স্টাফ রিপোর্টার: সারাদেশে করোনা পরিস্থিতি ক্রমেই ভয়ংকর হয়ে উঠছে। মৃত্যু ও সংক্রমণের প্রতিযোগিতা চলছে। একদিন মৃত্যু বেশি তো একদিন সংক্রমণ। দুই পর্যায়েই রেকর্ড ভাঙাগড়া চলছে। সরকারি হিসাবেই প্রতিদিন মৃতের সংখ্যা উদ্বেগজনক। এর বাইরেও সারা দেশে আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে উপসর্গ নিয়ে মৃত্যু। গ্রামগঞ্জে এ সংখ্যা বেশি। দেশে প্রত্যন্ত অঞ্চলের প্রায় প্রত্যেক বাড়িতে কেউ না কেউ জ্বর-কাশি ও ঠা-ায় আক্রান্ত। এদের বেশির ভাগই নমুনা পরীক্ষা করাতে আগ্রহী নয়। তাছাড়া সব এলাকায় পরীক্ষা করানোর পর্যাপ্ত ব্যবস্থাও নেই। তাই ঘরে বসেই প্যারাসিটামল জাতীয় ওষুধ খাচ্ছেন তারা। যাদের শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ভালো তারা হয়তো কিছুদিন পর সুস্থ হয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু অনেকের ক্ষেত্রেই তা হচ্ছে না। সর্দি-কাশি-জ্বর শ্বাসকষ্ট নিয়ে মারা যাচ্ছেন বাড়িতেই। শেষ মুহূর্তে হাসপাতালে যাওয়ায় এদের অনেককেই বাঁচানো সম্ভব হচ্ছে না। এদিকে করোনা নিয়ন্ত্রণে চলমান লকডাউনের পরিবর্তে কারফিউ বা ১৪৪ ধারার মতো কঠোর কর্মসূচি ঘোষণা দেয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নন-কমিউনিকেবল ডিজিজ কন্ট্রোল এনসিডিসি পরিচালক ও অধিদপ্তরের মুখপাত্র অধ্যাপক ডা. রোবেদ আমিন। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় তিনি এ কথা বলেন।
গবেষণা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সাম্প্রতিক সময়ে উপসর্গ নিয়ে মৃতের সংখ্যা আরও বাড়ছে। খুলনা ও রাজশাহী বিভাগে গত দুই সপ্তাহে দুই শতাধিক লোকের মৃত্যু হয়েছে করোনা উপসর্গ নিয়ে। ২৪ ঘণ্টায় রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে করোনায় ১৮ জনের মৃত্যু হয়। এর মধ্যে ৯ জনই মারা গেছেন উপসর্গ নিয়ে। ময়মনসিংহে একদিনে উপসর্গ নিয়ে মারা গেছেন ১২ জন। সাতক্ষীরা জেলায় এ পর্যন্ত উপসর্গ নিয়ে মৃত্যু হয়েছে চারশ জনের। করোনা সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় রাজধানীসহ দেশের হাসপাতালগুলোতে রোগীর উপচে পড়া ভিড়। অনেক হাসপাতালে ইতোমধ্যেই শয্যা পূর্ণ হয়ে গেছে। ফাঁকা নেই আইসিইউও। ফলে এখনই চিকিৎসা করাতে চরম ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন রোগীর স্বজনরা। ২৬ জুন পর্যন্ত শুধু উপসর্গ নিয়ে ১৯৯৪ জন পুরুষ এবং ৪৫৯ জন নারীর মৃত্যু হয়।
এদিকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বৃহস্পতিবার এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে, ২৪ ঘণ্টায় আরও ১৯৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। যা দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। আগের দিন রেকর্ড ২০১ জনের মৃত্যু হয়েছিল। এ নিয়ে দেশে মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৫৭৯২। মৃত্যু দুজন কমলেও শনাক্তে হয়েছে রেকর্ড। একদিনে সর্বাধিক ১১৬৫১ জনের দেহে করোনা সংক্রমণ ধরা পড়েছে। এর আগে ৬ জুলাই দেশে সর্বোচ্চ ১১৫২৫ জন করোনা শনাক্ত হয়। আগের দিন ৫ জুলাই শনাক্ত হয় ১১১৬২ জন। সবমিলিয়ে দেশে করোনা শনাক্তের সংখ্যা হয়েছে ৯ লাখ ৮৯ হাজার ২১৯। শুধু মৃত্যু আর সংক্রমণ নয়, বাড়ছে শনাক্তের হারও। ২৪ ঘণ্টায় নমুনা পরীক্ষা বিবেচনায় শনাক্তের হার ৩১ দশমিক ৬২ শতাংশ। আগের দিন এ হার ছিল ৩১ দশমিক ৩২ শতাংশ। সরকারি হিসাবে একদিনে আরও ৫৮৪৪ জন সুস্থ হয়েছেন। এ পর্যন্ত সুস্থ হলেন ৮ লাখ ৫৬ হাজার ৩৪৬ জন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিজের তথ্যমতে, ২৬ জুন পর্যন্ত শুধু উপসর্গ নিয়েই সারাদেশে মারা গেছেন ২৪৫৩ জন। এর মধ্যে ১৯৯৪ জন পুরুষ এবং ৪৫৯ জন নারী। এর মধ্যে উপসর্গ নিয়ে সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হয় চট্টগ্রাম বিভাগে ৭৪২ জন। খুলনা বিভাগে ৪৪৬, ঢাকা বিভাগে ৩৯৬, রাজশাহী বিভাগে ৩৬৪, বরিশাল বিভাগে ২৪৪, সিলেট বিভাগে ১০২, রংপুর বিভাগে ৯৫ ও ময়মনসিংহ বিভাগে ৬৪ জন। এর মধ্যে ৯ থেকে ২২ জুন পর্যন্ত উপসর্গ নিয়ে ১৫০ জনের মৃত্যু হয়েছে।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ পিস অবজারভেটরির রিসার্চ ম্যানেজার মো. হুমায়ুন কবির বলেন, আমরা সারাদেশে উপসর্গ নিয়ে মারা যাওয়া মানুষের তালিকা করে থাকি। গত দুই সপ্তাহের তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। যাচাই-বাছাই শেষে শিগগিরই তা প্রকাশ করা হবে। এই মুহূর্তে সঠিক সংখ্যাটি বলা সম্ভব না হলেও উপসর্গ নিয়ে মৃতের সংখ্যা আশঙ্কাজনক বাড়ছে বলে মনে হচ্ছে। এ পর্যন্ত যে তালিকা পাচ্ছি তাতে মনে হচ্ছে এ সংখ্যা গত দুই সপ্তাহের চেয়ে দ্বিগুণের বেশি হতে পারে।
এ প্রসঙ্গে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. এএসএম আলমগীর বলেন, অনেক সময় দেখা যায় খুব জটিল রোগী হাসপাতালে আসার পরপরই তার চিকিৎসা শুরু করতে হয়। পাশাপাশি রোগীর নমুনা নিয়ে করোনা পরীক্ষার জন্য ল্যাবে পাঠানো হয়। ফল রিপোর্ট আসার আগেই হয়তো কারও মৃত্যু ঘটে। তখন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ সেটাকে উপসর্গ নিয়ে মৃত্যু হয়েছে বলে তাৎক্ষণিকভাবে প্রতিবেদন দেয় এবং গণমাধ্যমকেও অনেকে ওই তথ্য জানায়। যখন একই রোগীর ফল চলে আসে তখন সেটি ওই হাসপাতালে শনাক্ত হওয়া হিসাবে মৃত রোগীর তালিকায় ঢুকে যায়। আর নেগেটিভ হলেও সেটাও নেগেটিভ তালিকায় থাকে।
তিনি বলেন, সমস্যা হচ্ছে যখন ওই রোগী উপসর্গ নিয়ে মারা গেছেন বলে উল্লেখ করা হয়, ততক্ষণে সেই তথ্য গণমাধ্যমে চলে আসে। অনেক গবেষণার হিসাবে তা যুক্ত হয়। কিন্তু আমাদের হিসাবে ওই রোগীর ফল যদি পজিটিভি আসে পরদিন তা শনাক্ত হওয়া মৃতের তালিকায় উঠানো হয়। আর নেগেটিভ হলে সেই হিসাবের প্রয়োজন হয় না। ফলে সরকারি তথ্য থেকে কোনো শনাক্ত হওয়া মৃত করোনা রোগীর তথ্য বাদ যাওয়ার সুযোগ নেই।
গ্রামগঞ্জে করোনা উপসর্গ নিয়ে যারা মারা যাচ্ছেন তাদের অধিকাংশেরই নমুনা পরীক্ষা হচ্ছে না। ফলে অজানা থেকে যাচ্ছে মৃত্যুর কারণ। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে প্রতিদিন করোনা সংক্রমণে মৃত্যুর তথ্য জানানো হলেও সেখানে থাকে না উপসর্গ নিয়ে মৃত্যু কিংবা মারা যাওয়ার পর করোনা শনাক্ত রোগীর তথ্য। গত বছর করোনা শনাক্তের পর দেখা যায়, কেউ করোনা উপসর্গ নিয়ে বাড়িতে মারা গেলে প্রশাসনকে জানানো হতো। এরপর মৃতের নমুনা সংগ্রহ করে স্বাস্থ্যবিধি মেনে দাফন হতো। পরে রিপোর্ট পজিটিভ হলে সেটা জানিয়ে দেয়া হতো। কিন্তু বর্তমানে পরিস্থিতি উলটো। উপসর্গ নিয়ে কেউ বাড়িতে মারা গেলে স্বজনরা স্বাভাবিক নিয়মেই তার দাফন কিংবা সৎকার করছেন। মৃতের নমুনা পরীক্ষা হচ্ছে না। ফলে কোনো হিসাবের খাতায়ই তাদের নাম উঠছে না। উলটো মৃত্যুর আগ পর্যন্ত প্রাণঘাতী ভাইরাসের বিস্তার ঘটিয়েছেন।
সীমান্তবর্তী এলাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রতিদিনই অসংখ্য মানুষ মারা যাচ্ছে করোনা উপসর্গ নিয়ে। যুগান্তরের বিভিন্ন ব্যুরো অফিস ও প্রতিনিধিদের পাঠানো তথ্যে জানা গেছে, রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে করোনা ইউনিটে ২৪ ঘণ্টায় ১৮ জন মারা গেছেন। হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামীম ইয়াজদানী জানান, নতুন করে মারা যাওয়া ১৮ জনের মধ্যে আটজনের করোনা পজিটিভ ছিল। নয়জন মারা গেছেন করোনা উপসর্গ নিয়ে। আর একজনের নেগেটিভ ছিল। তিনি শ্বাসকষ্টে মারা গেছেন বলে জানা গেছে।
করোনা উপসর্গ নিয়ে সাতক্ষীরায় ২৪ ঘণ্টায় আরও ১০ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর আগের দিন ৯ ও মঙ্গলবার ৫ জন মারা যায়। এ পর্যন্ত করোনা উপসর্গ নিয়ে মৃতের সংখ্যা চারশ পার করেছে। বগুড়ায় ২৪ ঘণ্টায় করোনায় চারজন ও উপসর্গ নিয়ে আটজনের মৃত্যু হয়েছে। জেলার ডেপুটি সিভিল সার্জন ডা. মোস্তাফিজুর রহমান তুহিন এ তথ্য জানান। কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. এমএ মোমেন জানান, করোনা উপসর্গ নিয়ে জেলায় আরও সাতজন মারা গেছেন। ফরিদপুর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ডা. মো. সাইফুর রহমান জানান, ২৪ ঘণ্টায় জেলায় করোনা উপসর্গ নিয়ে জেলায় আরও ছয়জনের মৃত্যু হয়েছে। ময়মনসিংহে ২৪ ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ১৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে করোনা নিয়ে ৫ জন এবং উপসর্গ নিয়ে মারা গেছেন ১২ জন।
সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, সারা দেশে সরকারি ও বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় ৬০৫টি ল্যাবে নমুনা সংগ্রহ ও পরীক্ষা হয়েছে। এর মধ্যে আরটি-পিসিআর ল্যাব ১৩০টি, জিন এক্সপার্ট ৪৮টি, র্যাপিড অ্যান্টিজেন ৪২৭টি। এসব ল্যাবে ২৪ ঘণ্টায় নমুনা সংগ্রহ হয়েছে ৩৮ হাজার ২৪টি। মোট নমুনা পরীক্ষা হয়েছে ৩৬ হাজার ৮৫০টি। নমুনা পরীক্ষা বিবেচনায় এ পর্যন্ত শনাক্তের হার ১৪ দশমিক ৪১ শতাংশ। শনাক্ত বিবেচনায় সুস্থতার হার ৮৬ দশমিক ৫৭ এবং মৃত্যুর হার ১ দশমিক ৬০ শতাংশ। মৃতদের মধ্যে পুরুষ ১৩৩ ও নারী ৬৬ জন। ঢাকা বিভাগে ৬৫ জন, চট্টগ্রাম বিভাগে ৩৭ জন, রাজশাহী বিভাগে ১৫ জন, খুলনা বিভাগে ৫৫, বরিশাল বিভাগে তিনজন, সিলেট বিভাগে পাঁচজন, রংপুর বিভাগে নয়জন ও ময়মনসিংহ বিভাগে ১০ জন রয়েছেন। করোনা নিয়ন্ত্রণে চলমান লকডাউনের পরিবর্তে কারফিউ বা ১৪৪ ধারার মতো কঠোর কর্মসূচি ঘোষণা করা প্রয়োজন বলে মনে করেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নন-কমিউনিকেবল ডিজিজ কন্ট্রোল এনসিডিসি পরিচালক ও অধিদপ্তরের মুখপাত্র অধ্যাপক ডা. রোবেদ আমিন। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় তিনি এ কথা বলেন। তিনি বলেন, দেশে কঠোর লকডাউন চলছে কিন্তু মানুষের চলাফেরা বা জমায়েত নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হচ্ছে না। পরিস্থিতি এভাবে চলতে থাকলে করোনার ভয়াবহ সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। এক্ষেত্রে দেশের মানুষ কারফিউ বা ১৪৪ ধারার মতো কর্মসূচিগুলো ভয় পায় এবং প্রতিপালনের চেষ্টা করে। এই পরিস্থিতিতে এ ধরনের কর্মসূচি দিলে করোনা নিয়ন্ত্রণে যথেষ্ট সহায়ক হবে। এর আগে ডেল্টা ধরনের বিস্তারে দেশে কোভিড সংক্রান্ত জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটি দুই সপ্তাহের শাটডাউনের (সব বন্ধ) সুপারিশ করে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ১ জুলাই থেকে এক সপ্তাহের জন্য সরকার সারা দেশে কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করে। দেয়া হয় ২১টি নির্দেশনা। এ সময়ে জরুরি সেবা ছাড়া অন্যসব অফিস-আদালত বন্ধ, যান্ত্রিক যানবাহনে যাত্রী বহনও নিষিদ্ধ। তবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে খোলা আছে শিল্পকারখানা এবং সীমিত আকারে খোলা আছে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান। বিধিনিষেধ বাস্তবায়নে পুলিশ, র্যাব, বিজিবির পাশাপাশি ‘আর্মি ইন এইড টু সিভিল পাওয়ার’ বিধানের আওতায় মাঠে আছে সশস্ত্রবাহিনী। জনসাধারণকে অতি জরুরি প্রয়োজন ছাড়া বাইরে যেতে নিষেধ করা হচ্ছে। রাস্তায় বেরিয়ে যৌক্তিক ব্যাখ্যা দিতে না পারলে করা হচ্ছে গ্রেফতার জরিমানা।