স্টাফ রিপোর্টার: বাংলাদেশের সর্বশেষ জনসংখ্যা ও আবাসন শুমারি অনুযায়ী প্রতি ১০০ জন নারীর বিপরীতে পুরুষের সংখ্যা ৯৯ জন। অর্থাৎ দেশের জনসংখ্যার অর্ধেকেরও বেশি অংশই নারী। কিন্তু বাস্তবতা হলো, নারীরা প্রতিনিয়ত কোনো না কোনোভাবে নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। ২০২৪ সালে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) ও জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিলের (ইউএনএফপিএ) জরিপ অনুযায়ী, দেশের ৭০ শতাংশ নারী জীবনে একবার হলেও শারীরিক, যৌন, মানসিক ও অর্থনৈতিক সহিংসতার শিকার হন। এছাড়া, এখনো নারীরা নিজের সিদ্ধান্ত নিজে নিতে পারেন না। নারীদের শ্রমের মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হয়নি, নারীকে সম্মান দেখানোর জন্য পরিবর্তন হয়নি পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গির। ঘরে-বাইরে প্রতিনিয়ত নির্যাতনের শিকার হয়ে নারীর আত্মহত্যার ঘটনাও বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় আমাদের দেশে বেশি। আর এমন বাস্তবতায় ‘অধিকার, সমতা, ক্ষমতায়ন নারী ও কন্যার উন্নয়ন’ প্রতিপাদ্যে বিশ্বের অন্য দেশের মতো আমাদের দেশেও পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক নারী দিবস। গত ফেব্রুয়ারি মাসে বিবিএস ও ইউএনএফপিএ’র যৌথ জরিপ প্রতিবেদনে বলা হয়, নারীর জীবদ্দশায় স্বামী বা জীবনসঙ্গীর মাধ্যমে সহিংসতার বিস্তৃতি এখনো ৭০ শতাংশ। অর্থাৎ এটি উচ্চমাত্রায় রয়েছে। তবে, বিগত ১২ মাসে এই হার ৪১ শতাংশ। এই হার ২০১৫ সালে জীবদ্দশায় ছিল ৭৩ শতাংশ। নন-পার্টনার সহিংসতার চেয়ে জীবনসঙ্গী বা স্বামীর মাধ্যমে সহিংসতা (আইপিভি) বিস্তারের মাত্রা বেশি। এছাড়া, বিভিন্ন সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী, সাম্প্রতিক সময়ে নারীর প্রতি নির্যাতনের প্রধান ধরনের মধ্যে ধর্ষণ সবার শীর্ষে। পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৮ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত এই সময়ে দেশে মোট ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ২৭ হাজার ৪৭৯টি-যার মানে প্রতি বছর গড়ে ৫ হাজারেরও বেশি নারী ধর্ষণের শিকার হচ্ছেন। একই সময়ে দেশে ৫৯ হাজার ৯৬০টি নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে, যা শুধু নারীর প্রতি সহিংসতার মাত্রাকে প্রকাশ করে না, বরং সামাজিক ও আইনি ব্যবস্থার অক্ষমতা এবং অপরাধীদের শাস্তি না হওয়ার বিষয়টিও তুলে ধরে। ২০২৪ সালে যৌতুকের দাবিতে ৩৬ জন নারী হত্যার শিকার হয়েছেন- যা সমাজ ও দেশের জন্য অত্যন্ত আশঙ্কার বিষয়। দেশে কন্যাশিশুরাও নিরাপদ নয়। ২০২৪ সালে ২২৪টি কন্যাশিশু ধর্ষণের ঘটনা পত্রিকায় প্রকাশিত হয়, যদিও অনেকেই মনে করেন, এই সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে। কারণ, অধিকাংশ সময় শিশুরা এ ধরনের ঘটনাগুলো বর্ণনা করতে ভয় পায়। একই বছরে ধর্ষণের পর ৮১টি কন্যাশিশু হত্যার ঘটনা ঘটে এবং ১৩৩টি কন্যাশিশু ধর্ষণের পর আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছে। এই পরিসংখ্যান বাংলাদেশের নারীদের বর্তমান পরিস্থিতির একটি স্পষ্ট চিত্র তুলে ধরছে। তারা পারিবারিক নির্যাতনের পাশাপাশি বাইরে বের হলেও ধর্ষণ ও সহিংসতার মতো ঘটনার শিকার হচ্ছেন। বাংলাদেশে নারী নির্যাতন এবং বিশেষ করে ধর্ষণের মতো অপরাধ দিন দিন আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে চলেছে। এর অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে বিশ্লেষকরা অপরাধীদের যথাযথ শাস্তি না হওয়াকে দায়ী করেন। মানবাধিকার সংস্থাগুলোর মতে, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ধর্ষকরা আইনের দুর্বলতার কারণে পার পেয়ে যায়- যা তাদের আরও অপরাধে জড়াতে উৎসাহিত করে। নারী অধিকার নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংস্থা ‘নারীপক্ষ’-এর গবেষণা অনুযায়ী, ২০১১ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে ৪ হাজার ৩৭২টি ধর্ষণের মামলা হয়েছে, যার মধ্যে মাত্র ৫টি মামলায় দোষী ব্যক্তিদের শাস্তি দেয়া হয়েছে। এই পরিসংখ্যানই স্পষ্টভাবে প্রমাণ করে যে ধর্ষণের বিচারব্যবস্থা কতটা দুর্বল এবং অপরাধীরা কীভাবে পার পেয়ে যায়।