সংবিধান ও আইন অনুযায়ী নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালনের প্রত্যয়
স্টাফ রিপোর্টার: নির্বাচন কমিশন (ইসি) গঠনের লক্ষ্যে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের বিচারপতি ওবায়দুল হাসানকে প্রধান করে (সভাপতি) ৬ সদস্যের সার্চ কমিটি গঠন করা হয়েছে। রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের আদেশক্রমে মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম শনিবার এ প্রজ্ঞাপন জারি করেন। এর আগে শুক্রবার এই অনুসন্ধান কমিটির অনুমোদন দিয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠায় বঙ্গভবন। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন- হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি এস এম কুদ্দুস জামান, বাংলাদেশের মহা হিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক মোহাম্মদ মুসলিম চৌধুরী, সরকারি কর্মকমিশন চেয়ারম্যান মো. সোহরাব হোসাইন, সাবেক নির্বাচন কমিশনার ছহুল হোসাইন এবং কথাসাহিত্যিক অধ্যাপক আনোয়ারা সৈয়দ হক।
এদিকে, সার্চ কমিটির সভাপতির পদ পাওয়ায় তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় ওবায়দুল হাসান বলেন, ‘মহামান্য রাষ্ট্রপতি আমার এবং সার্চ কমিটির সদস্যদের ওপর যে আস্থা রেখেছেন সেজন্য ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। আমরা সংবিধান ও আইন অনুযায়ী নিষ্ঠার সঙ্গে আমাদের দায়িত্ব পালন করবো।’ শিগগিরই কমিটির অন্য সদস্যদের নিয়ে বৈঠক করার কথাও জানান আপিল বিভাগের এই বিচারপতি। প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, এই অনুসন্ধান কমিটি ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ আইন, ২০২২’ মোতাবেক দায়িত্ব ও কার্যাবলি সম্পন্ন করবে। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ অনুসন্ধান কমিটির কার্য সম্পাদনে প্রয়োজনীয় সাচিবিক সহায়তা প্রদান করবে। বর্তমান নির্বাচন কমিশনের মেয়াদ ১৪ ফেব্রুয়ারি শেষ হচ্ছে। ইসি গঠনে নতুন আইন অনুযায়ী, সার্চ কমিটি গঠনের ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে রাষ্ট্রপতির কাছে যোগ্য ব্যক্তিদের নাম প্রস্তাব করতে হবে কমিটিকে। সার্চ কমিটি প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) ও কমিশনারদের প্রতি পদের জন্য ২ জন করে ১০ জনের নাম প্রস্তাব করবে। এ ১০ জনের মধ্য থেকে সিইসিসহ পাঁচজনকে দিয়ে ইসি গঠন করবেন রাষ্ট্রপতি। স্বাধীনতার পর এবারই প্রথমবারের মতো আইনানুযায়ী ইসি গঠিত হচ্ছে। এজন্য কিছুদিন আগে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ বিল-২০২২ জাতীয় সংসদে পাস হয়। এরপর রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের সম্মতির পর গত রোববার বিলটি গেজেট আকারে প্রকাশিত হয়। অর্থাৎ এটি আইনে পরিণত হয়। অনুসন্ধান কমিটির কাজ সম্পর্কে আইনে বলা হয়েছে, এই কমিটি স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতার নীতি অনুসরণ করে দায়িত্ব পালন করবে। আইনে বেধে দেয়া যোগ্যতা, অযোগ্যতা, অভিজ্ঞতা, দক্ষতা ও সুনাম বিবেচনা করে সিইসি ও নির্বাচন কমিশনার পদে নিয়োগের জন্য রাষ্ট্রপতির কাছে সুপারিশ করা হবে। এর আগে নির্বাচন কমিশন গঠনের লক্ষ্যে দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংলাপ করেন রাষ্ট্রপতি। সংলাপে অংশ নিয়ে দলগুলো তাদের মতামত ও প্রস্তাব উপস্থাপন করে। তবে বিএনপি সংলাপে অংশ নেয়নি। এর আগে নির্বাচন কমিশন গঠনে ২০১২ ও ২০১৭ সালে সার্চ কমিটি হয়েছিল। প্রথম দুবারই রাষ্ট্রপতির বিশেষ আদেশে সার্চ কমিটি গঠন হয়েছিল। এবার নতুন আইনের অধীনে সার্চ কমিটি হলেও গতবারের কাঠামোকেই অনুসরণ করা হয়েছে।
বিচারপতি ওবায়দুল হাসান: সার্চ কমিটির প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান বাংলাদেশের আপিল বিভাগে কর্মরত। তিনি এই দায়িত্ব গ্রহণ করেন ২০২০ সালের তেসরা সেপ্টেম্বর। নেত্রকোনার মোহনগঞ্জে জন্ম নেয়া ওবায়দুল হাসান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিএসএস (সম্মান) এবং এমএসএস (অর্থনীতি) পরে আইনে এলএলবি করেন। এরপর ১৯৮৬ সালে আইনজীবী হিসেবে পেশা জীবন শুরু করেন। তিনি জেলা আদালত, হাইকোর্ট ও আপিল বিভাগে আইনজীবী হিসেবে দীর্ঘদিন কাজ করেন। ২০০৯ সালে তিনি হাইকোর্টের অতিরিক্ত বিচারপতি এবং ২০১১ সাল থেকে বিচারপতি হিসেবে কাজ শুরু করেন। তার আগে ২০১২ সালের ২৫ মার্চ থেকে তিনি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ এর বিচারক হিসেবে যোগ দেন। সেই বছরের ১৩ ডিসেম্বর থেকে ২০১৫ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তিনি ওই ট্রাইব্যুনালের চেয়ারপার্সন হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
বিচারপতি এসএম কুদ্দুস জামান: বিচারপতি এসএম কুদ্দুস জামান হাইকোর্ট বিভাগে কর্মরত। তিনি ২০২০ সালের ৩০ মে এই পদে নিয়োগ পান। এর দুই বছর আগে থেকে তিনি হাইকোর্ট বিভাগের অতিরিক্ত বিচারপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন। তিনি ১৯৮৪ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি জুডিসিয়াল সার্ভিসে যোগ দেন। ১৯৯৬ সালে তিনি আইন কমিশনে যোগ দেন। বিচার ব্যবস্থা পুনর্গঠনে ১৯৯১ সাল থেকে পূর্ব তিমুরে এবং ২০০৬-২০১১ সাল পর্যন্ত সুদানে প্রেষণে বিচারক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। জেলা জজ হিসেবে পদোন্নতি পাওয়ার পর ২০১২ সালে তিনি প্রধান বিচারপতির বিশেষ কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ পান। ২০১৪-২০১৫ সাল পর্যন্ত তিনি সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্টার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ হিসেবে কর্মরত থাকার সময় ২০১৮ সালের ৩০ মে তিনি হাইকোর্ট বিভাগের অতিরিক্ত বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পান।
মোহাম্মদ মুসলিম চৌধুরী: তিনি বাংলাদেশের মহা হিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক। পদাধিকার বলে তিনি অনুসন্ধান কমিটিতে আছেন। মুসলিম চৌধুরী ২০১৮ সালের ১৫ জুলাই মহা হিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার আগে অর্থ বিভাগের সচিব ছিলেন। ১৯৮৪ সালে বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের অডিট নিরীক্ষা ও হিসাবের একজন কর্মকর্তা হিসেবে পেশাজীবন শুরু করেন। পরবর্তীতে তিনি কন্ট্রোলার জেনারেল অব অ্যাকাউন্টস, কন্ট্রোলার জেনারেল ডিফেন্স ফাইন্যান্স ও অর্থ বিভাগের উপসচিব, যুগ্ম সচিব ও অতিরিক্ত সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে হিসাব বিজ্ঞান বিভাগে পড়াশোনা করার পর যুক্তরাজ্য থেকে উচ্চতর ডিগ্রি নিয়েছেন তিনি।
মো. সোহরাব হোসাইন: বাংলাদেশ সরকারি কর্মকমিশনের (পিএসসি) চেয়ারম্যান তিনি। তিনিও পদাধিকার বলে এই কমিটির সদস্য হয়েছেন। ২০২০ সালের ২১ সেপ্টেম্বর থেকে পিএসসির চেয়ারম্যান তিনি। এই পদের দায়িত্ব নেওয়ার আগে তিনি মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের সিনিয়র সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। সেখান থেকে অবসর গ্রহণের পর তাকে সরকার পিএসসির চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ দেয়। ১৯৮৬ সালে সহকারী কমিশনার হিসেবে যোগদানের মাধ্যমে পেশাজীবন শুরু করেন মি. হোসাইন। তিনি ইউনেস্কোয় বাংলাদেশ প্রতিনিধি এবং বাংলাদেশ ইউনেস্কো জাতীয় কমিশনের মহাসচিব হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। নোয়াখালীতে জন্ম নেয়া মো. সোহরাব হোসাইন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ে পড়াশোনা করেছেন।
মুহাম্মদ ছহুল হোসাইন: সাবেক আইন সচিব ছহুল হোসাইন ওয়ান ইলেভেনের পর সর্বশেষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে যে নির্বাচন কমিশন গঠন করা হয়েছিল, সেখানে একজন কমিশনার হিসেবে নিয়োগ পেয়েছিলেন। সেই কমিশনের আয়োজনেই ২০০৮ সালের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল, যে নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে। ২০১২ সালের পাঁচই ফেব্রুয়ারি নির্বাচন কমিশনারের মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার পর থেকে তিনি অবসরে ছিলেন। তবে ২০১৮ সালের সাধারণ নির্বাচনের সময় তিনি সিলেট-১ আসনে নির্বাচন করতে মনোনয়নপত্র কিনেছিলেন বলে সেই সময় বাংলাদেশের গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়। তবে শেষ পর্যন্ত তাকে মনোনয়ন পাওয়া বা তাকে নির্বাচন করতে দেখা যায়নি। বিচারক হিসেবে পেশাজীবন শুরু করে দীর্ঘদিন জেলা জজ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন ছহুল হোসাইন।
আনোয়ারা সৈয়দ হক: কথাসাহিত্যিক ও মনোরোগ বিশেষজ্ঞ হিসেবে পরিচিতি রয়েছে আনোয়ারা সৈয়দ হকের। তিনি গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ ও শিশুসাহিত্য রচনা করেছেন। সাহিত্যে অবদানের জন্য তিনি একুশে পদক ও বাংলা একাডেমি পুরস্কার পেয়েছেন। দেশের খ্যাতনামা আরেকজন সাহিত্যিক প্রয়াত সৈয়দ শামসুল হকের স্ত্রী তিনি। ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে ১৯৬৫ সালে এমবিবিএস ডিগ্রি অর্জনের পর তিনি পাকিস্তান বিমান বাহিনীতে মেডিকেল কোরে লেফটেন্যান্ট পদে যোগ দিয়েছিলেন। ১৯৭৩ সালে তিনি বিমান বাহিনীর চাকরি থেকে ইস্তফা দিয়ে লন্ডন চলে যান। সেখানে মনোবিজ্ঞানে উচ্চতর ডিগ্রি নিয়ে এসে ঢাকা মেডিকেল কলেজে সহকারী প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন। তিনি জাতীয় মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রের পরিচালক, মানসিক স্বাস্থ্য ইন্সটিটিউটের পরিচালক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন।