স্টাফ রিপোর্টার: দেশে অর্থনৈতিক অস্থিরতা ভাবাচ্ছে সরকারকে। রিজার্ভ কমছে। টাকার বিপরীতে ডলারের মূল্য বাড়ছে। এমন অবস্থায় সতর্কতার অংশ হিসেবে সরকারি ব্যয়ে লাগাম টানার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। বিলাস পণ্য আমদানি নিরুৎসাহিত করতে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। জরুরি ছাড়া নতুন প্রকল্প না নিতে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ সফর বন্ধ করতে বলা হয়েছে। অর্থনীতিবিদ ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেছেন, ব্যয় সংকোচন নীতি আরও আগেই নেয়া উচিত ছিলো। দেরিতে হলেও তা নেয়া হচ্ছে। এটি অর্থনীতির জন্য ইতিবাচক।
সরকারি সূত্র বলছে, যেসব প্রকল্প বাস্তবায়নে বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয়ের সম্পর্ক রয়েছে এবং প্রকল্পটি এখনই বাস্তবায়ন জরুরি নয়, সেসব প্রকল্প ৬ মাস বা আরও পরে বাস্তবায়নের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এছাড়া জরুরি প্রয়োজন ছাড়া সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ সফরের অনুমোদন না দিতেও প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দিয়েছেন।
গতকাল অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তাফা কামালও সরকারি ব্যয় সংকোচনের ইঙ্গিত দিয়েছেন। অর্থনৈতিক বিষয়ক ও ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠক শেষে ভার্চ্যুয়াল সংবাদ সম্মেলনে মন্ত্রী বলেন, বিশ্বব্যাপী অস্বাভাবিক সময় চলছে। এই সময়ে অহেতুক ব্যয় করতে চাইছে না সরকার। বিশেষ করে বৈদেশিক মুদ্রার ব্যয়ে সরকার সতর্ক। এজন্য বিলাসী পণ্যের আমদানিও যাতে কম হয় সে উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে।
সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ ভ্রমণ বেড়ে গেছে বলে অর্থমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করলে জবাবে তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দিয়েছেন বিশেষ কোনো প্রয়োজন ছাড়া সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ সফরে অনুমতি দেয়া যাবে না। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি সরকারি কর্মকর্তাদের এখন থেকে বিদেশ ভ্রমণের অনুমতি দেয়া হবে না। তবে বিশেষ কোনো প্রয়োজন হলে অনুমতি সাপেক্ষে বিদেশ যেতে পারবেন। এখন যারা বিদেশ যাচ্ছেন তাদেরকে আগেই অনুমতি দেয়া হয়েছিল জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, নতুন করে কাউকে অনুমতি দেয়া হচ্ছে না।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আগাম সতর্কতা: কম গুরুত্বপূর্ণ আমদানি নির্ভর প্রকল্পের বাস্তবায়ন পিছিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্তের কথাও জানান অর্থমন্ত্রী। বলেন, সময়ে সময়ে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হয়। আমরা এতদিন যেভাবে চলছিলাম, সারা বিশ্বের যে অবস্থা, তাতে লাগাম টেনে ধরতে হচ্ছে। বিশ্বের সঙ্গে এক হয়ে কাজ করতে হবে। বিশ্বের যে সামগ্রিক অবস্থা, তা বিবেচনায় নিয়ে এসব সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে। সারা বিশ্বে করোনা পরিস্থিতির উন্নতির পর জ্বালানি ও খাদ্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় মূল্যস্ফীতি একটি বড় সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছে। আগের চেয়ে বেশি বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় করতে হওয়ায় রিজার্ভে টান পড়েছে। এই পরিস্থিতিতে বিলাস দ্রব্যের আমদানি কমাতে চাইছে সরকার।
আমদানি ব্যয় অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় চাপের মুখে পড়েছে দেশের অর্থনীতি। রিজার্ভ ৪২ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে এসেছে। বাণিজ্য ঘাটতি ২৫ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। বৈদেশিক লেনদেনের চলতি হিসাবের ভারসাম্যের ঘাটতি ১৪ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। এর ফলে ডলারের দাম বেড়েই চলেছে। মঙ্গলবারও যুক্তরাষ্ট্রের মুদ্রা ডলারের বিপরীতে টাকার মান ২৫ পয়সা কমিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আন্তঃব্যাংক মুদ্রা বাজারেই এখন এক ডলারের জন্য ৮৬ টাকা ৭০ পয়সা খরচ করতে হচ্ছে। ওদিকে দেশের ব্যাংকগুলো ডলার বিক্রি করছে ৯২ থেকে সাড়ে ৯২ টাকায়। খোলা বাজারে বিক্রি হচ্ছে ৯৩ টাকায়।
মহামারি করোনার প্রভাব আপাতত নেই। কিন্তু রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশের অর্থনীতিতে চাপ সৃষ্টি হয়েছে। এ চাপ সামলাতে নানামুখী পদক্ষেপের মাধ্যমে ব্যয় সংকোচনের পথে হাঁটছে সরকার। সরকারি ব্যয়ের লাগাম টেনে ধরতে এই দুটি বিষয়ে খুব শিগগিরই প্রজ্ঞাপন জারি করা হবে বলে জানান অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা।
বিলাস পণ্য আমদানিতে কড়াকড়ি: ইতিমধ্যে আমদানি ব্যয় কমাতে বিলাস পণ্য আমদানিতে কড়াকড়ি আরোপ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। গত ১১ই এপ্রিল জরুরি পণ্য ছাড়া অন্য সকল পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে কমপক্ষে ২৫ শতাংশ এলসি মার্জিন রাখার নির্দেশ দিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। মঙ্গলবার সে নির্দেশনায় পরিবর্তন এনে সব ধরনের গাড়ি, ইলেকট্রিক্যাল এবং ইলেকট্রনিক্স সামগ্রী আমদানির এলসি খুলতে ন্যূনতম ৭৫ শতাংশ নগদ মার্জিন রাখার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। জরুরি পণ্য ছাড়া অন্য সকল পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে কমপক্ষে ৫০ শতাংশ মার্জিন রাখতে বলা হয়েছে। অর্থাৎ কোনো ব্যবসায়ী বা ব্যক্তি ১ কোটি টাকার একটি গাড়ি আমদানি করতে চাইলে তাকে ৭৫ লাখ টাকা নগদ দিতে হবে। বাকি ২৫ লাখ টাকা ব্যাংক ঋণ দিয়ে এলসি খুলবে।
বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয়ে সতর্কতা: সারা বিশ্বে করোনা পরিস্থিতির উন্নতিতে অর্থনীতির চাকা সচল হওয়ার পর বাংলাদেশের রপ্তানি যেমন বেড়েছে, তেমনি বেড়েছে আমদানি। রপ্তানির চেয়ে আমদানি ব্যয় অনেক বেশি বেড়ে যাওয়ায় বাড়ছে বাণিজ্য ঘাটতি। এতে চাপ পড়ছে রিজার্ভে। আর ডলার সংকটে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত এই মুদ্রার দাম যাচ্ছে বেড়ে। এতে খাদ্যপণ্যসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় উপকরণ দেশে আনার ক্ষেত্রে খরচ বাড়ছে। এটিও পণ্যমূল্য বৃদ্ধির একটি কারণ।
চলতি অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে (জুলাই-মার্চ) ৬ হাজার ১৫২ কোটি ৪০ লাখ (৬১.৫২ বিলিয়ন) ডলারের পণ্য আমদানি করেছে বাংলাদেশের ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তারা। এই অঙ্ক গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৪৩.৮৬ শতাংশ বেশি। তবে রপ্তানি বাণিজ্যে গত ১০ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) বিভিন্ন পণ্য রপ্তানি করে ৪৩.৩৪ বিলিয়ন ডলার আয় করেছে বাংলাদেশ, যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ৩৫.১৪ শতাংশ বেশি।
জরুরি ছাড়া প্রকল্প না নেয়ার নির্দেশনা: ব্রিফিংয়ে অর্থমন্ত্রী বলেন, যেসব প্রকল্পের সঙ্গে বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয়ের বিষয় রয়েছে এবং এখনই বাস্তবায়ন জরুরি নয় সেগুলো পরে বাস্তবায়ন করা হবে। সরকার এই অস্বাভাবিক সময়টি ম্যানেজ করার জন্য যা করা প্রয়োজন, তাই করছে। বিষয়টি সহজ। সময় যখন কঠিন, সিদ্ধান্তও কঠিন নিতে হবে। বর্তমানে বিশ্বের পরিস্থিতি স্বাভাবিক নয়। বিশ্বের সার্বিক অবস্থা বিবেচনায় এসব সিদ্ধান্ত নেয়া হচ্ছে। যতদিন বহির্বিশ্বে অস্থিরতা থাকবে ততদিন এ ধরনের কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তবে কঠিন মানে এমন নয় যে, সবকিছু বন্ধ করে ফেলা হবে।
রিজার্ভ ৪২ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে: আমদানি বাড়ায় বাংলাদেশের বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভ ৪২ বিলিয়ন (৪ হাজার ২০০ কোটি) ডলারের নিচে নেমে এসেছে। আকুর (এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়ন) রেকর্ড ২২৪ কোটি (২.২৪ বিলিয়ন) ডলার আমদানি বিল পরিশোধের পর মঙ্গলবার দিন শেষে রিজার্ভের পরিমাণ ছিলো ৪১ দশমিক ৯৫ বিলিয়ন ডলার। গত বছরের ২৪ আগস্ট এই রিজার্ভ অতীতের সব রেকর্ড ছাপিয়ে ৪৮ বিলিয়ন ডলারের মাইলফলক অতিক্রম করেছিল।
সোমবার সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপচারিতায় সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, বর্তমানে বাংলাদেশ সবুজ (স্বস্তিকর) অবস্থানে আছে। এটি ধীরে ধীরে হলুদ অবস্থানে (অস্বস্তিকর) যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। বিশ্বব্যাংক, জাপানসহ প্রথাগতভাবে যারা কম সুদে ঋণ দিতো, তারাও এখন তুলনামূলক বেশি সুদ নিচ্ছে। সুতরাং স্বস্তির জায়গাটা কমে আসছে।
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য মনে করেন, সরকারি দায়-দেনা পরিস্থিতি পাঁচ ধরনের ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে। যেমন বিনিময় হারের ঝুঁঁকি বাড়ছে, অভ্যন্তরীণ ঋণের সুদের হার বাড়ছে, বিদেশি ঋণের সুদের হার বাড়ছে, উচ্চমূল্যে প্রকল্প নেয়া ও প্রকল্পের অর্থনৈতিক সুবিধা হ্রাস পাওয়া।