স্টাফ রিপোর্টার: করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে সমন্বয়ের অভাব দেখা যাচ্ছে। এক্ষেত্রে প্রশাসনের ব্যর্থতাকে দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা। তারা বলেন, সঠিকভাবে লকডাউন ও স্বাস্থ্যবিধি বাস্তবায়িত না হওয়ায় দেশের সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে করোনা ভাইরাস পরিস্থিতি ভয়াবহ খারাপের দিকে যাচ্ছে, যা সারা দেশে ভাইরাসের সংক্রমণের বিস্তৃতি আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। গত দুই সপ্তাহ ধরে সংক্রমণ ও মৃত্যু উভয়ই বেড়েছে।
গত ৩ জুন ৩৬টি জেলাকে উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ বলে চিহ্নিত করা হয়েছিলো। গতকাল সংখ্যাটি বেড়ে ৫৩-এ পৌঁছেছে। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা আরও বলেন, ২০১৮ সালের সংক্রামক নিয়ন্ত্রণ আইন অনুযায়ী, মহামারি নিয়ন্ত্রণে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক যে পরামর্শ বা নির্দেশনা দিবেন তা বাস্তবায়নে অন্যান্য প্রশাসন সহযোগিতা করবে। কিন্তু এবার তা পরিলক্ষিত হয়নি। সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে সংক্রমণ বাড়লে লকডাউন দেয়ার পরামর্শ দিয়েছিলো স্বাস্থ্য অধিদফতর। কিন্তু স্থানীয় প্রশাসন শুধু লকডাউন ঘোষণা করেই দায়িত্ব শেষ করেছে। বাস্তবায়নে তাদের সঠিক কোনো মনিটরিং নেই। লকডাউন বাস্তবায়নে প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। এ কারণে সারা দেশে সংক্রমণ বাড়ছে। যে হারে করোনা রোগী বাড়ছে তাতে সামনে চিকিৎসাসেবা দেয়া কঠিন চ্যালেঞ্জে হয়ে দাঁড়িয়েছে। লকডাউন সঠিকভাবে বাস্তবায়ন না হওয়া এবং মানুষকে স্বাস্থ্যবিধি মানাতে বাধ্য না করার পরিপেক্ষিতে করোনা রোগী ব্যাপক হারে বাড়লে এর দায়ভার কে নেবে? এর খেসারত পুরো জাতিকে দেয়া লাগবে। সামনে কোরবানির ঈদকে কেন্দ্র করে সংক্রমণ ব্যাপক হারে বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। তারা বলেন, এই পরিস্থিতিতে যদি এখনই সঠিক ব্যবস্থাপনা না নেয়া হয় তাহলে করোনা নিয়ে কঠিন অবস্থায় পড়তে হবে।
বর্তমানে যেসব জেলা ও উপজেলায় ‘লকডাউন’ চলছে, খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সেখানে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে মৌলিক কাজগুলো হচ্ছে না। স্থানীয় প্রশাসন শুধু ‘লকডাউন’ ঘোষণা করে দায়িত্ব শেষ করেছে। ফলে ওসব জেলা-উপজেলায় ‘লকডাউনের’ অবস্থা দাঁড়িয়েছে কার্যত নামকাওয়াস্তে। ‘লকডাউন’ ঘোষিত এলাকার সড়ক, বাজারে জনগণের উপস্থিতি আগের মতোই থাকছে। অপ্রয়োজনে ঘোরাঘুরি করলে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে কম ক্ষেত্রে। উত্তরাঞ্চলে যখন সংক্রমণ বাড়তে শুরু করল, তখন লকডাউন সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হলে আজকের এই অবস্থার সৃষ্টি হতো না। ঢাকার বাইরে চিকিৎসাসেবার সক্ষমতা নেই। বাইরে থেকে সবাই রাজধানীতে আসছেন চিকিৎসাসেবা নিতে। রাজধানীর হাসপাতালগুলোর পরিচালকরা জানান, ঢাকার বাইরে থেকে দিনে ২০ থেকে ৩০ জন রোগী প্রতিটি হাসপাতালে আসছেন আইসিইউতে ভর্তি হতে। এ ধারা অব্যাহত থাকলে সামনে চিকিৎসাসেবা দেয়া বড় সমস্যার সৃষ্টি হবে। এদিকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলবে এই প্রতিশ্রুতি দিয়ে গণপরিবহন চালুর অনুমতি দেয়া হয়। কিন্তু গণপরিবহনে স্বাস্থ্যবিধি মানা হচ্ছে না। গণপরিবহন চালু করায় মারাত্মক ক্ষতি হয়েছে। বহির্বিশ্বে যখন মহামারি হয়, তখন স্বাস্থ্য বিভাগের সব নির্দেশনা মানা হয়। কোন সময় লকডাউন দেয়া হবে, কখন কী করতে হবে তা স্বাস্থ্য বিভাগ জানিয়ে দেয়। অন্যান্য প্রশাসন তা বাস্তবায়ন করে। কিন্তু আমাদের দেশে লকডাউন দেয়া না দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে নন-মেডিকেল পারসন। তারা শুধু খবরদারিই করেন। কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। এক্ষেত্রে দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে হবে।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, স্বাস্থ্য বিভাগ শুধু মতামত দিতে পারে। বাস্তবায়ন না করার দায়ভার কে নেবে? সীমান্তে লকডাউন বাস্তবায়ন না করার ফলে সামনে ভয়ংকর আলামত দেখা যাচ্ছে। দেশে করোনার তৃতীয় ঢেউ আসন্ন। সারা দেশে করোনা রোগীদের চিকিৎসাসেবা দেয়ার জন্য মাত্র ১২ হাজার বেড আছে। এর মধ্যে সিংহভাগই ঢাকায়। ইতিমধ্যে সাড়ে ৪ হাজার বেডে করোনা রোগী ভর্তি আছে। করোনা রোগী বাড়তে থাকলে চিকিৎসার অভাবে অনেক রোগী মারা যাবে। তাই সবার দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে। এক্ষেত্রে সর্বস্তরের জনপ্রতিনিধিদের সম্পৃক্ত করে জনগণকে স্বাস্থ্যবিধি মানাতে বাধ্য করতে হবে। অন্যথায় দেশের অন্য জেলাগুলোতে খুলনা ও রাজশাহীর মতো পরিস্থিতি হতে পারে।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, কিছু দিন আগে দেশে যখন করোনা নিয়ন্ত্রণে ছিলো, তখন সারা দেশের হাসপাতালে এক হাজার ৫০০ মতো রোগী ছিলো। সংক্রমণ বাড়ায় বর্তমানে সারা দেশে সাড়ে চার হাজারের মতো রোগী হাসপাতালে ভর্তি আছে। প্রতিদিন রোগী বাড়ছে। এই হারে যদি রোগী বাড়ে, তাহলে হাসপাতালগুলোতে করোনা রোগীদের জায়গা দেয়া কঠিন হয়ে যাবে। হাসপাতালে যতক্ষণ বেড খালি আছে, ততোক্ষণ রোগী ভর্তি করে চিকিৎসাসেবা চালিয়ে যাব। কারণ স্বাস্থ্য বিভাগের কাজ হলো চিকিৎসাসেবা দেয়া। আমরা সক্ষমতা অনুযায়ী চিকিৎসাসেবা দিয়ে যাব। সবাইকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, সংক্রমণ রোধ করতেই হবে। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. বেনজীর আহমেদ বলেন, স্বাস্থ্য বিভাগ করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে যখন যা করার প্রয়োজন তখন সেই নির্দেশনা দিয়েছে। তবে সেই নির্দেশনা বাস্তবায়নে সবার সহযোগিতা প্রয়োজন। সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে যখন সংক্রমণ বাড়ে, তখন ওই এলাকায় সংক্রমণ রোধ করতে আমরা ব্যর্থ হয়েছি। কেউ লকডাউন মানে না, স্বাস্থ্যবিধি মানে না। অথচ মাত্র দুই সপ্তাহ সঠিকভাবে লকডাউন বাস্তবায়ন করা হলে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করা যেতো। যেহেতু আমরা লকডাউন সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করতে পারেনি, তাই সারা দেশে করোনা সংক্রমণ বাড়ছে। স্বাস্থ্যবিধি মানতে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। সঠিকভাবে মনিটরিং করতে হবে। স্বাস্থ্য বিভাগের তৎপরতা এখন চোখে পড়ছে না। প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ ছাড়া এই মুহূর্তে আর কোনো বিকল্প নেই। সামনে কোরবানির ঈদকে কেন্দ্র করে গরুর হাটে মানুষ যাতায়াত করবে। শহর থেকে গ্রামে মানুষ দলে দলে ছুটবে। এই সময় করোনা সংক্রমণ কয়েকগুণ বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এমনিতে দেশে রয়েছে ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট ডেলটা। রাজধানীতে আক্রান্তের ৬৮ ভাগই ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) উপাচার্য অধ্যাপক ডা. শারফুদ্দিন আহমেদ বলেন, দেশে করোনা সংক্রমণ বাড়ছে। প্রতিদিনই রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। বিএসএমএমইউয়ে ভর্তি রোগী ৮৪ থেকে বেড়ে ১০৫ জন হয়েছে। এভাবে চলতে থাকলে সামনে ভয়ঙ্কর অবস্থার সৃষ্টি হবে। কোভিড ফিল্ড হাসপাতাল প্রস্তুত রাখার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, বেকার ডাক্তার-নার্স ও অন্যান্য স্বাস্থ্যসেবা কর্মীদের প্রশিক্ষণ দিয়ে কোভিড ফিল্ড হাসপাতাল প্রস্তুত করতে হবে। একই সঙ্গে সবার স্বাস্থ্যবিধি মানাতে বাধ্য করতে হবে। এক্ষেত্রে সর্বস্তরের জনপ্রতিনিধিদের সম্পৃক্ত করতে হবে।
ডিএনসিসি কোভিড ডেডিকেটেড হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ কে এম নাসির উদ্দিন বলেন, করোনা রোগী বাড়ছে। প্রতিদিন গড়ে ২০ থেকে ৩০ জন করোনা রোগীকে আইসিইউতে ভর্তি করা হচ্ছে। ঢাকার বাইরে থেকে বেশি রোগী আসছে। সামনে কী অবস্থা হবে বলা মুশকিল।