যেভাবে মানুষ ইচ্ছেমতো ঘুরে বেড়াচ্ছে তাতে সংক্রমণ আরও বাড়ার শঙ্কা
স্টাফ রিপোর্টার: বিশ্ব করোনাভাইরাসের ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের ভয়াবহতা কাটিয়ে উঠতে না উঠতে এবার দেখা দিয়েছে ওমিক্রন। বিশ্বের ৬৫টি দেশে ছড়িয়ে পড়েছে করোনার এই ভ্যারিয়েন্টটি। সারাবিশ্বই এ নিয়ে উদ্বেগের মধ্যে রয়েছে। বাংলাদেশও ৬৬তম দেশ হিসেবে ওমিক্রন আক্রান্ত দেশের তালিকায় নাম লেখালো। দুই নারী ক্রিকেটারের আক্রান্তের মধ্য দিয়ে ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্টে সংক্রমিতের তালিকায় এখন বাংলাদেশ। এই পরিস্থিতিতে করোনার নতুন এই ভ্যারিয়েন্ট ঠেকাতে গুচ্ছ পরিকল্পনা তৈরি করা হয়েছে অনেক আগেই। এক্ষেত্রে করোনা বিষয়ক জাতীয় কারিগরী পরামর্শক কমিটির পরামর্শ আমলে নিয়ে কাজ শুরু করা হয়েছে। স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক সাম্প্রতিক সময়ে বলেছিলেন, করোনার এই ভ্যারিয়েন্টটি যাতে দেশে আসতে না পারে সেজন্য বেশ কিছু ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। আফ্রিকার সঙ্গে সব যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। তিনি বলেছিলেন, ওমিক্রনে যদি বেশি আক্রান্ত হয়ে যায় তাহলে সামাল দেয়া কঠিন হয়ে যাবে। তাই সবাইকে সাবধানে থাকতে হবে। দেশের হাসপাতালগুলোকে প্রস্তুত রাখা হয়েছে। সে সময় মন্ত্রী বলেন, যারা সাম্প্রতিক সময়ে আফ্রিকা থেকে এসেছেন তারা পালিয়ে আছেন। বাড়িতে গিয়েও তাদের পাওয়া যাচ্ছে না। মোবাইল ফোন বন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। এই অবস্থায় দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে করোনার এই ভ্যারিয়েন্ট ছড়িয়ে পড়ার বিষয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী।
ঠিক এই অবস্থায় বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আমাদের দেশের মানুষ হয়তো ভুলেই গেছে করোনা এখনো পৃথিবীতে আছে। যেভাবে মানুষ ইচ্ছেমতো ঘুরে বেড়াচ্ছে তাতে সংক্রমণ বাড়তেও পারে। প্রত্যেককে মাস্ক অবশ্যই পরতে হবে। তারা আরও বলেন, বর্তমানে যারা করোনা আক্রান্ত হচ্ছে তাদের লক্ষণ দেখে জিনোম সিকোয়েন্স করা প্রয়োজন। এটি করলে প্রকৃত অবস্থা বেরিয়ে আসবে। যাদের সন্দেহ হচ্ছে তাদের লক্ষণ নিয়ে এই পরীক্ষাগুলো চালাতে হবে। যদিও এটি বেশ ব্যয়বহুল। তারপরও সরকারকে এটি বহন করতে হবে। বিশেষজ্ঞরা আরও বলেন, বিদেশ থেকে আসা যাত্রীদের কোয়ারেন্টিন ও আইসোলেশন নিশ্চিত করতে হবে। এই প্রক্রিয়াটিতে কঠোর হতে না পারলে পরিস্থিতি নাগালের বাইরে চলে যেতে পারে। তারা বলেন, ইউরোপ ও ইন্ডিয়া আমাদের জন্য বড় হুমকি। তাই এসব দেশ থেকে যারা আসবে তাদের বিষয়ে বিশেষ নজরদারি করতে হবে। এছাড়া সীমান্ত দিয়ে যারা অবৈধভাবে ভারত থেকে আসবে তাদেরকেও ট্রেস করতে হবে। যদিও কাজটি খুবই কঠিন। ৬৬তম দেশ হিসেবে করোনার নতুন ভ্যারিয়েন্ট ওমিক্রন আক্রান্ত দেশ হিসেবে নাম লেখালো বাংলাদেশ। আইসিসি ওয়ানডে বিশ্বকাপ বাছাইপর্বের টুর্নামেন্ট শেষে ১ ডিসেম্বর দেশে ফেরে বাংলাদেশ নারী ক্রিকেট দল। দেশে ফিরে রাজধানীর একটি পাঁচ তারকা হোটেলে ৫ দিনের কোয়ারেন্টিনে প্রবেশ করেন ক্রিকেটাররা। তাদের দু’জনের শরীরে পাওয়া যায় ওমিক্রন। আফ্রিকার দেশ বতসোয়ানা থেকে করোনাভাইরাসের নতুন ধরন ছড়িয়ে পড়ার কারণে টুর্নামেন্টের মাঝপথেই বিশ্বকাপের বাছাইপর্ব বাতিল করতে বাধ্য হয় আইসিসি।
রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) পরিচালক অধ্যাপক ডা. তাহমিনা শিরীন বলেন, ‘আমরা করোনায় আক্রান্ত বিভিন্ন মানুষের লক্ষণ দেখে জিনোম সিকোয়েন্সিং করছি। খেলোয়াড়দেরও জিনোম সিকোয়েন্সিং করা হয়েছে। তাদের দুইজনের শরীরে করোনাভাইরাসের নতুন এই ভ্যারিয়েন্ট পেয়েছি।’ তিনি আরও বলেন, যারা বিদেশ থেকে আসছেন তাদের কঠোরভাবে কোয়ারেন্টাইন করতে হবে। পরিবারের সদস্যরা অবশ্যই বিদেশ থেকে আসা প্রবাসীদের কাছে যাবেন না। অন্তত ১৪ দিন বা তার বেশি। কোভিড টেস্ট না করে প্রবাসীদের কোয়ারেন্টিন শেষ না করার কথাও জানান তিনি।
ওমিক্রন শনাক্ত হওয়া নিয়ে রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা আলমগীর হোসেন বলেন, গত সোমবার সন্ধ্যায় দুজনের নমুনা নেয়া হয়। পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে তাদের শরীরে ওমিক্রন শনাক্ত হয়েছে। জিনোম সিকোয়েন্সিং করার পর শনাক্ত হওয়ার বিষয়টি জানা গেছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা নিয়মিত খেলোয়াড়দের শারীরিক পরিস্থিতির দিকে খেয়াল রাখছেন। তবে সবাইকে যথেষ্ট সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। বিশেষ করে বৃদ্ধদের, যাদের ডায়াবেটিস, হার্ট, হাঁপানি, এজমা রোগ রয়েছে। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. রশীদ-ই-মাহবুব বলেন, খেলোয়াড়রা দেশে এসেছেন এটা ঠিক, তবে তারা তো কোয়ারেন্টিনে আছেন। কিন্তু যারা পালিয়ে আছেন তাদের বিষয়ে কি হবে। আফ্রিকা থেকে এসে যারা পালিয়ে বেড়াচ্ছেন তাদের ধরে এনে কোয়ারেন্টিন করাতে হবে। তিনি আরও বলেন, এটি অতিদ্রুত সংক্রমণ ঘটাতে পারে। তবে এতে মৃত্যু ঝুঁকি কম। তাই চিন্তিত হওয়ার কিছু নেই। কিন্তু স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে। সবাইকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। যদি বেশি ছড়িয়ে পড়ে তাহলে মৃত্যু বাড়বেই। এই জনস্বাস্থ্যবিদ বলেন, ইউরোপ ও ইন্ডিয়া আমাদের জন্য খুব বড় সমস্যা। এই দুই দেশ থেকে যারা আসবে তাদের মাধ্যমেই মূলত ছড়াবে। তাই এসব দেশে থেকে আসা যাত্রীদের বাধ্যতামূলক কঠোর কোয়ারেন্টিনে রাখতে হবে। প্রয়োজনে প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিন করতে হবে, তাও সরকারের তত্ত্বাবধানে। তিনি আরও বলেন, ইন্ডিয়া থেকে আমাদের দেশে যারা বিমানবন্দর ও স্থল বন্দর দিয়ে আসে তাদের হয়তো দেখভালো করা সম্ভব। কিন্তু যারা সীমান্ত ডিঙ্গিয়ে চোরাপথে আসেন তাদের বিষয়ে কি করবেন? এই লোকগুলোকে ট্রেস করতে হবে। তাদের কোয়ারেন্টিনে আনতে হবে। না হলে ওমিক্রন ডেল্টার চাইতেও বেশি বিস্তার লাভ করবে। দেশের এয়ারপোর্টগুলোতে আফ্রিকান দেশগুলোর জন্য সিল মারা হয়েছে। এটা খুবই ভালো সিদ্ধান্ত ছিলো। এখন ইউরোপের জন্যও তাই করা উচিত। এখন আমাদের আরেক সমস্যার নাম ইউরোপ। সেখানে প্রচুর রোগী আছে ওমিক্রনের। এসব দেশ থেকেও মানুষ এসে ভ্যারিয়েন্টটি ছড়াতে পারে। তাই এই বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হবে।