্চিত করার নির্দেশনা দেয়। সূত্রটি বলছে, অনলাইনে সবচেয়ে বেশি কেনাকাটা ও প্রতারণার ঘটনা ঘটেছে করোনাকালীন সময়ে। ওই সময় অনলাইনে সবচেয়ে বেশি কেনাকাটা হয়েছে। এরপরই অনলাইন শপিং ব্যাপকভাবে জনপ্রিয়তা পায়। তারপরেও প্রতারণার কারণে অনলাইনে বেশি দামের পণ্য কিনতে মানুষের মধ্যে এখনো আস্থাহীনতা রয়েছে। এটি দূর করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাইবার বিভাগগুলো কাজ করছে। সিআইডির সাইবার বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশে মোটা দাগে বড় ১১টি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের ওপর সার্বক্ষণিক নজরদারি চলছে। তাদের আয়-ব্যয় ও সরকারকে নির্ধারিত পরিমাণ ট্যাক্স দিচ্ছে কিনা সেটি খতিয়ে দেখা হচ্ছে। সিআইডির সঙ্গে বাংলাদেশ বাংক, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সম্মিলিতভাবে একটি মনিটরিং সেল গঠন করে কাজ করছে। এছাড়া অলনাইন ব্যাংকিংয়ে জড়িত ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকেও নজরদারির মধ্যে রেখেছে মনিটরিং সেলটি। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ই-কমার্স বিভাগের তথ্য মতে, চলতি বছর ডিজিটাল ব্যাংকিংয়ে গ্রাহক সংখ্যা ৩ দশমিক ৬ বিলিয়ন ছাড়িয়ে যাবে। বিশ্বের সব উন্নয়নশীল দেশগুলোতে ব্যাপকহারে অনলাইন বাজারের সম্প্রসারণ ঘটছে। ঢাকায় ই-কমার্স ব্যবসা বাড়ছে হু হু করে। যার অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে যানজটকে। যানজটের কারণে অনেকেই সময় এবং অর্থ বাঁচাতে কিছুটা বেশি দামে হলেও অনলাইনে শপিং করছেন। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, মন্ত্রণালয় ইতোমধ্যেই ই-কমার্স বিষয়ে নজরদারি করতে বাংলাদেশ ব্যাংক, মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট খাতের ব্যবসায়ী প্রতিনিধি ও ক্যাব প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি ত্রিপক্ষীয় মনিটরিং সেল গঠন করেছে। সেলটি পরিচালনার জন্য একটি কমিটিও আছে। মনিটরিং ব্যবস্থা জোরালো করার মূল্য উদ্দেশ্য ই-কমার্স কেন্দ্রিক প্রতারণা ঠেকানো। সেলটিকে সহায়তা করছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। পুলিশের সাইবার বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, এক শ্রেণির প্রতারক ব্যবসায়ী তারকাদের দিয়ে বিভিন্ন নিম্নমানের পণ্যের বিজ্ঞাপন করাচ্ছে। বিষয়টি নজরদারির মধ্যে রয়েছে। এ ধরনের বিজ্ঞাপনে অংশ না নিতে এবং বিজ্ঞাপনে অংশ নেয়ার আগে পণ্য সর্ম্পকে তারকাদের যথাযথ ধারণা রাখার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তরফ থেকে। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের প্রধান ও ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ হারুন-অর-রশীদ বলেন, অবশ্যই ক্রেতাকে জিনিস কেনাকাটা করার ক্ষেত্রে সাবধান থাকতে হবে। অর্ডার দেয়া জিনিস হাতে পাওয়ার পর ক্রেতা যেন মূল্য পরিশোধ করেন। এছাড়া ডেভিড বা ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারের ক্ষেত্রে অবশ্যই সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। বিভিন্ন মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে অবশ্যই জিনিস বুঝে পাওয়ার পর টাকার লেনদেন করতে হবে। মোবাইল ব্যাংকিং করতে কোনো সময়ই গোপন পিন নম্বর বিক্রেতা বা তাদের এজেন্টদের বলা যাবে না। তিনি আরও বলেন, যদি কোনো অনলাইন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বা তাদের বিক্রয় প্রতিনিধি মোবাইল ব্যাংকিং, ডেভিড বা ক্রেডিট কার্ডের পিন জানতে চায়, তাহলে বুঝতে হবে তিনি একজন প্রতারক। অবশ্যই নিকটস্থ থানায় বিষয়টি জানাতে হবে। প্রয়োজনীয় জাতীয় জরুরি সেবা নম্বর ৯৯৯ নম্বরে ফোন করে পুলিশের সহায়তা নিতে হবে। বর্তমানে দেশে ১৬টি মোবাইল ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে অর্থ লেনদেন হচ্ছে। কোনো ক্রেতা যদি প্রতারিত হন, অবশ্যই তিনি স্থানীয় থানায় জিডি করতে পারেন। এছাড়া ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ কার্যালয়েও অভিযোগ জানাতে পারবেন। প্রয়োজনে মামলা দায়ের করতে পারবেন ভুক্তভোগী। ইতোমধ্যেই এমন অনেক প্রতারককে গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনা হয়েছে। ভবিষ্যতে এ ধারা অব্যাহত থাকবে।