করোনাকালে মানুষের আয় কমলেও নিত্যপণ্যের দাম হু হু করে বাড়ছেই
স্টাফ রিপোর্টার: চাল ও পেঁয়াজের বাড়তি দামে দিশাহারা নিম্ন আয়ের মানুষ। করোনাকালে সীমিত আয়ে সংসারের খরচ সামাল দিতে গিয়ে এমনিতেই হিমশিম খাচ্ছে সাধারণ মানুষ। এর ওপর গত এক সপ্তাহ ধরে ‘বোঝার ওপর শাকের আঁটি’র মতো এই দুটি পণ্যের বাড়তি দাম অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করেছে। চুয়াডাঙ্গার বিভিন্ন বাজারের ক্রেতারা বলছেন, মহামারীর কারণে তাদের আয় কমলেও কমছে না ব্যয়। নিত্যপণ্যের পেছনে অতিরিক্ত খরচে হিসাব মেলাতে পারছেন না তারা। গতকালও চুয়াডাঙ্গায় ৬৫ থেকে ৭০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়েছে পিঁয়াজ।
শুধু চাল ও পেঁয়াজই নয়, করোনাকালে মানুষের আয় কমলেও নিত্যপণ্যের দাম হু হু করে বাড়ছেই। সবজির বাজারেও আগুন। মাছের বাজারে ইলিশ ছাড়া অন্যগুলোর দামেও ঊর্ধ্বগতি। মাংসের বাজারেও স্বস্তিতে নেই ক্রেতারা। শুধু সবজি নয়, বাজারে এখন ভোগ্যপণ্য ডাল, ডিম, তেল, গরুর মাংস, মুরগির মাংস ও আদার দাম চড়া। বাজার যেন নিয়ন্ত্রণহীন, দেখার কেউ নেই। চলতি বছরের শুরুতে নিত্যপণ্যের দামের তুলনায় এখন সব পণ্যই দ্বিগুণ বা এর চেয়ে বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। চলতি বছর ১০ জানুয়ারি মোটাদাগে ২০টি নিত্যপণ্যের দাম ছিলো নিয়ন্ত্রণের মধ্যে। ফেব্রæয়ারি ও মার্চের শুরুতেও বাজার মোটামুটি নিয়ন্ত্রণের মধ্যেই ছিলো। এরপর থেকেই বাজার পুরো নিয়ন্ত্রণের বাইরে। ১০ জানুয়ারি রাজধানীতে খুচরা বাজারে গাজর বিক্রি হয় কেজিপ্রতি ৪০ টাকা। এখন তা দ্বিগুণেরও বেশি। বাজারভেদে ৮৫ থেকে ১০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। যে টমেটো বিক্রি হতো ৪০ টাকা কেজি, সেটির দাম এখন খুচরা বাজারে তিন গুণ বেড়েছে। এখন কেজিপ্রতি ১২০ টাকায় টমেটো বিক্রি হচ্ছে। যে শিমের দাম ছিল কেজি ৪০ টাকা, তাও এখন তিন গুণ দামে বিক্রি হচ্ছে। এ ছাড়া কেজিপ্রতি যে শসা, বেগুন, ধুন্দল, ঝিঙা, চিচিঙা ৩০ থেকে ৪০ টাকা টাকায় বিক্রি হতো, এখন তা বাজারভেদে ৬০ থেকে ৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে, বর্ষা মৌসুমে সবজি উৎপাদন শীতের চেয়ে প্রায় ২০ শতাংশ কম। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে দেশে ৪৫ লাখ টন সবজি উৎপাদিত হয়েছে। এর মধ্যে শীতে উৎপাদিত হয়েছে প্রায় ২৫ লাখ টন। বিপরীতে বর্ষায় উৎপাদিত হয়েছে ২০ লাখ টনের কিছু কম।
কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, ‘করোনা ও বন্যার কারণে শাক-সবজির দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে। কিছু পণ্য আছে, যেগুলো আমদানি করা হয়, যেমন চাল ও পেঁয়াজ। এগুলো পচনশীলও নয়। এসব পণ্যের দামও বাড়ছে যুক্তিসংগত কোনো কারণ ছাড়াই। এখানে নজরদারি বাড়াতে হবে। সরকার বাজার দুভাবে পর্যবেক্ষণ করতে পারে। একটি হলো নীতিগত, আরেকটি প্রত্যক্ষ পর্যবেক্ষণ। চালের ম‚ল্য বৃদ্ধি পেয়েছে। এখন সরকার ইচ্ছা করলে বিদেশ থেকে আনা চালের শুল্ক কমিয়ে দিতে পারে। অথবা গুদামে থাকা চাল টিসিবির মাধ্যমে বিতরণ করতে পারে। এছাড়া ভারতে যেহেতু পেঁয়াজের দাম বেড়েছে, উৎপাদন কমেছে, এটা আমাদের ব্যবসায়ীরা জেনে দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন। এ জন্য পেঁয়াজের ওপরও সরকার শুল্ক তুলে দিতে পারে। টিসিবির মাধ্যমেও বিক্রি করতে পারে পেঁয়াজ।’ রাজধানীর উত্তর বাড্ডার কাঁচাবাজারের মুদিদোকানদার আবদুর রহমান বলেন, ‘আড়তে হঠাৎ করেই আদা, রসুন, পিঁয়াজ, তেলের দাম বাড়িয়ে দেয়া হয়। কোনো কারণও বলে না। ঘণ্টায় ঘণ্টায় দাম বাড়ে। খুচরা ক্রেতারা আমাদের কাছে দাম বাড়ার কারণ জানতে চান। কিন্তু আমরা যুক্তিসংগত কোনো কারণ বলতে পারি না। আমাদেরও করার কিছু নেই।’ আড়তদার-ব্যবসায়ীরা বলছেন, বন্যার কারণে ম‚লত সবজির দাম বেশি। বেশির ভাগ জমি তলিয়ে যাওয়ায় ফসল নষ্ট হয়ে গেছে। কোথাও কোথাও পানি কমে গেলেও নতুন ফসল করতে আরও অন্তত দুই মাস সময় লাগবে। তাই চাহিদা বাড়লেও উৎপাদন কমে গেছে। রাজধানীর রামপুরা, উত্তর বাড্ডা, গুলশান-১ ডিসিসি মার্কেটসহ দুটি সুপার শপ ঘুরে দেখা গেছে, গত সপ্তাহের চেয়ে মাছ-মাংসের দাম কেজিপ্রতি ১০ থেকে ১৫ টাকা বেড়েছে। গরুর মাংস এখন ৫৮০ টাকা কেজিপ্রতি বিক্রি হচ্ছে, যা গত সপ্তাহে ৫৭০ টাকায় বিক্রি হতো। দেশি মুরগি ৪০০-৪২০ টাকা কেজিপ্রতি বিক্রি হচ্ছে, যা গত সপ্তাহে ছিল ৩৯০ থেকে ৪০০ টাকা। এ ছাড়া সোনালি মুরগি ২৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে, এটি গত সপ্তাহে ১৫ টাকা কমে বিক্রি হয়।
এদিকে পাইকারি বাজারের সঙ্গে খুচরা বাজারেও দামের হেরফের রয়েছে। গতকাল পাইকারি কারওয়ান বাজারে দেখা গেছে, লম্বা বেগুন ৫০ টাকা কেজি বিক্রি হলেও খুচরা বাজারে তা ৭০ থেকে ৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। পটল ৩৫ টাকা কেজি বিক্রি হলেও খুচরা বাজারে তা বিক্রি হচ্ছে ৬০ টাকায়। এছাড়া পাইকারিতে ঢ্যাঁড়শ ৪৪ টাকা কেজি, চিচিঙা ৩৪ টাকা কেজি, লাউ ৪০ টাকায় বিক্রি হলেও খুচরা বাজারে তা দেড়গুণ দামে বিক্রি হচ্ছে। ভোজ্য তেলের মধ্যে খোলা সয়াবিন প্রতি লিটার বিক্রি হয়েছে ৮৮-৯০ টাকায়। খুচরা বাজারে তা ৯৫ থেকে ১০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আলু খুচরা বাজারে ৩৫ থেকে ৩৮ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। সরকারি বিপণন সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাবে, এই দর গত বছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ৫০ শতাংশ বেশি।
রামপুরা বাজারে আসা শাকিল নামে এক তৈরি পোশাক কর্মী বলেন, ‘ঢাকা শহর এখন নিম্ন ও মধ্যবিত্তের জন্য নয়। এখানে নিত্যপণ্যের দাম বাড়ছে অথচ মানুষের আয় কমেছে। বাজারে জিনিসপত্রের সংকট নেই তবু চাওয়া হচ্ছে বাড়তি দাম। আমরা চরম বিপদে আছি।’ তবে সবজিবিক্রেতা হালিম বলেন, বাজারে সবজি কম। সারা দেশে বন্যার পানিতে সবজি নষ্ট হয়ে গেছে। যতটুকু বাজারে আসছে তার দাম চড়া। আমরা বাড়তি দামে কিনে বাড়তি দামেই বিক্রি করছি।’
এদিকে সর্বশেষ ৬ সেপ্টেম্বর করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলায় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের টাস্কফোর্স কমিটির বৈঠক হয়। সেখানে আলোচনা করা হয় দেশের চলমান ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ে। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মজুদ, সরবরাহ ও ম‚ল্য পরিস্থিতি নিয়ে বৈঠকে পর্যালোচনা করা হয়। পিঁয়াজের মজুদ, আমদানি ও সরবরাহ এবং ম‚ল্য পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করা হয় বৈঠকে। সেখানে পিঁয়াজের সরবরাহ ও ম‚ল্য স্বাভাবিক রাখতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন টিসিবির মাধ্যমে অবিলম্বে খোলাবাজারে ট্রাক সেলে সাশ্রয়ী ম‚ল্যে পিঁয়াজ বিক্রির সিদ্ধান্ত হয়। নতুন পিঁয়াজ বাজারে না আসা পর্যন্ত তা অব্যাহত রাখবে টিসিবি। অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মজুদ, সরবরাহ ও ম‚ল্য পরিস্থিতি নিয়ে বৈঠকে বিস্তারিত আলোচনা করে দেশব্যাপী বাজার মনিটরিং জোরদার করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের টাস্কফোর্স বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন কমিটির সভাপতি এবং বাণিজ্য সচিব ড. মো. জাফর উদ্দীন। এদিকে টিসিবি বলছে, মাসের ব্যবধানে প্রতি কেজি দেশি পিঁয়াজের দাম বাড়ানো হয়েছে ১৭ দশমিক ৬৫ শতাংশ। আর আমদানি করা পিঁয়াজের কেজিতে দাম বাড়ানো হয়েছে ৫৪ দশমিক ৫৫ শতাংশ।