স্টাফ রিপোর্টার: করোনা ভাইরাস মহামারীর মধ্যে গতকাল অনুষ্ঠিত সরকারি ও বেসরকারি মেডিকেল কলেজের ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের এমবিবিএস ভর্তি পরীক্ষায় স্বাস্থ্যবিধির কড়াকড়ি থাকলেও শিক্ষার্থীরা গাদাগাদি করেই কেন্দে প্রবেশ ও বের হয়েছেন। একই সঙ্গে বাইরে স্বাস্থ্যবিধি না মেনে ভিড় করেছেন অভিভাবকরা। প্রতিটি শিক্ষার্থীর সঙ্গে তিন থেকে পাঁচজন করে অভিভাবক আসেন। কেন্দ্রের মধ্যে শতভাগ স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত হলেও কেন্দে র বাইরে স্বাস্থ্যবিধি মানা হয়নি। বাইরে অভিভাবকদের জটলা ছিল।
এমবিবিএস ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নেন ১ লাখ ২২ হাজার ৮৭৪ জন ছাত্র-ছাত্রী। শিক্ষার্থীদের প্রবেশ ও বাহির হওয়ার সময় শারীরিক দূরত্ব বজায় না রাখা এবং বাইরে অভিভাবকরা স্বাস্থ্যবিধি না মেনে প্রচ- ভিড় জমানোয় ক্ষুব্ধ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা। তারা বলেন, জনগণ সচেতন না হলে করোনা সংক্রমণ বাড়তেই থাকবে। অভিভাবকরা না এলেও পারতেন। স্বাস্থ্যবিধি মানলে করোনা থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব। এটা আমরা সব সময়ই বলে আসছি। কিন্তু কেউই স্বাস্থ্যবিধি মানছেন না।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম স্বাস্থ্যবিধি বাস্তবায়নে কঠোর হওয়ার তাগিদ দিয়ে বলেন, করোনা থেকে রক্ষা পাওয়ার একমাত্র উপায় স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা। এক্ষেত্রে গাফিলতি করলে চরম খেসারত দেয়া লাগবে। বাঁচতে চাইলে স্বাস্থ্যবিধি মানার কোনো বিকল্প নেই। এদিকে রোগীদের চাপে রাজধানীর সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে কোনো সিট পাওয়া যাচ্ছে না। জেলা ও বিভাগীয় শহরের হাসপাতালগুলোতে অর্ধেক সিট খালি। আইসিইউও খালি আছে। অথচ ঢাকায় একটি আইসিইউ সিটের জন্য হাহাকার চলছে। তাই ঢাকার বাইরের করোনা রোগীদের নিজ নিজ জেলায় হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসা নিতে হবে। আর এটি শতভাগ বাস্তবায়ন করার দায়িত্ব ডাক্তারদের নিতে হবে। কারণ জেলা শহরের অনেক ডাক্তার রোগীকে ঢাকায় পাঠিয়ে দেন। রাজধানীতে না এসে জেলা শহরে চিকিৎসা নেয়ার পরামর্শ দিয়ে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলেন, অধিকাংশ করোনা রোগী ঢাকায় আসছেন। এতে ঢাকায় রোগীর চাপ বাড়ছে। ফলে অন্যান্য রোগের চিকিৎসা মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। সুচিকিৎসার অভাবে অনেকে মারাও যাচ্ছে।
অপরদিকে দেশে প্রতিদিন রেকর্ড ভাঙছে করোনা সংক্রমণ। ২৪ ঘণ্টায় শনাক্ত হয়েছেন ৬ হাজার ৮৩০ জন। একদিনে শনাক্ত রোগীর এই সংখ্যা দেশে মহামারী শুরুর পর থেকে সর্বোচ্চ। বাংলাদেশে গত বছর ৮ মার্চ করোনা ভাইরাসের প্রথম সংক্রমণ ধরা পড়ার এক বছর পর সোমবার প্রথম বারের মতো এক দিনে ৫ হাজারের বেশি নতুন রোগী শনাক্তের খবর আসে। তিন দিনের মাথায় বৃহস্পতিবার দৈনিক শনাক্ত রোগীর সংখ্যা ৬ হাজার ছাড়িয়ে যায়। এক বছরেরও বেশি সময় ধরে মহামারী তাড়া করে ফিরলেও, সম্প্রতি এ ভাইরাস ভয়ঙ্কর আকার ধারণ করেছে। ইতিমধ্যে দেশের ৩১টি জেলায় আবারও ছড়িয়ে পড়েছে করোনা সংক্রমণ। শনাক্তের হার ছাড়িয়েছে ২৩ শতাংশ।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, গত বছরের ২ আগস্ট এক দিনে সর্বোচ্চ ৪ হাজার ১৯ জনের করোনা শনাক্ত হয়। এরপর গত ৩১ মার্চ ৫ হাজার ৩৫৮ জন আক্রান্ত হওয়ার মধ্যদিয়ে সেই রেকর্ড ভাঙে। পরদিন বৃহস্পতিবার একদিনে সর্বোচ্চ ৬ হাজার ৪৬৯ জনের করোনা শনাক্ত হয়, যা আগের সব রেকর্ড ভেঙে ফেলে। গতকাল সেই রেকর্ডও ভেঙে ফেলেছে। এদিকে গত বছরের ৩০ জুন একদিনে সর্বোচ্চ ৬৪ জন করোনায় মারা যান। সেই সংখ্যা এখনো না ছাড়ালেও গত তিন দিন ধরে দৈনিক মৃত্যুর সংখ্যা ৫০ এর ঘরে রয়েছে। বৃহস্পতিবার করোনায় একদিনে মৃত্যু হয় ৫৯ জনের। গতকাল মারা গেছেন ৫০ জন। নতুন রোগীদের নিয়ে দেশে এ পর্যন্ত শনাক্ত রোগীর সংখ্যা দাঁড়ালো ৬ লাখ ২৪ হাজার ৫৯৪ জনে। আর তাদের মধ্যে এ পর্যন্ত মোট ৯ হাজার ১৫৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। টানা কয়েক দিন ধরে শনাক্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ২৪ ঘণ্টায় পরীক্ষার তুলনায় শনাক্তের হারও বেড়ে ২৩ দশমিক ২৮ শতাংশ হয়েছে, যা গত ৬ আগস্টের পর সর্বোচ্চ।
স্বাস্থ্য অধিদফতর জানিয়েছে, গত ২৪ ঘণ্টায় সারাদেশে মোট ২২৬টি ল্যাবে ২৯ হাজার ৩৩৯টি নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। এ পর্যন্ত পরীক্ষা হয়েছে ৪৭ লাখ ২৮ হাজার ১১৩টি নমুনা। ২৪ ঘণ্টায় নমুনা পরীক্ষার বিবেচনায় শনাক্তের হার ২৩ দশমিক ২৮ শতাংশ, এ পর্যন্ত মোট শনাক্তের হার ১৩ দশমিক ২১ শতাংশ।
গত একদিনে যারা মারা গেছেন, তাদের মধ্যে ৪০ জন পুরুষ আর নারী ১০ জন। তাদের মধ্যে একজন বাড়িতে মারা গেছেন। বাকিদের মৃত্যু হয়েছে হাসপাতালে। তাদের মধ্যে ৩২ জনের বয়স ছিলো ৬০ বছরের বেশি, ১১ জনের বয়স ৫১ থেকে ৬০ বছরে মধ্যে, চার জনের বয়স ৪১ থেকে ৫০ বছরের মধ্যে, দুই জনের বয়স ৩১ থেকে ৪০ বছরের মধ্যে এবং একজনের বয়স ২১ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে ছিলো। মৃতদের মধ্যে ৩৬ জন ঢাকা বিভাগের, সাতজন চট্টগ্রাম বিভাগের, দুইজন রাজশাহী বিভাগের, তিনজন খুলনা বিভাগের এবং দুইজন সিলেট বিভাগের বাসিন্দা ছিলেন। দেশে এ পর্যন্ত মারা যাওয়া ৯ হাজার ১৫৫ জনের মধ্যে ৬ হাজার ৮৮৭ জনই পুরুষ এবং ২ হাজার ২৬৮জন নারী।
গত কিছুদিন ধরে করোনায় আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা লাফিয়ে বাড়ছে। বিশেষজ্ঞরা বর্তমান অবস্থাকে ‘জরুরি স্বাস্থ্য অবস্থা’ উল্লেখ করে দেশের শতভাগ মানুষকে প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যবিধি (প্রয়োজন ছাড়া ঘরের বাইরে না যাওয়া, ঘরের বাইরে গেলেই শতভাগ মানুষের মাস্ক পরিধান করা, ঘন ঘন সাবান বা স্যানিটাইজার দিয়ে হাত ধোয়া, জনসমাগম এড়িয়ে চলা) মেনে চলার পরামর্শ দিলেও সেদিকে অধিকাংশ মানুষেরই ভ্রুক্ষেপ নেই। এমন পরিস্থিতিতে কেউ কেউ দুই-তিন সপ্তাহের জন্য সারা দেশে লকডাউন ঘোষণারও পরামর্শ দিচ্ছেন। কিন্তু সরকার জীবন ও জীবিকার কথা ভেবে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ রোধে ১৮ দফা নির্দেশনা জারি করেছে।