স্টাফ রিপোর্টার: হেফাজতে নেয়ার পর চার ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদ শেষে চয়নিকা চৌধুরীকে ছেড়ে দিয়েছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। পরিবারের জিম্মায় শুক্রবার রাত ১১টায় তাকে ছেড়ে দেয়া হয়। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন ডিবি তেজগাঁও বিভাগের উপ-কমিশনার ওয়াহিদুল ইসলাম। তিনি বলেন, রাত ১১টার দিকে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে চয়নিকা চৌধুরীকে তার পরিবারের জিম্মায় ছেড়ে দেয়া হয়েছে। এ সময় তার মেয়েসহ আরও কয়েকজন উপস্থিত ছিলেন। এর আগে শুক্রবার সন্ধ্যায় রাজধানীর পান্থপথ এলাকা থেকে চয়নিকা চৌধুরীকে হেফাজতে নেয় ডিবি। পরে তাকে মিন্টো রোডে অবস্থিত ডিবি কার্যালয়ে নেয়া হয়। সন্ধ্যায় বেসরকারি একটি টিভিতে সাক্ষাৎকার দিয়ে বের হয়ে আসার পর চয়নিকা চৌধুরীর গাড়ি আটকায় ডিবি পুলিশ। সেখানে কিছুক্ষণ তার সঙ্গে কথা বলেন ডিবির কর্মকর্তারা। পরে তাকে হেফাজতে নেওয়া হয়।
এদিকে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, গ্রেফতারের পর রিমান্ডে থাকা মডেল পিয়াসা, মৌ ও পরীমণিকে ব্যবসায়ী ও উঠতি বয়সী ধনী তরুণদের নিয়ে ডিজে পার্টি করা এবং মাদকের আসর বসানোর বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদে কারও কারও কাছ থেকে চয়নিকা চৌধুরীর নাম আসে। তিনি বলেন, এছাড়া চয়নিকা চৌধুরীর বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিনেত্রী ও অভিনেতার সঙ্গে প্রেম করিয়ে দেয়া, বিচ্ছেদে সহযোগিতা, মাদক সরবরাহসহ বেশ কয়েকটি অভিযোগ পাওয়া গেছে। আমরা সেগুলো খতিয়ে দেখছি। প্রয়োজনে তাকেও গ্রেফতার করা হবে। চয়নিকা চৌধুরী দেশের একজন আলোচিত পরিচালক। ২০০১ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর ‘শেষ বেলায়’ নাটকের মধ্য দিয়ে পরিচালনা শুরু করেন তিনি। ‘বিশ্বসুন্দরী’ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে চলচ্চিত্র পরিচালক হিসেবে অভিষেক ঘটে তার। সে সিনেমার নায়িকা পরীমণি। ৪ আগস্ট সন্ধ্যায় প্রায় চার ঘণ্টার অভিযান শেষে বনানীর বাসা থেকে পরীমণি ও তার সহযোগীকে আটক করে র্যাব। তার বাসা থেকে নানা মাদকদ্রব্য জব্দ করা হয়। আটকের পর তাকে নেয়া হয় র্যাবের সদর দফতরে। রাতভর সেখানেই থাকতে হয় পরীমণিকে। পরদিন ৫ আগস্ট মাদক মামলা করে র্যাব। একই দিন তাকে আদালতে পাঠিয়ে ৪ দিনের রিমান্ডে নেয় পুলিশ। মামলাটি প্রথমে ডিবিতে, পরে পুলিশ সদর দফতরের নির্দেশে সিআইডিতে হস্তান্তর করা হয়। গত ১৩ জুন রাতে ফেসবুক পোস্টে পরীমণি অভিযোগ করেন, ৯ জুন উত্তরার বোট ক্লাবে তাকে ধর্ষণ ও হত্যাচেষ্টা চালান ব্যবসায়ী নাসির ইউ মাহমুদ ও তার সহযোগীরা। পরে এ ঘটনায় সাভার থানায় ছয়জনকে আসামি করে একটি মামলা দায়ের করেন পরীমণি। বোট ক্লাবের পর পরীমণির পাশে দেখা যায় চয়নিকা চৌধুরীকে। কিন্তু গত ৪ আগস্ট পরীমণি আটক হওয়ার পর তাকে আর পাশে দেখা যায়নি।
এ বিষয়ে অবশ্য চয়নিকা গণমাধ্যমে বলেছেন, পরীমণির সঙ্গে তার যোগাযোগ ও আড্ডা নিতান্ত পেশাগত কারণে। দুজনের মধ্যে অন্য কোনো সম্পর্ক নেই।
এদিকে মডেল পিয়াসা, মৌ, পিয়াসার সহযোগী জিসান-মিশু ও আওয়ামী লীগের মহিলা বিষয়ক উপ-কমিটির পদ হারানো হেলেনা জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে দায়ের করা পৃথক ৫টি মামলার তদন্তভার সিআইডিতে স্থানান্তর করা হয়েছে। এর মধ্যে হেলেনা জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে গুলশান ও পল্লবী থানায় দুইটি মামলা, মোহাম্মদপুরে মরিয়ম আক্তার মৌ’র বিরুদ্ধে ১ টি মামলা, গুলশান থানায় পিয়াসার বিরুদ্ধে মামলা ও ভাটারা থানায় জিসান-মিশুর বিরুদ্ধে ১ টি মামলা। মামলার তদন্তভার স্থানান্তরের সূত্র ধরে শুক্রবার সন্ধ্যায় পিয়াসা, হেলেনা জাহাঙ্গীর ও মৌ’সহ ৫ জনকে সিআইডিতে হস্তান্তর করা হয়েছে।
অপরদিকে, ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) চিত্রনায়িকা পরীমণিকে ৪ দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছে। গতকাল জিজ্ঞাসাবাদে প্রাপ্ত তথ্যের সূত্র ধরে ডিবির যুগ্ম কমিশনার (উত্তর) হারুন অর রশিদ বলেন, প্রাথমিকভাবে আমরা তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছি। তার বাসা থেকে উদ্ধার হওয়া মাদক বিষয়ে আমরা কথা বলেছি। সে (পরীমণি) যে বিপথে এসেছে, অন্ধকার পথে পা বাড়িয়েছে, এটার পেছনে কারা কারা তাকে পৃষ্ঠপোষকতা করেছে। সে নামগুলো বলেছে।’ এছাড়া একজন নারীর নামও বলেছে।’ সেই নারী কে- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ওই নারীর নাম আমরা এখনই বলছি না। তাকে নজরদারিতে রাখছি। শিগগিরই তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করব।’ গত জুনে পরীমণি বিরুলিয়া এলাকায় ঢাকা বোট ক্লাবে তাকে ধর্ষণচেষ্টা ও হত্যার হুমকি দেয়ার অভিযোগ এনে তুমুল আলোচনায় আসেন। পরীমণির অভিযোগটি সামনে আসার পর গণমাধ্যন কর্মীরা যখন তার বাসায় যান, তখন সেখানে ছিলেন চলচ্চিত্র পরিচালক চয়নিকা চৌধুরী। পরী তাকে ‘মম মম’ বলছিলেন।
পিয়াসা ও মৌ রিমান্ডে: জিজ্ঞাসাবাদের জন্য মডেল ফারিয়া মাহবুব পিয়াসাকে আটদিন ও মরিয়ম আক্তার মৌকে চারদিনের রিমান্ডে পেয়েছে সিআইডি পুলিশ। এদের মধ্যে পিয়াসাকে রাজধানীর তিন থানার পৃথক তিনটি মাদক মামলায় আটদিনের রিমান্ডে দিয়েছে আদালত। আর মৌকে একটি মামলায় চারদিনের রিমান্ডে নেয়ার অনুমতি পেয়েছে সিআইডি। গতকাল শুক্রবার ঢাকা মহানগর হাকিম রাজেশ চৌধুরীর আদালতে পিয়াসার এবং সত্যব্রত শিকদারের আদালতে মৌ’র রিমান্ড মঞ্জুর করা হয়। ২ আগস্ট গুলশান থানার মাদক মামলায় পিয়াসাকে তিন দিনের রিমান্ডে নেয়া হয়। ওই রিমান্ড শেষে শুক্রবার তাকে ঢাকা মহানগর হাকিম আদালতে হাজির করা হয়। এরপর গুলশান থানার মামলায় ১০ দিনের রিমান্ডে নিতে আবেদন করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা। এছাড়া রাজধানীর ভাটারা থানার মামলায় গ্রেফতার দেখানোসহ ১০দিন এবং খিলক্ষেত থানার আরেক মামলায় গ্রেফতার দেখানোসহ সাত দিনের রিমান্ডে নিতে আবেদন করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা। তিন মামলার শুনানি শেষে বিচারক গুলশান থানার মামলায় দুইদিন, ভাটারা থানার মামলায় তিন দিন ও খিলক্ষেত থানার মামলায় তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
এদিকে, মোহাম্মদপুর থানায় মাদক মামলায় মডেল মরিয়ম আক্তার মৌকে শুক্রবার ঢাকা মহানগর হাকিম আদালতে হাজির করা হয়। এরপর মোহাম্মদপুর থানায় মাদক আইনে করা মামলায় তাকে ১০ দিনের রিমান্ডে নিতে আবেদন করে পুলিশ। শুনানি শেষে ঢাকা মহানগর হাকিম সত্যব্রত শিকদার আসামি মরিয়ম আক্তার মৌ’র চার দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
এর আগে গত ২ আগস্ট ঢাকা মহানগর হাকিম আশেক ইমামের আদালত মৌয়ের তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। ওই রিমান্ড শেষে তাকে আবারও চার দিনের রিমান্ডে নেয়ার অনুমতি পেয়েছে সিআইডি।
পরীমণির মুখে যত নাম: চিত্র নায়িকা পরীমণিকে র্যাব আটকের পর তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে র্যাব। পরীমণি র্যাবকে জানিয়েছেন যে, তাকে মূলত চলচ্চিত্রে এনেছেন রাজ। এছাড়া তার উচ্ছৃঙ্খল জীবনের পেছনে রাজও দায়ী। তারা একসঙ্গে দেশে এবং বিদেশে বিভিন্নস্থান ঘুরে বেড়িয়েছেন। তার সঙ্গে দক্ষিণাঞ্চলের একজন শীর্ষ আওয়ামী লীগ নেতা, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর একজন শীর্ষ কর্মকর্তা, একজন শিল্পপতি যিনি একটি ক্লাবের সভাপতি, যুবলীগের একজন সাবেক শীর্ষ নেতা বর্তমানে যিনি সংসদ সদস্যসহ অন্তত অর্ধশত শীর্ষ ব্যক্তির নাম জানিয়েছেন র্যাবের কাছে।
প্রযোজক রাজের উত্থান যেভাবে: গোপালগঞ্জের সদর থানার দুর্গাপুর এলাকায় রাজের জন্ম হলেও পড়াশুনা করেছেন খুলনার ফুলতলার একটি মাদরাসায়। ১৯৮৯ সালে সেখানে দাখিল পাস করার পর আর্থিক অনটনে তার আর বেশি পড়াশুনা করা হয়নি। চলে আসেন ঢাকার সাভার এলাকায় এক আত্মীয়র বাসায়। সেখানে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি নেন। পরে সেখানকার এক ঠিকাদারের সঙ্গে তার পরিচয় হলে তিনি এক পর্যায়ে অল্প পুঁজি নিয়ে সড়কের উপকরণ সরবরাহ করা শুরু করেন। এরপর সেখানে ড্রেজিং ব্যবসাসহ বিভিন্ন ব্যবসার সঙ্গে জড়িত হন। উত্তরার একটি ক্লাবে ২০০৮ সালে এক সিনেমা পরিচালকের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। এতেই তার সিমেনা জগতের কপাল খুলে যায়। ওই পরিচালক ঢাকায় প্রায় ৪০টি এর অধিক সিনেমা নির্মাণ করেছেন। এখন তিনি আর সিনেমা নির্মাণ করেন না। একাধিক প্রযোজকের টাকা আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে রাজের বিরুদ্ধে। ওই পরিচালকের হাত ধরেই তিনি প্রতিষ্ঠা করেন রাজ মাল্টিমিডিয়া। রাজ মাল্টিমিডিয়া মডেল ও নায়িকা বানানোর নামে ব্ল্যাক মেইলের ফাঁদ তৈরি করে বলে র্যাব জানতে পেরেছে। ওই সব মডেল ও নায়িকাদের পরে উচ্চবিত্ত সন্তানদের কাছে ভিড়িয়ে রাজ মোটা অংকের টাকা আদায় করতেন।