দর্শনা অফিস: করোনা ভাইরাস দিনদিন মহামারী আকার ধারণ করছে। গোটা দেশের মতোই দর্শনায় দিনদিন করোনা আক্রান্তের সংখ্যা যেন লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। এরই মধ্যে করোনা উপসর্গ নিয়ে দর্শনায় দুজনের মৃত্যু হলেও আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩৫ জনে। আক্রান্তদের মধ্যে ২০ জন সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরলেও ১৩ জন রয়েছে চিকিৎসাধীন। এদের মধ্যে ৮ জন হাসপাতালে ও ৫ জন বাড়িতেই নিচ্ছেন চিকিৎসা। দর্শনা পৌরসভার ২, ৫ ও ৭নং ওয়ার্ড রেডজোন হিসেবে চিহ্নিত করে লকডাউন ঘোষণা করা হলেও মানছেন না অনেকেই। পুলিশের নীরব ভূমিকায় সংক্রমণ ছড়ানোর আশঙ্কা বিরাজ করছে। মানা হচ্ছে না সরকারের স্বাস্থ্যবিধি। করোনা আক্রান্তদের পাশে দাঁড়িয়ে সহায়তার হাত বাড়িয়েছেন চুয়াডাঙ্গা জেলা প্রশাসক, জেলা পুলিশ সুপার, উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও দর্শনা পৌর মেয়র। গত ২৬ মে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হন দর্শনা থানার অফিসার ইনচার্জ মাহব্বুর রহমান কাজল। একই দিন করোনা টেস্টে পজেটিভ রিপোর্ট আসে দর্শনা মোহাম্মদপুরের রুবেলের। দু’দিন পর দর্শনা থানার কনস্টেবল নারায়নের করোনা পজেটিভ রিপোট পাওয়া যায়। ওসিসহ দুজন করোনা আক্রান্তের পর দর্শনা থানার প্রায় অর্ধশত সদস্যের নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়। এদের মধ্যে ২য় দফায় ৬ পুলিশ সদস্যের করোনা ভাইরাস পজেটিভ রিপোর্ট আসে। আক্রান্ত ওই ৬ জনের মধ্যে ছিলেন থানার সেকেন্ড অফিসার এসআই জাকির হোসেন, এসআই শরিফুল ইসলাম, সাইফুল ইসলাম, মাহমুদুল হক, পিএসআই সোয়াদ ও কনস্টোবল আলাউদ্দিন। প্রত্যেককেই চিকিৎসার জন্য ভর্তি করা হয় চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে। ৩য় দফায় আরও ৬ পুলিশ সদস্যসহ থানার কাজের বুয়ার করোনা পজেটিভ রিপোর্ট আসে। ওই দফায় ৬ পুলিশের মধ্যে ছিলেন দর্শনা থানার ভারপ্রাপ্ত ইনচার্জ, ইন্সপেক্টর (তদন্ত) শেখ মাহবুবুর রহমান, এএসআই মারুফ হাসান, সাইদুর রহমান, মহিউদ্দিন, কনস্টেবল ফরহাদ ও মিজান। এক সময় থানার কাজের বুয়া পারুলের নমুনা পরীক্ষা করা হলে পজেটিভ রিপোর্ট আসে। ৪র্থ দফায় দর্শনা থানার কনস্টেবল হুমায়ুন ও মামুন করোনায় আক্রান্ত হন। সেই সাথে করোনায় আক্রান্ত থানার কাজের বুয়া দর্শনা রিফুজি কলোনীপাড়ার পারুলের মেয়ে পপি ও নাতনি ৪ বছরের শিশু সুশমিতার নমুনা পরীক্ষা করা হলে তাদের দেহে করোনার উপস্থিতি পাওয়া যায়। এদিকে দর্শনা বাসস্ট্যান্ড এলাকার দিলরুবা নামের এক নারী করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হলেও শেষ অবধি তার হদিস মেলেনি। এছাড়া করোনা উপসর্গ নিয়ে মারা যান দর্শনা বাসস্ট্যান্ডের সোলায়মান হক (৫৮)। সোলায়মানের পরিবারের সদস্যদের নমুনা পরীক্ষা করা হলে স্ত্রী বিলকিছ ও ছেলে কেরুজ নিরাপত্তা কর্মী জসিমের পজেটিভ রিপোর্ট আসে। পরপরই পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের নমুনা পরীক্ষা করা হলে সোলায়মানের ছোট ছেলে রাসেলের স্ত্রী ফাহিমা সাদিয়া (২৬) ও ৭ বছর বয়সী ছেলে রেদওয়ান আহমেদ তাছিমের দেহে করোনা ভাইরাস শনাক্ত হয়। সেই সাথে দর্শনা বাসস্ট্যান্ড জামে মসজিদের পেশ ইমাম উসমান গনির নমুনা পরীক্ষায়ও পজেটিভ রিপোর্ট পাওয়া যায়। এদিকে গত করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন দর্শনা পৌরসভার ২নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর সাহিকুল আলম অপু। অপু দর্শনা বাসস্ট্যান্ড গোরস্তানপাড়ার খোরশেদ আলমের ছেলে। করোনা আক্রান্তের তালিকায় রয়েছে দর্শনা মোবারকপাড়ার আবুল কাশেম মাস্টারের ছেলে রাজনের নাম। এরই মধ্যে বুধবার করোনা উপসর্গ নিয়ে মারা যান দর্শনা মটর শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি, প্রবীণ মোটর শ্রমিক নেতা দর্শনা দক্ষিণচাঁদপুর গোরস্তানপাড়ার কাওছার আলী শাহ। মৃত্যুর ২ দিন আগে তার করোনা পরীক্ষার নমুনা দেয়া হয়। দুপুরে মারা গেলেও রাতে করোনা নমুনা পরীক্ষায় পজেটিভ রিপোর্ট আসে কাওছার আলী শাহ’র। সেদিনই শাহ পরিবারের ৮ সদস্য ও প্রতিবেশী দুজনসহ ১০ জনের নমুনা নেয়া হয় করোনা পরীক্ষার জন্য। গত বৃহস্পতিবার ১০ জনের মধ্যে শাহ পরিবারের দুজনের করোনা পজেটিভ রিপোর্ট আসে। তাদেরকে বাড়িতেই চিকিৎসাধীন রাখা হয়েছে। কাওছার আলী শাহ’র করোনা উপসর্গ দেখা দেয়ার সাথে সাথে পরিবারের পক্ষ থেকে নিজেরাই বাড়ি লকডাউন করে দেন। ফলে শাহ বাড়ি লকডাউনের আওতায় রয়েছে। এছাড়া করোনায় আক্রান্ত হয়েছে বাসস্ট্যান্ডের হৃদয় নামের এক যুবক। তাকেও বাড়িতে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে।
দামুড়হুদা উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. আবু হেনা জামাল শুভ জানান, দর্শনায় সর্বমোট ৩৫ জন করোনা আক্রান্তের মধ্যে মারা গেছেন সোলায়মান হক ও কাওছার আলী শাহ। ঝিনাইদাহ হাসপাতাল থেকে সুস্থ হয়ে ফিরেছেন দর্শনা থানার ওসি মাহব্বুর রহমান কাজল, চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়ে ফিরেছেন দর্শনা থানার ওসি তদন্ত শেখ মাহবুবুর রহমান আরও ১৭ জনসহ আর দুজন। ফলে আক্রান্তদের মধ্যে ২০ জন ইতোমধ্যেই সুস্থ হয়েছে। আক্রান্ত ১৩ জনের মধ্যে চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রেেয়ছে দর্শনা থানার ২ পুলিশ সদস্য, থানার রাধুনী পারুলসহ তার পরিবারের ৩জন, মৃত সোলায়মানের ছেলে জসিমসহ ওই পরিবারের ৪ জন ও মোবারকপাড়ার রাজন। বাড়িতেই চিকিৎসাধীন রয়েছেন পৌর কাউন্সিলর সাহিকুল আলম অপু ও পেশ ইমাম উসমান গণি, বাসস্ট্যান্ডপাড়ার হৃদয় ও শাহ পরিবারের দুজন। এলাকাবাসীর অভিযোগে জানা গেছে, ২৬ মে দর্শনা থানায় প্রথম করোনা আক্রান্ত হলেও ১৯ জুনে চুয়াডাঙ্গা জেলা প্রশাসকের বৈঠকে দর্শনা পৌরসভার ৫ ও ৭নং ওয়ার্ডকে রেড জোন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। ওই দুটি ওয়ার্ডের থানাপাড়া ও রিফুজিকলোনী এলাকাকে লকডাউন ঘোষণা করা হলেও ২-৩ দিন তা পরিপূর্ণ বলবৎ ছিলো। পুলিশি কঠোর অবস্থান, ৭টি পয়েন্টে পুলিশি চৌকি, মহল্লার প্রবেশ দ্বারে বাঁশের ব্যারিকেট, লকডাউন সংবলিত ব্যানার ও ম্যাপের দৃশ্য ছিলো চোখে পড়ার মতো। ২-৩ দিন যেখানকার পানি সেখানেই গড়িয়েছে। পুলিশি চৌকি ও ভূমিকা যেমন দেখা মেলেনি, তেমনিভাবে বাঁশের ব্যারিকেট ও ব্যানার কোথায় হারিয়েছে তা যেন খুঁজে পাওয়া মুশকিল। তবে ২-১টি পয়েন্টে বাঁশের ব্যারিকেট থাকলেও তা সরিয়ে অবাধে যাতায়াত করছেন পথচারীরা। রাতারাতি দর্শনা বাসস্ট্যান্ড এলাকায় করোনা আক্রান্তের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় ২৪ জুন পৌরসভার ২নং ওয়ার্ডকে রেডজোন হিসেবে চিহ্নিত করে বাসস্ট্যান্ডপাড়াকে লকডাউনের আওতায় আনা হয়। সেখানেও পুলিশের ভূমিকা দেখা গেছে ২-১ দিন। দর্শনা পৌরসভার বৈঠকে করোনা আক্রান্ত পরিবারগুলোকে সহায়তা ও করোনা প্রতিরোধ কমিটি গঠন করা হয়। সে মোতাবেক পৌরসভা থেকে করোনা আক্রান্ত পরিবারগুলোকে সহায়তা চলমান রেখেছে। এছাড়া চুয়াডাঙ্গা-২ আসনের সংসদ সদস্য হাজি আলী আজগার টগর, জেলা প্রশাসক নজরুল ইসলাম সরকার, পুলিশ সুপার জাহিদুল ইসলাম, দামুড়হুদা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আলি মুনছুর বাবু, উপজেলা নির্বাহী অফিসার দিলারা রহমান, পৌর মেয়র মতিয়ার রহমান, জেলা বিএনপির অন্যতম নেতা হাজি মোখলেসুর রহমান তরফদার টিপু করোনা আক্রান্ত পরিবারের মধ্যে খাদ্যসামগ্রী বিতরণ করেছেন। সচেতনমহল অভিমত ব্যক্ত করে বলেছে, দর্শনাবাসী কোনোভাবেই সরকারি স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলছে না। সরকারি বিধিনিষেধ অমান্য করে স্বাভাবিক নিয়মেই অবাধে যেমন খোলা থাকছে দোকানপাট, তেমনি মানুষের চলাচলেও নেই নিরাপদ দূরত্ব। ফলে যতোই দিন যাচ্ছে, ততোই করোনা আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। এমনিভাবে চলতে থাকলে দর্শনায় করোনা ভাইরাস মহামারী আকার ধারণ করতে পারে। তাই নিজেদের স্বার্থে হলেও এখনি প্রশাসনকে কঠোর অবস্থান গ্রহণে জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারের কাছে জোর দাবি তুলেছে দর্শনাবাসী।