দর্শনা অফিস: হাজার হাজার একর নিজস্ব জমি রয়েছে কেরুজ চিনিকলের। এ জমিগুলোতে আখ চাষসহ অন্যান্য চাষাবাদের জন্য কৃষি খামার রয়েছে ১০টি। ১০টি খামারের মধ্যে ৯টি বাণিজ্যিক ও এক পরীক্ষামূলক। এসব খামারে প্রতি বছর আখ ফসলের পাশাপাশি বিভিন্ন ফসল চাষ করা হয়ে থাকে। আখের পাশাপাশি মশুরি, সরিষা, কুমড়া, ইত্যাদি চাষ অন্যতম। ফলনও নেহায়েত কম হয় না। প্রতি মরসুমেই ফলনকৃত ফসল টেন্ডারের মাধ্যমে বিক্রি করে কেরুজ চিনিকল কর্তৃপক্ষ। কিন্তু প্রকৃত দাম থেকে বঞ্চিত হয় বার বার। যে কারণে লোকসানের বোঝা দিনদিন ভারী হতে থাকে। টেন্ডারে অংশগ্রহণকারীদের সিন্ডিকেটের কারণে বাজার মূল্যের চাইতে অনেক কম দামে ফসল বিক্রি লোকসানের অন্যতম কারণ বলেও অভিযোগ রয়েছে। সেই সাথে অভিযোগ রয়েছে খামারের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সিমাহীন দুর্নীতি।
জানা গেছে, কেরুজ কৃষি খামারগুলো থেকে গত ৫ বছরে ১৮ কোটি ৫৩ লাখ টাকা লোকসান হয়েছে। হিসেব মতে ২০১৯-২০ অর্থ বছরে ৪ কাটি ৫০ লাখ, ২০১৮-১৯ অর্থ বছরে ৩ কোটি ৯৫ লাখ, ২০১৭-১৮ অর্থ বছরে ২ কোটি ৯০ লাখ, ২০১৬-১৭ অর্থ বছরে ৩ কোটি ৬৭ লাখ ও ২০১৫-১৬ অর্থ বছরে ৩ কোটি ৫১ লাখ টাকা লোকসান গুনেছে চিনিকল কর্তৃপক্ষ। একদিকে চিনি কারখানার মোটা অংকের টাকা লোকসানের বোঝার অন্যদিকে খামারের লোকসান রয়েছে অব্যাহত। যে কারণে ফি বছর লোকসানের পরিমাণ হু হু করে বেড়েই যাচ্ছে। চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনের একটি প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, এলাকার আখচাষিদের আখ ও কেরুজ খামারগুলোতে প্রতি বছর প্রায় দেড় হাজার একর জমিতে আখ চাষ করা হয়ে থাকে। যা থেকে প্রায় ২৫ হাজার টন আখ পাওয়া যায়। যার বাজার মূল্য ৭ কোটি ৭৫ লাখ ৬৫ হাজার টাকা। এ পরিমাণ আখ উৎপাদন করতে প্রতি বছর কেরুজ চিনিকল কর্তৃপক্ষের গড়ে খরচ হয় ১১ কোটি ৯৬ লাখ টাকা। সে হিসেবে প্রতি বছর এ বাবদ গড়ে ৩ কোটি ৭০লাখ টাকা লোকসান হয়ে থাকে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। লোকসানের পরেও মিলটি চালিয়ে রাখায় নানামুখি অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। অভিযোগ ও প্রশ্নগুলোর মধ্যে রয়েছে, কৃষি খামারের সিডিউল অনুযায়ী চুক্তি ভিত্তিক শ্রমিকরা কাজ না করেই অতিরিক্ত বিল উত্তোলন করে থাকেন, বেশ কয়েকবার খামারের সার চুরি, সেটাপ অনুযায়ী খামারে যে পরিমাণ পাহারাদার প্রয়োজন তার চেয়ে বহুগুণ বেশি পাহারাদারের বিল উত্তোলন করা। ফলে প্রতি বছর খামারের লোকসান বোঝা ভারী হতেই থাকে। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, শুধুমাত্র কেরুজ কৃষি খামারের পাহারাদারের বিল বাবদ প্রতি বছর ২ কোটি টাকার উপরে ব্যয় হয়ে থাকে। তাছাড়া প্রকৃত পক্ষে কোনো পাহারাদারই সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করেনা বলেও উল্লেখ করা হয়। কৃষি খামারে সর্বক্ষেত্রে নানা অনিয়ম, বছরের পর বছর লোকসান, প্রভাব খাটিয়ে অতিরিক্ত দৈনিক পাহারাদার দিয়ে কৃষি খামারগুলোতে বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগ পায় বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশন। বিষয়টি বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনের পক্ষ থেকে চলতি মাসের ২ তারিখে কেরুজ চিনিকলের ব্যবস্থাপনা পরিচালককে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেয়া হয়। যেমন নির্দেশ তেমন কাজটি করেন কেরুজ চিনিকলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবু সাঈদ। ওই দিন দুপুরের পর থেকেই কেরুজ ডিজিএম (ফার্ম) হুমায়ুন কবীর সকল ফার্ম ইনচার্জকে জানিয়ে দেন দৈনিক হাজিরায় পাহারাদারদেরকে খামারে আসার দরকার নেই। দৈনিক পাহারাদারেরা ফার্ম ইনচার্জদের কাছ থেকে এমন খবর শোনার পর উত্তেজিত হয়ে পড়েন। কেউ কেউ আবার হা হুতাশ করতে থাকে। বাদ পড়া পহারাদাররা সংবাদিকদের জানান আমরা দিন হাজিরায় কেরু অ্যান্ড কোম্পানির কোটি কোটি টাকার সম্পদ রক্ষা করতাম। আমাদেরকে বাদ দিলেই কি লোকসান কাটিয়ে উঠবে?
কেরুজ চিনিকলের মহাব্যবস্থাপক (প্রশাসন) শেখ শাহবুদ্দিন জানান, খামারগুলোতে ১২১ জনের স্থলে ৩৩৫ জন চুক্তিভিত্তিক পাহারাদার ছিলো। সেটাপ অনুযায়ী প্রত্যেক খামারে ৩ জন করে পাহারাদার থাকার কথা, সে হিসাবে ১০টি খামারের মোট পাহাদারের সংখ্যা ৩০ জন। অথচ ১০টি খামারে পাহারের সংখ্যা দাড়ায় সাড়ে ৩শ’ জনেরও বেশি। যা প্রয়োজনের তুলনায় ১০ গুণেরও বেশি। যে কারণে বাড়তি বেতন গুণতে হতো ২ কোটি ২৫ লাখ টাকা। ফলে প্রতি বছর খামারগুলোতে কমপক্ষে ৪-৫ কোটি টাকা লোকসান গুণতে হতো চিনিকল কর্তৃপক্ষকে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের শিল্প মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনের সিদ্ধান্ত মোতাবেক ৭ জুলাই ৩৩৫ জন চুক্তিভিত্তিক পাহারাদারকে বাদ দেয়া হয়েছে। পক্ষান্তরে অভিযোগ উঠেছে, কেরুজ চিনিকলের ১০টি কৃষি খামারের মধ্যে ৯টি কৃষি খামারের দৈনিক হাজিরার ৩৩৫ পাহারাদারকে বাদ দেয়া হলেও আকন্দবাড়িয়া পরীক্ষামূলক খামারের প্রায় অর্ধশত দৈনিক হাজিরার পাহারাদার বহাল তবিয়তে করছে। নেপথ্যের রহস্য অজানা সকলের কাছে। আবারো অনেকেই বলেছে, আকন্দবাড়িয়া পরীক্ষামূলক খামার এখন জৈব সার কারখানা। সেখানে লোকবলের প্রয়োজন রয়েছে বিধায় হয়তো তাদের রাখা হতে পারে। কেরুজ চিনিকল এ অঞ্চলের অন্যতম অর্থনৈতিক চালিকা শক্তি। ক্ষমতার পালা বদলের সাথে সাথে চুক্তিভিত্তিক শ্রমিক-কর্মচারীদের সংখ্যাও বেড়েছে। যে যখন যেখানে যেমন ক্ষমতার আসনে ছিলেন, সে তখন, সেখানে তার মতো করেই কর্ম সংস্থানের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন কেরুজ চিনিকলের কৃষি খামারগুলোতে। ক্ষমতার দাপটে, দুর্নীতির মাধ্যমেই ৩০ জনের স্থলে সাড়ে ৩শ’ জনেরও বেশি পাহারাদার নেয়া হয়েছিলো। তবে পদে পাহারাদার হলেও একেকজন দামী দামী মোটরসাইকেলে চড়ে যেতেন খামারগুলোতে। অনেকটাই বড় বাবু স্টাইলে হাজিরা খাতায় স্বাক্ষর বা টিপ দিয়েই ফিরতেন যে যার কর্মস্থলে বা রাজনীতির মাঠে। কাজ না করেই মাসে মাসে কড়কড়ে নোটে পকেট ভরতেন অনেকেই।
এ ব্যাপারে মিলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবু সাঈদ বলেন, আমি সরকারের চাকরি করি। সংশ্লিষ্ট বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা সঠিকভাবে পালন করা কর্তব্য। সরকার মনে করেছে লোকসান কমাতে এ ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত, তাই করেছে। আমি চিনিকলের উন্নতি চাই। চাই এ অঞ্চলের অর্থনৈতিক চালিকা শক্তি কেরুজ চিনিকল টিকে থাকুক। লোকসানের ঘর থেকে বেরিয়ে লাভের মুখ দেখুক। ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখতে হলে, টিকিয়ে রাখতে হবে কেরুজ চিনিকলটি। যে মিলটি চুয়াডাঙ্গার ঐতিহ্য বহন করছে তা বাচিয়ে রাখার দায়িত্ব এ জেলাবাসীরই। সেক্ষেত্রে আমি কঠোর অবস্থানে থেকে পুরোনো দিনের সকল অনিয়ম দূরীকরণে ভূমিকা রাখবো। চিরতরে নির্মূল করবো দুর্নীতি। সেই সাথে সকলকে অনুরোধ করবো বেশি বেশি আখচাষের মাধ্যমে কেরুজ চিনিকলকে বাচিয়ে রাখার জন্য। সেক্ষেত্রে সকলের আন্তরিকতা ও সহযোগিতা কামনা করছি।