মাথাভাঙ্গা মনিটর: ইউক্রেন যুদ্ধের দুই সপ্তাহ যেতে না যেতেই খাদ্যমূল্য উত্তাপ তৈরি করেছে আন্তর্জাতিক বাজারে। এই উত্তাপ এতটাই বাড়তে পারে যে এর ফলে দরিদ্র দেশগুলোতে সামাজিক অস্থিরতা তৈরি হতে পারে বলেও সতর্ক করে দিচ্ছে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো। বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির প্রধান ডেভিড বিসলি হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে খাদ্যের দাম এতটাই বেড়ে যেতে পারে যে, তা বিশ্বের দরিদ্র মানুষের জন্য বিপর্যয় সৃষ্টি করবে। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন খাদ্যমূল্যের এই আঁচ বাংলাদেশকেও ভোগাবে।
বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, এরই মধ্যে ইউক্রেন তার দেশ থেকে খাদ্যশস্য রপ্তানি বন্ধের ঘোষণা দিয়েছে। গতকাল রাশিয়াও বলেছে, তারা কৃষিপণ্যসহ প্রায় ২০০ পণ্যে রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা জারি করতে যাচ্ছে। রাশিয়া সাময়িকভাবে ইউরেশিয়ান ইকোনমিক ইউনিয়নভুক্ত (ইইইউ) সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের কয়েকটি দেশে ১৫ মার্চ থেকে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত শস্য রপ্তানি এবং ইইইউ এলাকার বাইরে চিনি রপ্তানিও নিষিদ্ধ করতে পারে বলে দেশটির এক কর্মকর্তা জানিয়েছে।
বাংলাদেশের খাদ্য আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতিনিধিরা বলছেন, বিশ্ববাজারের প্রায় ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ খাদ্যপণ্য আসে রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে। গম, ভুট্টা ও ভোজ্যতেলের কাঁচামাল হিসেবে সূর্যমুখী বীজ এসব পণ্য রপ্তানিকারক দেশগুলোর মধ্যে ওপরের দিকে রয়েছে রাশিয়া ও ইউক্রেনের নাম। এ দুটি দেশ কৃষিপণ্য রপ্তানি বন্ধ করে দেয়ার ঘোষণায় আন্তর্জাতিক বাজারে হুহু করে বাড়ছে খাদ্যপণ্যের দাম। প্রভাব পড়বে দেশেও।
যুদ্ধের কারণে বাংলাদেশে সবচেয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে গম ও ভোজ্যতেলের দাম নিয়ে। যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হলে গমের দাম বেড়ে দ্বিগুণ হতে পারে বলে আশঙ্কা করছে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো। গমের দাম বাড়লে এর প্রভাব পড়বে গম থেকে তৈরি পণ্যেও। অপরদিকে সূর্যমুখী বীজ রপ্তানি বন্ধ হওয়ায় সয়াবিন ও পামতেলের ওপর বাড়তি চাপ পড়বে। যুদ্ধের আগে থেকেই সয়াবিন ও পামতেলের ফিউচার মার্কেটে অস্থিরতা বিরাজ করছিল। এখন সূর্যমুখী বীজ সরবরাহ কমে গেলে সয়াবিন ও পামতেলের দাম আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন বাজার সংশ্লিষ্টরা।
আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো বলছে, রাশিয়া ও ইউক্রেন ছাড়াও আজারবাইজান, কাজাখস্তানের মতো দেশগুলো কৃষ্ণসাগর দিয়ে বছরে কয়েক মিলিয়ন টন জ্বালানি, শস্য ও উদ্ভিদ তেল সরবরাহ করে। কিন্তু যুদ্ধের ফলে কৃষ্ণসাগরে পণ্যবাহী জাহাজ চলাচল বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে। এর ফলে শুধু যে জ্বালানি তেলের সরবরাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে তাই নয়, খাদ্যশস্য ও ভোজ্যতেলের সরবরাহও কমে গেছে। এতে করে ভোজ্যতেলের ফিউচার মার্কেটে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশের আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা বলছেন, ফিউচার মার্কেটে গত ২ সপ্তাহে শুধু সয়াবিন ও পাম তেলের দাম টনপ্রতি ৩০০ থেকে ৪০০ ডলার বেড়েছে। সবচেয়ে বেশি বেড়েছে পাম অয়েলের দাম। ফিউচার মার্কেটে বর্তমানে প্রতি মেট্রিক টন সয়াবিন তেল বেড়ে ১ হাজার ৯৫০ ডলার ও পাম তেল প্রায় ২ হাজার ডলারে উঠেছে।
ভোজ্যতেলের পাশাপাশি গমের দাম নিয়েও শঙ্কা তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশে গমের উৎপাদন কমলেও বিপরীতে ভোগ বেড়েছে অনেক বেশি। সরকারি তথ্য মোতাবেক, ১৯৯৮-৯৯ অর্থ বছরে দেশে গমের উৎপাদন ছিল ১৯ লাখ ৮ হাজার টন, বর্তমানে সেটি কমে ১২-১৩ লাখ টনে নেমে এসেছে। অপরদিকে খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তনের কারণে গমের ওপর মানুষের নির্ভরশীলতাও বেড়েছে। বর্তমানে দেশে গমের বার্ষিক চাহিদা দাঁড়িয়েছে প্রায় ৮০ থেকে ৮২ লাখ মেট্রিক টন। চাহিদার তুলনায় উৎপাদন কমে যাওয়ায় দেশের দ্বিতীয় প্রধান এই খাদ্যপণ্যটি বেশির ভাগই আমদানির মাধ্যমে চাহিদা মেটানো হয়। সরকারিভাবে প্রতিবছর ৫ থেকে ৬ লাখ মেট্রিকটন গম আমদানি হয়। আর বাদবাকি সবটাই আসে বেসরকারি খাতের আমদানিকারকদের মাধ্যমে।
যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি দফতর ইউএসডিএ’র প্রতিবেদন অনুসারে উৎপাদন কমলেও বিকল্প খাদ্য হিসেবে বাংলাদেশে গমের ব্যবহার বাড়ছে। বাংলাদেশের বিস্কুট ও বেকারি শিল্পে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ আটা ব্যবহার করে। ৪ হাজার ৫০০-এর অধিক গতানুগতিক বিস্কুট কারখানা এবং ১১০টি আধুনিক ¯^য়ংক্রিয় কারখানা ২০২০-২১ অর্থ বছরে ৫.১০ লাখ টন বিস্কুট ও কুকিজ উৎপাদন করেছে। যার দাম প্রায় ৮২৪ মিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশের আমদানিকারকরা বলছেন, রাশিয়া-ইউক্রেনের গম রপ্তানি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এখন কানাডা ও আর্জেন্টিনার গমের চাহিদা বেড়েছে। মানভেদে টনপ্রতি গমের দাম এরই মধ্যে ৪০০ ডলার থেকে বেড়ে ৫০০ ডলারে পৌঁছেছে। কানাডা থেকে আমদানি করা গমের দাম টনপ্রতি ৫০৫ ডলারে উঠেছে। ভারতীয় গমের বাজারও ঊর্ধ্বমুখী। এর ফলে গম দিয়ে তৈরিপণ্য আটা-ময়দা ছাড়াও বিস্কুট, কুকিজের দাম বাড়বে।
যুদ্ধের প্রভাব ও আন্তর্জাতিক বাজারে খাদ্যপণ্যেও দাম বৃদ্ধি নিয়ে স¤প্রতি জাতিসংঘ উন্নয়ন প্রোগাম (ইউএনডিপি)-এর বাংলাদেশের কান্ট্রি ইকোনমিস্ট অর্থনীতিবিদ ড. নাজনীন আহমেদ বলেন, যে কোনো ধরনের যুদ্ধে যেহেতু বিশ্ববাজারে পণ্যমূল্যে প্রভাব পড়ে, বাংলাদেশেও পড়বে। তবে পণ্যমূল্যের প্রভাব নির্ভর করবে চলমান যুদ্ধের মেয়াদ ও সরকারি উদ্যোগের ওপর। যদি এই যুদ্ধ দীর্ঘমেয়াদে হয়, তবে জ্বালানি তেলে ভর্তুকি দিয়ে সরকারের উচিত হবে এর দাম সহনীয় রাখা। অপরদিকে আমদানিকারক ব্যবসায়ীদের বিভিন্ন ধরনের নীতি সহায়তা দিয়ে খাদ্যপণ্যের দাম সহনীয় রাখার উদ্যোগ নিতে হবে সরকারকে।