ই-কমার্স থেকে টাকা আদায়ে আদালতের দ্বারস্থ হওয়ার পরামর্শ
স্টাফ রিপোর্টার: মোবাইলসহ বিভিন্ন ইলেক্ট্রনিক ডিভাইস ব্যবহার করে বাংলাদেশের অনেকে অনলাইনে জুয়া (বেটিং) খেলছেন। অনেকে মোবাইল ফোনে বসাচ্ছেন জুয়ার আসর। এক জায়গার আসর মুহূর্তে ছড়িয়ে পড়ছে সারা দেশে। এসব জুয়ার বেশিরভাগ লেনদেন হয় মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে। অনলাইনে জুয়া খেলা নিয়ন্ত্রণে আনতে এবং এর মাধ্যমে বিদেশে অর্থপাচার ঠেকাতে পদক্ষেপ নেওয়ার কথা ভাবছে সরকার। এখন থেকে জুয়ার টাকা যেসব মাধ্যমে লেনদেন হয়, যেমন মোবাইল ব্যাংকিং, সেগুলোতে নজরদারি করা হবে। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের এক বৈঠকে এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয় এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা দেওয়া হয়।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বর্তমানে একটি অ্যাপ ডাউনলোড করেই মোবাইল ফোনে জুয়া খেলতে পারছেন বাংলাদেশিরা। ফলে ঘরে বসেই সহজে জুয়ার আসরে যোগ দিচ্ছেন অনেকে। বাংলাদেশি জুয়াড়িদের কাছে অনলাইনে জুয়া বেশ জনপ্রিয়ও হয়ে উঠেছে। শুধু দেশে নয়, আন্তর্জাতিক বেটিং সাইটগুলোতেও বাংলাদেশি জুয়াড়িদের অংশগ্রহণ দিন দিন বাড়ছে। জুয়া খেলার অর্থ লেনদেন হচ্ছে মোবাইল ব্যাংকিংয়ে। বিকাশ, রকেট, নগদসহ অন্যান্য মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে জুয়াডিরা অর্থ লেনদেন করে বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে।
শুধু দেশি মুদ্রায় নয় অনেকে অনলাইনে বাজি ধরছেন ডলারেও। এজন্য ব্যবহার করা হচ্ছে ক্রেডিট কার্ড। ফলে জুয়ার অর্থ সরাসরি চলে যাচ্ছে দেশের বাইরে।
পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) তথ্য অনুযায়ী, দেশে মোবাইল ব্যাংকিং সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর (এমএফএস) প্রায় পাঁচ হাজার অবৈধ এজেন্ট রয়েছে। এসব এজেন্টের মাধ্যমে গত এক বছরে প্রায় ৭৫ হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়েছে। এজেন্টরা হুন্ডির মাধ্যমে এই টাকা পাচার করেছে।
সম্প্রতি মাল্টার একটি অনলাইন গেমিং প্রতিষ্ঠানে ২০ জন বাংলাদেশির এমএফএসের (মোবাইল ব্যাংকিং) নিবন্ধিত হিসাব খুঁজে পায় বিএফআইইউ। এসব হিসাবে এক বছরে প্রায় ৩৩ কোটি টাকা জমা হয় এবং প্রায় ২২ কোটি টাকা তুলে নেওয়া হয়।
এছাড়া রাশিয়া থেকে পরিচালিত আরেকটি জুয়ার সাইট মোস্টবেট-এর সঙ্গে জড়িত বাংলাদেশি কয়েকজনের মোবাইল ব্যাংকিং অ্যাকাউন্টের লেনদের পর্যালোচনা করেছে বিএফআইইউ। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ৬ মাসের লেনদেনে দেখা যায়, প্রতিটি এমএফএস অ্যাকাউন্টে মাসে গড়ে ৫০ লাখ টাকা নেওয়া হয়েছে। সে অনুযায়ী নমুনায় থাকা ৫টি নম্বরে ৬ মাসে নেওয়া হয়েছে প্রায় ১৫ কোটি টাকা। ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে এভাবে অর্থ পাচার ঠেকানোসহ অনলাইন জুয়া নিয়ন্ত্রণে নড়েচড়ে বসেছে সরকার। জুয়ার টাকাসহ মোবাইলে অবৈধ লেনদেন বন্ধ করতে বাংলাদেশ ব্যাংক ও ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটকে (বিএফআইইউ) বলা হয়েছে। একই সঙ্গে বিকাশ, রকেট, নগদের মতো মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস (এমএফএস) প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর নজরদারি বাড়ানোর জন্য বলা হয়েছে।
সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কেন্দ্রীয় ডিজিটাল কমার্স সেলের একটি বৈঠকে এ বিষয়ে বেশ কিছু সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
বৈঠকে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ, বাংলাদেশ ব্যাংক, বিএফআইইউ, বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি), পুলিশের সাইবার ক্রাইম ইউনিটসহ বিভিন্ন সংস্থার প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।
বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন ডব্লিউটিও সেলের মহাপরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) ও কেন্দ্রীয় ডিজিটাল কমার্স সেল-এর প্রধান হাফিজুর রহমান। এ বিষয়ে তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, অনলাইনে বেশ কিছু জায়গায় জুয়া হচ্ছে। এমন সাতটি প্রতিষ্ঠানকে বন্ধ করতে ইতোমধ্যে বিটিআরসিকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। এছাড়া বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে।
তিনি বলেন, আমারা জেনেছি এসব অনলাইন জুয়ার বেশিরভাগ লেনদেন হচ্ছে বিকাশ, রকেট, নগদের মতো এমএফএস প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে। বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে আলোচনা করা হয়েছে। এটি কীভাবে বন্ধ করা যায়, সে পদক্ষেপ তারা বিভিন্নভাবে (কেন্দ্রীয় ব্যাংক) নেবে। জুয়াড়িরা যেন এসব মাধ্যম ব্যবহার করতে না পারে সেজন্য তারা কাজ করছে।
অনলাইন জুয়ার লেনদেনের বিষয়ে জানতে চাইলে দেশের এমএফএস সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান বিকাশের হেড অব করপোরেট কমিউনিকেশনস শামসুদ্দিন হায়দার ডালিম ঢাকা পোস্টকে বলেন, কোনো গ্রাহক বা এজেন্টের হিসাবে অস্বাভাবিক বা সন্দেহজনক লেনদেন হলে বিকাশ স্বতাপ্রণোদিত হয়ে বিএফআইইউকে তথ্য দেয়। তারা এসব তথ্য যাচাই-বাছাই করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে দেয়। ইতিপূর্বে এমন সন্দেহজনক হিসাবের তথ্যের ভিত্তিতে বেশ কিছু ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
এদিকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ওই বৈঠকে ধামাকা শপিংসহ যেসব বিতর্কিত ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের অনলাইন ব্যবসায়িক কার্যক্রম বন্ধ করা আছে, তাদের প্রতিষ্ঠানের গ্রাহকদের অর্থ ফেরত দেওয়ার বিষয়ে আদালতের নির্দেশনা চাওয়ার জন্য সংশ্লিষ্টদের বলা হয়েছে। এছাড়া পত্রিকায় গণবিজ্ঞপ্তি দেওয়ার পর চূড়ান্ত নোটিশ ইস্যু করা হলেও যেসব প্রতিষ্ঠান কোনো জবাব দেয়নি, তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠানের তালিকা পুলিশ সদরদপ্তরে পাঠাতে বলা হয়েছে।
এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ডিজিটাল কমার্স সেল-এর প্রধান হাফিজুর রহমান বলেন, ধামাকা শপিংসহ বেশ কিছু ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের অনলাইন ব্যবসায়িক কার্যক্রম বন্ধ আছে। এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে যারা গ্রাহকের টাকা ফেরত দিতে আগ্রহী তাদের আমরা সহযোগিতা করছি। এর মধ্যে ধামাকা শপিং, প্রিয় শপ, কিউকম, আলিশা মার্ট, দালাল প্লাসসহ বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান রয়েছে।