স্টাফ রিপোর্টার: তাবলিগ জামাতের সবচেয়ে বড় আসর বিশ্ব ইজতেমার প্রথম দিন শুক্রবার টঙ্গীর তুরাগ তীরে সমবেত লাখো মুসল্লি জুমার নামাজ আদায় করেছেন। নামাজের জন্য নির্ধারিত মাঠে স্থান সংকুলান না হওয়ায় এদিন মহাসড়ক ও অলিগলিসহ খোলা স্থানে জায়নামাজ, পুরনো পত্রিকা, হোগলা-পাটি, চটের বস্তা বিছিয়ে জুমার নামাজে শরিক হতে দেখা যায় মুসল্লিদের। এ সময় ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে প্রায় দেড় ঘণ্টা যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকে। সৃষ্টি হয় তীব্র যানজটের। এদিকে, বিশ্ব ইজতেমা ময়দানে আসা মুসল্লিরা ঠান্ডাজ্বরে আক্রান্ত হচ্ছেন। এছাড়া রান্নাসহ বিভিন্ন কাজে ময়লা পানি ব্যবহার করায় ডায়রিয়াসহ নানা রোগ ছড়িয়ে পড়ছে। আক্রান্তরা ইজতেমা মাঠের পাশে ফ্রি মেডিকেল ক্যাম্প ও টঙ্গী শহীদ আহসান উল্লাহ মাস্টার জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। অন্যদিকে, ইজতেমা মাঠ নিরাপত্তার চাদরে ঢাকা দাবি করে গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের (জিএমপি) কমিশনার মোল্লা নজরুল ইসলাম বলেছেন, ‘ইজতেমা ময়দানে প্রচুর মানুষ আসছে; স্রোতের মতো। আইনশৃঙ্খলাসহ সবকিছু এখন পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণে আছে। ইতোমধ্যে প্রায় ১০ লক্ষাধিক মানুষ ইজতেমা ময়দানে সমবেত হয়েছেন। আমরা প্রত্যাশা করছি, এরিয়াটা নিরাপত্তার চাদরে যেহেতু ঢেকে দিয়েছি, সুতরাং কোনোরকম কোনো অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ঘটবে না।’ জিএমপি কমিশনার বলেন, ‘ভবিষ্যতেও কোনো ধরনের নাশকতা, ছিনতাই ও রাহাজানির ঘটনা ঘটবে না বলে আমরা প্রত্যাশা করছি। ধর্মপ্রাণ মুসল্লিরা যাতে আল্লাহর ধ্যানে মগ্ন হতে পারেন, জুমার দিনে সবাই মিলে যেন শান্তিপূর্ণভাবে একসঙ্গে নামাজ আদায় করতে পারি, সেদিকে লক্ষ্য রেখে পুলিশ সতর্ক অবস্থায় রয়েছে। এ পর্যন্ত প্রায় ২ হাজারের মতো বিদেশি অতিথি ময়দানে এসেছেন। তিন শতাধিক সিসিটিভি ক্যামেরা দিয়ে ইজতেমা মাঠ ঢেকে দেয়া হয়েছে। আইনশৃঙ্খলার বিভিন্ন সংস্থা মিলে একযোগে কাজ করছি।’ মাঠের ১ নম্বর খিত্তায় থাকা গাজীপুরের ভোগড়া এলাকার বাসিন্দা মাসুদ রানা বলেন, পাশের ১৩ ও ১৪ নম্বর টয়লেট ভবনের সামনে থাকা হাউসের পানি ময়লা। ময়লাগুলো অধিকাংশ সময় ভাসতে দেখা যায়। ময়মনসিংহ থেকে আসা মোবারক হোসেন বলেন, ইজতেমা মাঠের ভেতরে জায়গা না পাওয়ায় ফুটপাতসহ রাস্তার আশপাশে খোলা জায়গায় পলিথিন কিংবা ত্রিপল টাঙিয়ে লোকজন অবস্থান করছেন। এতে শীত ও কুয়াশার কারণে তিনিসহ অনেকেই জ্বর ও ঠান্ডায় আক্রান্ত হয়েছেন। ধুলোবালির কারণে অনেকে অ্যাজমাতেও ভুগছেন। ইজতেমা ময়দানে হামদর্দ ফ্রি মেডিকেল ক্যাম্পের কর্তব্যরত চিকিৎসক মো. খোরশেদ আলম জানান, এখন পর্যন্ত ইজতেমায় আসা প্রায় দুই হাজার মানুষকে তারা চিকিৎসা দিয়েছেন। তাদের অধিকাংশই ডায়রিয়া, অ্যাজমা ও জ্বরে আক্রান্ত। টঙ্গীর শহীদ আহসান উল্লাহ মাস্টার জেনারেল হাসপাতালের পরিচালক মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম বলেন, শুক্রবার দুপুর পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় ইজতেমায় আসা ১ হাজার ৩১৩ জন হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন। জুমার নামাজের সময় অনেক মুসল্লিকে পলিথিনের তৈরি জায়নামাজ সংগ্রহ করতে দেখা গেছে। অজুর পানি ফ্রিতে পেলেও পলিথিনের জায়নামাজ সংগ্রহের জন্য ১০ টাকা করে দিতে হয়েছে তাদের। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নামাজের জন্য অজুর পানি সরবরাহ করছে চীনের একটি প্রতিষ্ঠান। তবে প্রতিষ্ঠানটির নাম প্রকাশ করতে অনিচ্ছুক দায়িত্বরত কর্মী শাওন। তিনি বলেন, ‘ম্যানেজার স্যার আমাদের নির্দেশ দিয়েছেন অজুর পানি সরবরাহ করতে। আমরা তাই করছি।’ ইজতেমা ময়দানে জুমার নামাজে শরিক হতে আসা শরিফ বলেন, ‘এসব কাগজ ও পলিথিন আমরা ফেলে দেই। আর এখানে এসে নিরূপায় হয়ে ১০ টাকা দিয়ে কিনতে হচ্ছে।’ গাজীপুর প্রতিনিধি জানান, শুক্রবার বাদ ফজর তাবলিগ জামাতের শীর্ষস্থানীয় পাকিস্তানের মুরব্বি মাওলানা জিয়াউল হকের আমবয়ানের মধ্যদিয়ে ইজতেমার আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু হয়। পরে বাংলাদেশ ও ভারতের তাবলিগ মারকাজের শূরা সদস্য, বুজুর্গরা ঈমান, আমল ও দাওয়াতের মেহনত সম্পর্কে ফজিলতপূর্ণ বয়ান করেন। মূল বয়ান উর্দুতে হলেও বাংলা, ইংরেজি, আরবি, তামিল, মালয়, তুর্কি ও ফরাসিসহ বিভিন্ন ভাষায় তাৎক্ষণিক অনুবাদ করা হয়। আয়োজকরা জানান, বিশ্ব ইজতেমার কর্মসূচির মধ্যে আম ও খাস বয়ান, তালিম, তাশকিল, ৬ উছুলের হাকিকত, দরসে কোরআন, দরসে হাদিস, চিল্লায় নাম লেখানোসহ নতুন জামাত তৈরি হবে। দুপুর দেড়টায় জুমার নামাজে ইমামতি করেন বাংলাদেশের মাওলানা জুবায়ের। ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে যানজট বিশ্ব ইজতেমা জুমার নামাজ উপলক্ষ্যে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে যান চলাচল প্রায় দেড় ঘণ্টা বন্ধ থাকে। জুমার নামাজে অংশ নিতে আসা লাখ লাখ মুসল্লির উপস্থিতিতে ইজতেমা মাঠ পূর্ণ হয়ে গেলে মুসল্লিরা পার্শ্ববর্তী কামাড়পাড়া সড়ক, ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে অবস্থান নেন। টঙ্গী বাজার থেকে বাটা গেট, স্টেশন রোড, কামারপাড়া রোড হয়ে টঙ্গীর মিলগেট পর্যন্ত মুসল্লিরা অবস্থান নেন। এতে ওইসব পথে গাড়ি চলাচল সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়। গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার মোল্লা নজরুল ইসলাম বলেন, ‘ইজতেমায় জুমার নামাজ পড়ার জন্য লাখ লাখ মুসল্লি এসেছেন। তারা মহাসড়কে অবস্থান নিয়েছেন। এজন্য আব্দুল্লাহপুর থেকে গাজীপুরমুখী মহাসড়ক যান চলাচল সাময়িক বন্ধ করে দেয়া হয়। তখন কামারপাড়া রোডও বন্ধ করে দেয়া হয়।’ ইজতেমা মাঠে অজুর পানি ২০-৩০ টাকা, নামাজের পেপার ১০ টাকা। গতকাল শুক্রবার সকাল থেকে শুরু হয়েছে বিশ্ব ইজতেমার ১ম পর্ব। ইতোমধ্যে লাখ লাখ মানুষ সমাবেত হয়েছেন ইজতেমা মাঠ ও আশপাশে। বিপুল পরিমাণ মানুষের অজুর পানির দেখা দিয়েছে সংকট। মহাসড়ক ও বিভিন্ন রাস্তায় অবস্থানরত মুসল্লিদের অজুর পানির জন্য খরচ করতে হচ্ছে ২০ থেকে ৩০ টাকা এবং নামাজের জন্য পেপার বিক্রি হচ্ছে ১০ থেকে ১৫ টাকায়। অজুর জন্য এক বদনা পানি বিক্রি হচ্ছে ১৫ থেকে ২০ টাকা এবং পানির বোতল বিক্রি হচ্ছে ৩৫ থেকে ৪০ টাকা। এছাড়াও রাস্তায় নামাজ পড়ার জন্য পেপার কিনতে হচ্ছে ১০ থেকে ১৫ টাকা করে। টঙ্গী স্টেশন রোড ও কামারপাড়া রোডের মাথায় শত শত মানুষ এসব পানি বিক্রি করছেন। স্থানীয় দোকানদারসহ আশপাশের লোকজন এই সুযোগে ব্যবসা করছেন। তবে পুরো এলাকা ঘুরে এক জায়গাতেও ফ্রিতে পানি পাওয়া যাচ্ছে না। পানি বিক্রেতা আবু তালেব বলেন, কিছুই করার নেই সবাই বিক্রি করছে আমিও করছি। এখন এত মানুষ ফ্রি পানি কোথায় পাবে। পেপার বিক্রেতা জহির উদ্দিন জানান, ‘আমরাও পেপার ও কাগজ কিনে এনেছি। এখন লাভে বিক্রি করছি।’ গাজীপুর জেলা প্রশাসক আনিসুর রহমান জানিয়েছেন, ইজতেমার সার্বিক নিরাপত্তায় কাজ করছেন ৩০ জন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট। মুসল্লিদের ব্যবহারের জন্য ৩১টি ভবনে রয়েছে ৮ হাজার ৮৮৪টি শৌচাগার এবং ৫৪৪টি গোসলখানা। পানি সরবরাহ করা হচ্ছে ১৬টি গভীর নলকূপের সাহায্যে। ৪টি এগারো কিলোভোল্ট ফিডারের সাহায্যে বিদ্যুৎ সরবরাহ নিরবচ্ছিন্ন রাখা হয়েছে। পাশাপাশি ৪টি জেনারেটর প্রস্তুত রয়েছে। মুসল্লিদের যাতায়াতের সুবিধার্থে ৫ জোড়া বিশেষ ট্রেন চালু থাকবে। এছাড়াও মুসল্লিদের পারাপারের জন্য বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ৫টি ভাসমান সেতু নির্মাণ করেছে। উল্লেখ্য, এবার প্রথম পর্বের ইজতেমায় অংশ নিচ্ছেন মাওলানা জোবায়েরের অনুসারীরা। আর দিল্লির মাওলানা সাদ কান্ধলভীর অনুসারীরা অংশ নেবেন দ্বিতীয় পর্বের ইজতেমায়। এবারের ইজতেমায় অন্য কয়েক বছরের তুলনায় লোকজনের সমাগম একটু বেশি। মূল ময়দানে জায়গা না পেয়ে অনেক মানুষ শীত উপেক্ষা করে ময়দানের বাইরে ফুটপাতে ও টয়লেট বিল্ডিংয়ের ছাদে খোলা আকাশের নিচে অবস্থান নিয়েছেন।