স্টাফ রিপোর্টার:
নিউমার্কেট এলাকায় ছাত্র-ব্যবসায়ীদের সংঘর্ষে ঢুকে সহিংসতায় অংশ নেয়া হেলমেটধারীদের শনাক্ত করতে শতাধিক ভিডিও ফুটেজ পর্যালোচনা করছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এদিকে সংঘর্ষের ঘটনায় পুলিশের করা মামলায় এক নম্বর আসামি বিএনপির নিউমার্কেট থানার সাবেক সভাপতি মকবুল হোসেনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। শুক্রবার বিকেলে ধানমন্ডির বাসা থেকে তাকে গ্রেফতার করা হয় বলে নিশ্চিত করেছেন গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার একেএম হাফিজ আক্তার। তিনি জানান, মকবুল হোসেনকে মিন্টো রোডে ডিবি কার্যালয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।
এদিকে সংঘর্ষের ঘটনার এ পর্যন্ত ৪টি মামলার মধ্যে নাহিদ ও মুরসালিন হত্যা মামলা ডিবিতে হস্তান্তর করা হয়েছে। বাকি দুটি মামলা তদন্ত করবে পুলিশ। চার মামলায় মোট আসামির সংখ্যা প্রায় সাড়ে ১৮শ।
পুলিশের আইজি ড. বেনজীর আহমেদ বলেছেন, নিউমার্কেটে সহিংসতায় কী ঘটেছে, তা সবার কাছে পরিষ্কার। সেদিনের ঘটনার ছবি আছে, ফুটেজ আছে। এগুলো দেখেই তদন্তকাজ এগোবে। এখানে কোনো রাজনৈতিক বিবেচনায় মামলা হচ্ছে না, আর হবেও না। তিনি বলেন, জড়িতদের কাউকেই ছাড় দেওয়া হবে না। আইজিপি বলেন, যারা এ ধরনের আচরণ করেছেন, তারা যারাই হোন, ভবিষ্যতে এ ধরনের আচরণ থেকে সতর্ক থাকবেন। সংঘর্ষে দুর্ঘটনা ঘটেছে, আইন লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে, প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে, এসব বিষয়ে পুলিশের যেসব আইনগত ব্যবস্থা সেগুলো আমরা অবশ্যই দেখবো।
পুলিশের একজন কর্মকর্তা বলেন, নিউমার্কেটের সংঘর্ষে কিছু যুবক হেলমেট পরা ছিল। এরা সংঘর্ষের মাঝখানে ঢুকে সহিংসতা করেছে। এরা যেমন ছাত্রদের ওপর হামলা করেছে, তেমনি ব্যবসায়ীদের ওপরও হামলা চালিয়েছে। ছাত্ররা মনে করছেন এরা ব্যবসায়ীদের লোক, আর ব্যবসায়ীরা মনে করছেন ওরা ছাত্র। মূলত এরাই তৃতীয় পক্ষ। ভিডিও ফুটেজ দেখে দেখে এদের চিহ্নিত করার প্রচেষ্টা অব্যাহত আছে।
এ ব্যাপারে মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) যুগ্ম কমিশনার মাহবুব আলম বলেন, ঘটনার তদন্তে আমাদের হাতে ইতিমধ্যে পর্যাপ্ত সাক্ষ্যপ্রমাণ চলে এসেছে। মনে করা হচ্ছে, সার্বিক ঘটনায় তৃতীয় কোনো পক্ষ জল ঘোলা করার জন্য আগুনে ঘি ঢেলেছে। তাদেরই খোঁজা হচ্ছে।
দুই হত্যা মামলা ডিবিতে: নিউমার্কেট এলাকায় সংঘর্ষের ঘটনায় দায়ের হওয়া দুই হত্যা মামলা ডিবি তদন্ত করবে। সংঘর্ষে নাহিদ মিয়া হত্যা মামলা নিউমার্কেট থানা থেকে এরইমধ্যে ডিবিতে হস্তান্তর করা হয়েছে। নিউমার্কেট থানার ওসি ম কাইয়ুম জানান, নিহত নাহিদের চাচা মো. সাইদ যে হত্যা মামলাটি করেছেন, তা গোয়েন্দা পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। শুক্রবার ডকেটসহ সবকিছু গোয়েন্দা পুলিশের কাছে দেওয়া হয়েছে। এছাড়া দোকান কর্মচারী মুরসালিন নিহতের ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলার ডকেটও ডিবিতে পাঠানোর প্রক্রিয়া চলছে। তবে বাকি দুই মামলা নিউ মার্কেট থানা পুলিশ তদন্ত করছে বলে জানিয়েছেন ওসি কাইয়ুম। পুলিশ সিসি ক্যামেরা ও অন্যান্য ভিডিও পর্যালোচনা করছে।
নিউমার্কেটের চার নম্বর ফটকের ভেতরের সিসি ক্যামেরা ভিডিওতে ঢাকা কলেজের তিন শিক্ষার্থী চিহ্নিত হওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে ওসি বলেন, আমরা সব বিষয় নিয়ে কাজ করছি। হেলমেট পরা কারা ছিল আর বাইরে থেকে কে কে ওই এলাকায় গেছে, সব খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
হত্যা মামলার বাইরে বিস্ফোরকদ্রব্য আইনে একটি মামলা করেছেন নিউমার্কেট থানার এসআই মেহেদী হাসান। একই থানার পরিদর্শক (তদন্ত) ইয়াসিন কবির দাঙ্গা-হাঙ্গামা, জ্বালাও-পোড়াও, পুলিশের কাজে বাধা দেওয়ার অভিযোগে আরেকটি মামলা করেছেন। পরিদর্শক ইয়াসিন কবিরের মামলায় নিউমার্কেট থানা বিএনপির সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট মকবুল হোসেনসহ ২৪ জনের নাম রয়েছে। আসামিরা হলেন-মকবুল হোসেন, আমির হোসেন, মিজান, মো. টিপু (বিদেশে), জাহাঙ্গীর হোসেন পাটোয়ারি, জাহাঙ্গীর মিঠু, হারুন হাওলাদার, শাহ আলম শন্টু, শহিদুল ইসলাম শহিদ, জাপানি ফারুক, মিজান বেপারী, আসিফ, রহমত, সুমন, জসিম, বিল্লাল, হারুন, তোহা, মনির, বাচ্চু, জুলহাস, মিঠু, মিন্টু ও বাবুল। তারা সবাই নিউমার্কেট থানার ১৮ নম্বর ওয়ার্ডের বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের সাবেক ও বর্তমান নেতাকর্মী। নিউমার্কেট থানার ওসি বলেন, যাদের নাম এসেছে, তাদের উসকানিদাতা হিসাবে অভিযোগে আনা হয়েছে। তবে তারা কোনো রাজনৈতিক দলের কিনা তা মামলায় উল্লেখ নেই।
মকবুল যে কারণে আসামি: নিউমার্কেটের ওয়েলকাম ও ক্যাপিটাল ফাস্টফুড নামের যে দুই দোকানের কর্মচারীদের দ্বন্দ্ব থেকে সংঘর্ষের সূত্রপাত, সেই দোকান দুটি সিটি করপোরেশন থেকে পুলিশের মামলার এক নম্বর আসামি নিউমার্কেট থানা বিএনপির সাবেক সভাপতি মকবুল হোসেনের নামে বরাদ্দ হওয়া। তবে কোনো দোকানই নিজে চালান না। রফিকুল ইসলাম ও শহিদুল ইসলাম নামে দুজনকে ভাড়া দিয়ে রেখেছেন দোকান দুটি। রফিকুল ও শহিদুল আবার পরস্পরের আত্মীয়। গোয়েন্দা পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেছেন, দুটি দোকানের কর্মচারীদের মধ্যে শক্তি প্রদর্শনের জন্যই কি এই ঘটনা, নাকি এর পেছনে ইন্ধন আছে রাজনৈতিক কিছুর তা নিয়েও তারা কাজ করছেন। মকবুল হোসেনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তাকে এ বিষয়েও জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।
নাহিদ হত্যার ভিডিও ভাইরাল: নিউমার্কেটের সংঘর্ষের মাঝখানে পড়ে নিহত কুরিয়ারের ডেলিভারিম্যান নাহিদকে পিটিয়ে, কুপিয়ে গুরুতর আহত করে সেই হেলমেট বাহিনীর সদস্যরাই। কালো হেলমেট, পরনে কলাপাতা রঙের টি-শার্ট ও প্যান্ট পরা একজন নাহিদকে কুপিয়ে গুরুতর জখম করে। তার হাতে ছিল রামদা। এ ছাড়াও আরও ২০ থেকে ৩০ জন নানাভাবে হামলায় অংশ নেয়। নাহিদকে কিভাবে হামলা করা হয়েছে তার একটি ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। সেই ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, কালো হেলমেট, কলাপাতা রঙের টি শার্ট ও জিন্সের প্যান্ট পরিহিত এক যুবক হাতে রামদা নিয়ে সমানতালে তাকে কুপিয়ে যাচ্ছে। এ সময় ছুটে গিয়ে হলুদ শার্ট পরিহিত এক যুবক তাকে নিবৃত্ত করার চেষ্টা করছে। একই সময়ে লাল হেলমেট পরিহিত আরেক যুবকসহ তারা কালো হেলমেট পরিহিত হামলাকারী যুবককে টেনে নিয়ে আসে। এর কিছুক্ষণ পর শতাধিক হেলমেট বাহিনী এসে এ সংঘর্ষে হামলে পড়ে। এই হেলমেটধারীদের পরিচয় শনাক্ত করতে প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে পুলিশ। গোয়েন্দা পুলিশ জানিয়েছে, সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হওয়া ভিডিওটিও তারা সংগ্রহ করেছেন। সেই ভিডিওর সূত্র ধরে হেলমেট বাহিনীর সদস্যদের খোঁজা হচ্ছে।
জমতে শুরু করেছে নিউমার্কেট: এদিকে আবারও চিরচেনা রুপে জমতে শুরু করেছে নিউমার্কেট। সংঘর্ষের প্রায় তিন দিন পর শুক্রবার ঈদ উপলক্ষ্যে ক্রেতাদের ভিড় দেখা গেছে নিউমার্কেটে। তবে অন্য সময়ের তুলনায় ক্রেতার সংখ্যা কম ছিল বলে জানিয়েছেন বিক্রেতারা। তারা বলছেন, সবকিছু ঠিক থাকলে মার্কেট জমতে আরও দু-একদিন সময় লাগবে। সবাই সহনশীল আচরণ করবেন এমনটাই প্রত্যাশা করছেন এখানকার ক্রেতা-বিক্রেতারা। আব্দুল আলীম নামের এক খুচরা কাপড় বিক্রেতা বলেন, করোনার কারণে গত দুই বছর মানুষ তেমন কোনো কিছু ঈদের জন্য কিনতে পারেননি। এবারে মানুষ একসঙ্গে অনেক কিছু কিনছেন। সোমবার রাত ১২টার দিকে নিউমার্কেট ও ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীরা সংঘর্ষে জড়ান। পরদিন দিনভর সংঘর্ষ চলে ওই এলাকার ব্যবসায়ী ও দোকান কর্মচারী এবং শিক্ষার্থীদের মধ্যে। ঘটনায় এখন পর্যন্ত নাহিদ হোসেন ও মোহাম্মদ মুরসালিন নামে দুই তরুণের মৃত্যু হয়েছে। আহত অবস্থায় হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন অন্তত ৪০ জন।