স্টাফ রিপোর্টার: আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ব্যবহার করে ভোটগ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। কতটি আসনে এ মেশিন ব্যবহার করা হবে সে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে এ মাসে। বর্তমানে ইসির হাতে যেসব ইভিএম আছে তাতে ৭০-৮০টি আসনে ভোটগ্রহণ সম্ভব। রোববার নির্বাচন ভবনে নিজ কার্যালয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীর এসব তথ্য জানান। তিনি বলেন, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার করা হবে। তবে কতগুলো আসনে ইভিএম হবে সেই বিষয়ে এখনো সিদ্ধান্ত হয়নি। ইসি তার সক্ষমতা ও যৌক্তিকতা বিবেচনা করে প্রয়োজনীয় সংখ্যক আসনে ইভিএম ব্যবহার করবে। আগামী সপ্তাহে এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।
যদিও সংলাপে অংশ নেয়া জাতীয় পার্টিসহ ১৫টি রাজনৈতিক দল এ মেশিন ব্যবহারের বিরোধীতা করেছে। সংলাপে অংশ নেয়নি বিএনপিসহ এমন ৯টি দলও এ মেশিনে ভোটগ্রহণের বিরোধিতা করে আসছে। তবে আওয়ামী লীগসহ ১১টি রাজনৈতিক দল ইভিএম ব্যবহারের পক্ষে মত দেয়। এছাড়া ভোটে ইভিএম ব্যবহারের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে গত ১১ আগস্ট কমিশন সভা ডাকা হয়েছিল। কিন্তু পরে তা স্থগিত করা হয়। কমিশন সভা ছাড়াই নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীর ইভিএম ব্যবহারের এ সিদ্ধান্তের কথা জানালেন।
তার এ বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেছেন, ইভিএম জালিয়াতির মেশিন। এ মেশিনে জনগণের মতামতের প্রতিফলন ঘটবে না। নিয়ন্ত্রিত এ মেশিনে ইসি যেভাবে চাইবে সেভাবে ফলাফল প্রকাশিত হবে। তিনি বলেন, সুষ্ঠু ভোটগ্রহণে ইসি যে আন্তরিক নয়, এ সিদ্ধান্ত তারই প্রমাণ। ইভিএম কারিগরি কমিটির প্রধান প্রয়াত অধ্যাপক ড. জামিলুর রেজা চৌধুরীও এ মেশিন কেনার পক্ষে সই করেননি। ইসি কী অস্বীকার করতে পারবে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে জালিয়াতি করে দুই ধরনের ফল ঘোষণা করা হয়নি। প্রোগ্রামিংয়ের মাধ্যমে যে এ মেশিনের ফল পালটানো যায় ইসি কি তা অস্বীকার করবে? তাহলে তারা কীভাবে এমন সিদ্ধান্ত নিলেন-প্রশ্ন রাখেন তিনি।
কোনো দলের পরামর্শে জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার হচ্ছে কিনা-এমন প্রশ্নের জবাবে মো. আলমগীর বলেন, আমরা কারও মুখের দিকে তাকিয়ে সিদ্ধান্ত নেবো না। আমরা একটি সুষ্ঠু ও সুন্দর ভোট করার জন্য সক্ষমতা ও ইভিএমের সুবিধা বিবেচনা করেই সিদ্ধান্ত নেবো। তিনি বলেন, অনেকগুলো রাজনৈতিক দল ৩০০ আসনে ইভিএমে ভোট চায়। আবার কোনো কোনো দল একটি আসনেও ইভিএম চায় না। আমরা তো সবার কথা সমানভাবে গুরুত্ব দিতে পারবো না। আমরা আমাদের সক্ষমতা ও ইভিএমের যৌক্তিকতার ওপর গুরুত্ব দেবো।
বিএনপি ও জাতীয় পার্টি ইভিএমের বিপক্ষে মত দিয়েছে-এ বিষয়ে ইসির অবস্থান জানতে চাইলে তিনি বলেন, তারা কেন ইভিএমের বিপক্ষে বলেছেন সেটা আমরা বলতে পারবো না। রাজনৈতিক ব্যাপার তো খোলাসা করে বলবে না, রাজনৈতিক কৌশল থাকতে পারে। আর বিএনপি তো আমাদের আলোচনায় আসেনি। ইভিএম নিয়ে তারা যেটা প্রচার করে সেটার প্রমাণ দিতে বলেছিলাম তাও দেয়নি। আপনি যখন আদালতে এসে সাক্ষী দেবেন না, প্রমাণ দেবেন না, সেখানে আমরা কতটুকুই বা গুরুত্ব দিতে পারি? তাদের তো ক্লিয়ার করতে হবে। তিনি আরও বলেন, ইভিএমের অসুবিধার চেয়ে সুবিধা বেশি। ইভিএমের কারচুপি নিয়ে যেসব অভিযোগ তোলা হয়েছে নির্বাচন কমিশন তা প্রমাণে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিলেও কেউ সেটা প্রমাণ করতে আসেনি। বিএনপি ইভিএম নিয়ে অভিযোগ তুললেও তারা সংলাপে এসে বা অন্য কোনোভাবে ইসির কাছে লিখিত বা মৌখিক অভিযোগ না দেয়ায় তা আমলে নেয়া হয়নি। অপরদিকে অন্য দলের মধ্যে যারা ইসিতে গিয়ে ইভিএমে কারচুপির অভিযোগ দিয়েছে তা যাচাই করা হচ্ছে।
ইভিএমে ভোট কম পড়া ও কারচুপির অভিযোগ অপপ্রচার দাবি করে মো. আলমগীর বলেন, ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে ৮০ শতাংশের ভোট পড়েছে। তিনি বলেন, আপনি আমাকে বলবেন আমি খারাপ। এর তো প্রমাণ দিতে হবে। না হলে আমি খারাপ হিসেবে গণ্য হবো কেন? তার মানে এটা অপপ্রচার। যতক্ষণ না আপনি প্রমাণ দেবেন ইভিএমে ভোট কারচুপি করা যায়, ততক্ষণ পর্যন্ত তো আমি এটা বিশ্বাস করব না। কারচুপির বিষয়টি হচ্ছে অভিযোগ কিন্তু প্রমাণিত নয়। যারা অভিযোগ দিয়েছেন সেগুলো আমরা যাচাই করছি। কিন্তু যারা আমাদের কাছে এসে অভিযোগ দেননি সেটা তো আমরা আমলে নেইনি।
ইভিএমের সুবিধা-অসুবিধার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ব্যালটে ভোটগ্রহণ করে সারারাত ধরে ভোট গণনা করবেন। একবার ভুল হবে দশবার গণনা করবেন। ইভিএমে এসব ঝামেলা নেই। এতে অনেকগুলো সুবিধা আছে। আবার অসুবিধা আছে অনেকের আঙুলের ছাপ মেলে না। যাদের আঙুলের ছাপ মেলে না তাদের জন্য তো একটি পদ্ধতি আছে। অনেকে বিশেষ করে বয়স্করা কীভাবে ব্যবহার করতে হয় তা বুঝে উঠতে পারেন না। মেশিন দেখে তারা ঘাবড়িয়ে যান। অনেক সময় মনে হয় এটা স্লো। তবে আসলে মেশিনটা স্লো নয়। যারা জানেন তাদের ভোট দিতে ১৫ সেকেন্ড লাগে। এতে একজনের ভোট অন্যজন দিয়ে দিতে পারে না। ব্যালটে যেমন একজনের ভোট আরেকজন দিতে পারে। ইভিএমে সেই সুযোগ নেই।
কতটি আসনে ইভিএম ব্যবহার করা হবে এমন প্রশ্নের জবাবে মো. আলমগীর বলেন, ইভিএম ব্যবহার হবে। কিন্তু কত আসনে হবে সেই বিষয়ে আমরা এখনো সিদ্ধান্ত নিতে পারিনি। এটা নিয়ে আমরা মতবিনিময় করছি। আলোচনা করছি। আমাদের সক্ষমতা কী, কত ইভিএম আছে। আমাদের প্রশিক্ষিত জনবল কত আছে? সাপোর্টিং জনবল কত আছে? এগুলো দেখছি। এগুলো দিয়ে কত আসনে ভোট করা যাবে তা দেখা হচ্ছে। আরও যদি বেশি করতে চাই। আরও কত (ইভিএম মেশিন) লাগবে। তাতে কত টাকা লাগবে। এজন্য নতুন প্রজেক্ট নিতে হবে কিনা? সেই সময় আমাদের আছে কিনা? এসব বিষয় বিবেচনা করা হচ্ছে।
ভোট বাতিলের বিধান যুক্ত করে আরপিও সংশোধনের প্রস্তাব: বড় ধরনের অনিয়মের তথ্য এলে নির্বাচন কমিশন ভোট বাতিল করতে পারবে-এমন বিধান যুক্ত করে আরপিও সংশোধনের জন্য সরকারের কাছে পাঠানো হয়েছে বলে জানান মো. আলমগীর। তিনি বলেন, আমাদের আরপিও সুষ্ঠু নির্বাচন করার জন্য যথেষ্ট। তারপরও কিছু কিছু জায়গায় একটু অস্পষ্টতা আছে। আমাদের মনে হয়েছে পরিবর্তীত পরিস্থিতিতে কিছু কিছু জায়গায় সংশোধন করা হয় বিষয়টি আরও ভালো হবে। কমিশন মনে করেছে অল্প কয়েকটি জায়গায় পরিবর্তন বা সংশোধন করতে পারলে সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য বর্তমানে চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করা সহজ হবে। নির্বাচনে গুরুতর কোনো অনিয়ম হলে ওই নির্বাচন স্থগিত করতে পারে নির্বাচন কমিশন। কিন্তু ওই নির্বাচন বাতিলের ক্ষমতা বিদ্যমান আরপিওতে নেই।
তিনি বলেন, রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংলাপ, বিভিন্ন নির্বাচনের অভিজ্ঞতা এবং যেসব চ্যালেঞ্জ রয়েছে তার আলোকে আমরা মনে করেছি, ব্যাপক অনিয়ম হলে ওই নির্বাচন বাতিল করে পুনরায় নির্বাচন করতে হবে। সে কারণে নির্বাচন বাতিল করার ক্ষমতা ইসির হাতে থাকা উচিত। তবে কেউ অভিযোগ করলেই বাতিল হবে তা নয়। ইসির কাছে যথেষ্ট প্রমাণ থাকতে হবে। এরপর যথাযথভাবে তদন্ত হবে এবং প্রমাণ সাপেক্ষে কমিটির সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে তা বাতিল করে নতুন নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হবে। বিদ্যমান ব্যবস্থায় রিটার্নিং অফিসার ফলাফল ঘোষণা করলে তা আর বাতিল করার সুযোগ নেই। এই বিধান যুক্ত হওয়ার পর আমরা যদি যৌক্তিক ক্ষেত্রে সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা না নিই তাহলে রাজনৈতিক দলগুলো আমাদের লায়াবেল করতে পারবে।
আদমশুমারির চূড়ান্ত রিপোর্ট পেলে সীমানা পুননির্ধারণ: মো. আলমগীর বলেন, আমরা আদমশুমারির প্রাথমিক রিপোর্ট পেয়েছি। চূড়ান্ত রিপোর্ট পাইনি। আমাদের হোমওয়ার্ক চলছে। তথ্য সংগ্রহ চলছে। আদমশুমারির চূড়ান্ত রিপোর্ট পেলেই সীমানা পুনঃনির্ধারণের উদ্যোগ নেয়া হবে। আইনের বিধান অনুযায়ী তিনটি শর্তের আলোকে আমরা এটা করবো। এ বিষয়ে আমাদের হাতে যথেষ্ট সময় আছে। হোমওয়ার্ক করে রাখছি। ফাইনাল রিপোর্ট পাওয়ার পরের সপ্তাহ থেকে কাজ শুরু হবে।
এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সীমানায় ব্যাপক পরিবর্তন হবে কী হবে না সে বিষয়ে কিছুই বলা যাবে না। আইন অনুযায়ী যা আসবে তাই হবে। আমরা তো আইনের বাইরে যেতে পারবো না।