নিরাপত্তার আশ্বাসে পুলিশ প্রহরায় রাতে গেলেন লালমাটিয়ার বাসায়
স্টাফ রিপোর্টার: ড. মুহাম্মদ ইউনূস ইস্যুতে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল (ডিএজি) পদ হারানোর পর নিরাপত্তা চেয়ে পরিবারসহ ঢাকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসে আশ্রয় চেয়েছেন এমরান আহম্মদ ভূঁইয়া। গতকাল শুক্রবার বিকেলে তিনি স্ত্রী ও তিন মেয়েসহ মার্কিন দূতাবাসে হাজির হয়ে আশ্রয় প্রার্থনা করেন। সঙ্গে তাদের পাসপোর্ট এবং ব্যবহারের জন্য জামাকাপড়ের একটি ব্যাগ ছিলো। এ সময় দূতাবাসের ভেতরে ঢুকতে অপেক্ষমাণ কক্ষে এমরান, তার স্ত্রী ও তিন কন্যাকে বসতে দেয়া হয়। শুক্রবার বিকাল পৌনে ৪টার দিকে তিনি বলেন, আমি নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি। তাই যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসে হাজির হয়েছি। বন্ধের দিন হওয়ায় নিরাপত্তাকর্মীরা ভেতরে যেতে দেননি। মূল ফটকের পাশে একটি কক্ষে আমাদের বসিয়েছেন। জানা যায়, পরে তাদের দূতাবাসের ভেতরে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে বেশকিছু সময় পরিবারসহ অবস্থান করেন। পরে সন্ধ্যা ৭টা ৪০ মিনিটের দিকে নিরাপত্তার আশ্বাসে ইমরান আহম্মদ ভূঁইয়াসহ তার পরিবারের সদস্যরা দূতাবাসের ভিসা গেট দিয়ে একটি মাইক্রোবাসে (ঢাকা মেট্রো-গ ২৮-০৪৭৮) লালমাটিয়ার বাসার উদ্দেশে বের হয়ে যান।
জানতে চাইলে ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের মুখপাত্র ব্রায়ান শিলার শুক্রবার রাত সাড়ে ৮টার দিকে বলেন, ‘এই মুহূর্তে এ বিষয়ে বলার মতো কোনো তথ্য আমার কাছে নেই।’ এর আগে বৃহস্পতিবার রাতে ডিএজি পদ থেকে এমরান আহম্মদ ভূঁইয়াকে অব্যাহতি দিয়ে বিজ্ঞপ্তি জারি করা হয়। রাষ্ট্রপতির আদেশক্রমে তাকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে বলে বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়। আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অপর এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, দ্য বাংলাদেশ ল অফিসার্স অর্ডার ১৯৭২-এর ৪(১) অনুচ্ছেদ অনুসারে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল এমরান আহম্মদ ভূঁইয়ার নিয়োগ আদেশ জনস্বার্থে বাতিলক্রমে তাকে ডেপুটি জেনারেল পদ থেকে অব্যাহতি প্রদান করা হলো। এদিকে, বিকালে হঠাৎ মার্কিন দূতাবাসে প্রবেশের বিষয়ে মোবাইল ফোনে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন এবং এসএমএস বিনিময় করেন এমরান আহম্মদ ভূঁইয়া। তিনি বলেন, পুরো পরিবারসহ আমি আশ্রয়ের জন্য মার্কিন দূতাবাসে এসেছি। তিনি যখন দূতাবাসের ভেতরে, বাইরে ছিলেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন ইউনিটের সদস্য ও বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন। এমরান জানান, আজকে তাকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। গত কয়েকদিন ধরে তাকে হোয়াটসঅ্যাপ ও ফেসবুক মেসেঞ্জারে হুমকি দেওয়া হচ্ছে। তার আমেরিকার কোনো ভিসা নেই উল্লেখ করে বলেন, তিনটা ব্যাগে করে এক কাপড়ে কোনোভাবে আমি তিন মেয়েসহ বাসা থেকে বের হয়ে এসেছি। এ সময় তিনি তাদের সবার জন্য দোয়া কামনাও করেন। এদিকে, ডিএজি এমরান নিরাপত্তা চেয়ে ঢাকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসে হাজিরের বিষয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে শুক্রবার বিকালে তিনি বলেন, এই জন্যই তো নাটক সাজিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রে যেতে চান। বিষয়টি আমি দেখছি। ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে করা মামলার বিষয়ে উদ্বেগ জানিয়ে সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে খোলাচিঠি পাঠান ১০৪ জন নোবেল বিজয়ীসহ বিশ্বের ১৭৫ ব্যক্তি। ৪ সেপ্টেম্বর ওই খোলা চিঠির বিষয়ে অ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয় থেকে প্রতিবাদ জানিয়ে বিবৃতি দেয়ার কথা জানান ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল এমরান আহম্মদ। ওইদিন তিনি সাংবাদিকদের বলেন, অ্যাটর্নি জেনারেল অফিসে কর্মরত সবাইকে এতে সই করার জন্য নোটিশ দেয়া হয়েছে। আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি, এ বিবৃতিতে সই করবো না। তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি, ড. ইউনূস একজন সম্মানিত ব্যক্তি। তার সম্মানহানি করা হচ্ছে এবং এটি বিচারিক হয়রানি।’ তার এ বক্তব্য প্রচারের পর ওই দিনই অ্যাটর্নি জেনারেল অফিসের জারি করা এক প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, ‘অত্র অফিসের সব আইন কর্মকর্তার সদয় অবগতির জন্য জানানো যাচ্ছে যে, প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অফিস সংক্রান্ত কোনো বিষয়ে কোনো প্রকার বক্তব্য প্রদানের আগে অ্যাটর্নি জেনারেলের সঙ্গে পরামর্শ ও পূর্ব অনুমতি সাপেক্ষে বক্তব্য প্রদানের জন্য নির্দেশক্রমে সবিনয় অনুরোধ করা হলো।’ এর পরদিন মঙ্গলবার জাতীয় প্রেস ক্লাবে এক অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকদের আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, ‘তিনি (এমরান আহম্মদ ভূঁইয়া) অ্যাটর্নি জেনারেল অফিসের দায়িত্বপ্রাপ্ত একজন ডিএজি (ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল)। তিনি যদি সাংবাদিকদের সামনে কথা বলেন, তাহলে তাকে হয় পদত্যাগ করে কথা বলা উচিত, অথবা অ্যাটর্নি জেনারেলের অনুমতি নিয়ে কথা বলা উচিত। তিনি সেটি করেননি। মঙ্গলবার অ্যাটর্নি জেনারেল এএম আমিন উদ্দিন বলেন, অ্যাটর্নি জেনারেল অফিস থেকে ড. ইউনূসের বিপক্ষে বিবৃতির কোনো নির্দেশনা দেয়া হয়নি। অন্য কোনো পক্ষকে খুশি করার জন্য ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল এমরান আহম্মদ ভূঁইয়া এটা বলেছেন। নিশ্চয়ই এখানে তার কোনো উদ্দেশ্য ছিলো। কে এই এমরান : ড. ইউনূস ইস্যুতে অ্যাটর্নি জেনারেলের অফিসের বিবৃতিতে সই করতে অস্বীকার করে অব্যাহতিপ্রাপ্ত ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল এমরান আহম্মদ ভূঁইয়া এখন আলোচনার তুঙ্গে। আলোচনায় থাকা এই এমরান কে? কেনই বা তার ইউটার্ন? এ নিয়ে মানুষের আছে কৌতূহল। জানা যায়, এমরান আহম্মদের গ্রামের বাড়ি কুমিল্লায়। তার বাবা সুলতান আহম্মদ ভূঁইয়ার চাকরি সূত্রে বেড়ে ওঠেছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে। একই বিশ্ববিদ্যালয়ে এক সময় শিক্ষকতা করেছেন ড. ইউনূসও। জানা যায়, সুলতান আহম্মদও ড. ইউনূসের ঘনিষ্ঠজন। তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে, এ কারণেই কি ড. ইউনূসের পক্ষে অবস্থান এমরানের? এদিকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে পড়াশোনা করেছেন এমরান। তার বিভাগের সাবেক দুই শিক্ষার্থী, যারা এখন সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী, তারা ফেসবুকে লিখেছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগ করতেন এমরান। সভাপতি পদেও ছিলেন তিনি। এর আগে, ২০০৩ সালে হাইকোর্টে প্র্যাকটিসের অনুমতির ২ বছর পর বার কাউন্সিলের সদস্য পদ পান এমরান। এরপর ২০১৮ সালে মন্ত্রীর সুপারিশে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল নিযুক্ত হন বলে ফেসবুকে লেখেন তার এক সহকর্মী। তবে, হঠাৎ কেন ড. ইউনূসের পক্ষে অবস্থান এমরানের? অপরদিকে, এমরানের ফেসবুকের কভারে বঙ্গবন্ধু ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছবি। টাইমলাইনজুড়ে আওয়ামী লীগের নীতি-আদর্শ ও সরকারের উন্নয়নের কথা লেখা। সুপ্রিমকোর্টের একজন আইনজীবী ফেসবুকে লিখেছেন, এমরান বিচারপতি হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে তদবির করে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল হয়েছিলেন। কিন্তু পরপর দুই নিয়োগে বিচারপতি হতে না পারায় ক্ষোভ জন্মেছে মনে। আবার কারও কারও মতে, এমরানের আত্মীয়-স্বজনদের অনেকেই যুক্তরাষ্ট্রে। ভিসা নিশ্চিত করতেই ড. ইউনূসের পক্ষ নিয়েছেন তিনি। তার এমন মন্তব্যে হতবাক অ্যাটর্নি কার্যালয়ের সহকর্মীরা। ক্ষোভে তুলে ফেলেন নেমপ্লেট।