স্টাফ রিপোর্টার: ঝিনাইদহের লক্ষ্মীপুর সড়ক ধরে সাবদারপুর বাজারে যাওয়ার পথে দেখা মেলে এক মধ্যবয়সী নারীর। দূর থেকে দেখা যায় বাজারে ঢোকার খোলা রেলগেটটি পরিষ্কার করছেন তিনি। কিছুক্ষণ পর সবুজ পতাকা হাতে গেটের দুই পাশের মানুষকে সতর্ক করতে জানিয়ে দিচ্ছেন ‘ট্রেন আসছে গেট পার হওয়া যাবে না’।
ট্রেন গেট অতিক্রম করলে জনসাধারণের উদ্দেশ্যে তিনি আবারও সংকেত দেন নিরাপদে গেট (রেললাইন) পার হতে পারবেন। এভাবেই সকাল ৬টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত প্রতিদিন যাত্রীবাহী ও মালবাহী ট্রেনগুলো আসা-যাওয়ার সময় রেলক্রসিং গেট নিরাপদ রাখার দায়িত্ব পালন করে চলেছেন ফাতেমা খাতুন সুমি।
ফাতেমা খাতুন সুমি ঝিনাইদহ জেলার কোটচাঁদপুর উপজেলার সাবদারপুর গ্রামের ইদ্রিস আলীর মেয়ে ও মনিরুল ইসলামের স্ত্রী। তার স্বামী একজন ইলেকট্রনিক মিস্ত্রি। সুমি অষ্টম শ্রেণি সনদে ২০১৩ সালে চাকরির জন্য আবেদন করেন। ২০১৯ সালের ৩০ এপ্রিল বাংলাদেশ রেলওয়েতে গেটম্যান হিসেবে যোগদান করেন। প্রথমে তিনি কোটচাঁদপুর রেলস্টেশনে যোগদান করলেও বর্তমানে সাবদারপুর স্টেশনে আছেন।
সুমির দায়িত্বে থাকা রেলক্রসিং গেটটি অনেক ব্যস্ততম সড়কে অবস্থিত। প্রতি মুহূর্তে ছোট-বড় যানবাহন ট্রেনলাইন পার হয়। এরপরও এই গেটে ব্যারিকেড বা রাস্তায় বিট নেই। তাই খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে শুধু পতাকা হাতে দায়িত্ব পালন করতে হয় তাকে। গেটের ব্যারিকেড না থাকায় সারাক্ষণ ঝুঁকিতে থাকেন তিনিও।
সরেজমিনে দেখা যায়, সাবদারপুর রেলস্টেশনের পাশেই লক্ষীপুর-সাবদারপুর সড়কের ওপর রেলগেটটি। ব্যস্ততম ওই সড়ক দিয়ে সাধারণ পথচারী, স্কুল-কলেজগামী শিক্ষার্থীরাসহ যাতায়াত করছে ছোট-বড় সব ধরনের যানবাহন। ট্রেন আসার সিগন্যাল পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পথচারীদের সতর্ক করে সুমি সবুজ পতাকা দেখিয়ে ট্রেনকে সংকেত দিচ্ছেন লাইন ক্লিয়ার আছে। সংকেত দেখে পথচারীরাও দুইদিকে ট্রেনটি অতিক্রম করা পর্যন্ত অপেক্ষা করছেন। খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে পথচারীদের সতর্ক করে লাইন ক্লিয়ার করে একটার পর একটা ট্রেনগুলো গেট পার করছেন তিনি। দিনে সব মিলিয়ে ১৩টি নির্ধারিত ট্রেন পার হয়। এছাড়া অনির্ধারিত মালবাহী ট্রেনও পার হয়। রেলগেটটি স্টেশনের তালিকাভুক্ত না হওয়ায় সেখানে নেই কোনো প্রতিবন্ধক ও গেটম্যানের দাঁড়ানোর ঘর। রোদ, বৃষ্টি ও ঝড়ে খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে থেকে তিন বছর ধরে দায়িত্ব পালন করে চলেছেন এই নারী গেটম্যান। তার যোগদানের পর থেকে আজ পর্যন্ত ওই রেলগেটে কোনো ধরনের দুর্ঘটনা ঘটেনি। সাবদারপুর গ্রামের রোকেয়া খাতুন বলেন, গত তিন বছর ধরে দেখছি সুমি এই গেটম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন। দাঁড়িয়ে থেকে পথচারীকে থামিয়ে ট্রেন পার হতে সাহায্য করে। সে একজন মেয়ে হয়েও যদি এই কঠিন দায়িত্ব পালন করতে পারে তাহলে অন্য মেয়েরা কেন পারবে না। সুমিকে দেখে অন্য মেয়েরাও অনুপ্রাণিত হবে ।
একাদশ শ্রেণীর শিক্ষার্থী আসমা খাতুন বলেন, প্রতিদিন ভোর সকালে পড়াশোনা করতে যেতে হয় খোলা গেট দিয়ে। তখন দেখতে পাই ট্রেন আসার সময় তিনি পতাকা হাতে আমাদের থামিয়ে দেন। তাকে দেখে অনেক গর্ববোধ হয়। আমিও চাই সুমির মতো একজন কর্মজীবী নারী হতে।
সাবদারপুর বাজারের ব্যবসায়ী শরিফুল ইসলাম জানান, রেলগেট দিয়ে সারদিনে অনেক লোকজন যাতায়াত করে। সাধারণ মানুষের যানমালের নিরাপত্তার জন্য মহিলা গেটম্যান নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেন। কিন্তু তার নিজেরই কোনো নিরাপত্তা নেই। তিনি রোদ, বৃষ্টির মধ্যেও ট্রেনগুলো পারাপার করেন। সরকারের কাছে আবেদন এই মহিলা গেটম্যানের জন্য এখানে একটি গেটবক্স করে দেওয়া হোক।
কলেজ শিক্ষার্থী রবিউল ইসলাম বলেন, যিনি রেলগেটের দায়িত্ব পালন করেন তিনি একদম ব্যতিক্রম। কারণ নারী হয়েও খোলা আশাকের নিচে উনি দায়িত্ব ভালোভাবে পালন করেন। অনেক জায়গা দেখেছি কিন্তু কোথাও রেলগেটে মহিলা গেটম্যান নাই। আবার যারা গেটম্যানের দায়িত্ব পালন করেন সবাই একটি নির্দিষ্ট স্থানে বা বক্সের মধ্যে বসে তাদের দায়িত্ব পালন করে। কিন্তু এই নারী খোলা আকাশের নিচে নিরাপত্তাহীনতার মধ্যেও তার দায়িত্ব পালন করে চলেছেন।
গেটকিপার ট্রাফিক ফাতেমা খাতুন সুমি বলেন, ৩০ এপ্রিল ২০১৯ সালে গেটকিপার ট্রাফিক পদে বাংলাদেশ রেলওয়েতে যোগদান করি। সাবদারপুর স্টেশনের পাশেই টি-৬০ গেটের দায়িত্ব পালন করি। অনেকগুলো চাকরির আবেদন করেছিলাম কোথাও চাকরি হয়নি। আবার বয়সসীমাও শেষ হয়ে আসছিল। এই আবেদনটিই ছিল শেষ, যার কারণে নারী হয়েও এই গেটকিপারের চাকরি নেয়। এটা যেহেতু আমার কাজ সেহেতু করতেই হবে।
তিনি আরও বলেন, আমি মানুষের সেবা দিয়ে যাচ্ছি। অনেক জায়গায় গেটম্যানের ত্রুটির কারণে দুর্ঘটনা ঘটে। কিন্তু আমি এই গেটে দায়িত্ব নেওয়ার পর কখনো কোনো দুর্ঘটনা ঘটেনি। ট্রেন আসার ১০ মিনিট আগে সিগন্যাল পেয়ে গেটে আসি এবং রাস্তায় চলাচলরত মানুষকে বা গেটের আশপাশের মানুষকে নির্দেশ দেই। তারা দুই পাশে দাঁড়িয়ে যায়। এরপর ট্রেনের সিগন্যাল দিলে ট্রেন পার হয়ে যায়। আমি মানুষর জানমালের নিরাপত্তা দিয়ে যাচ্ছি; কিন্তু নিজের কোনো নিরাপত্তা নেই। এখানে যদি একটা বসার জায়গা থাকতো তাহলে হয়তো ভালো হতো। আবার বছরে একটি ছুটিও নেই আমার। ঈদের দিনও দায়িত্ব পালন করতে হয়। সাবদারপুর-আন্দুলবাড়িয়া সড়কের সাবদারপুর পুলিশ ফাঁড়ির সামনে একটি গেট রয়েছে। সেখানে দুজন গেটম্যান পালাক্রমে দায়িত্ব পালন করেন। ওই গেটে বসার জন্য ঘর ও যানবাহনের গতিরোধে ব্যারিকেড রয়েছে। আমার দায়িত্বে থাকা গেটটি বেশি ব্যস্ততম সড়কে অবস্থিত। প্রতি মুহূর্তে ছোট-বড় যানবাহন ট্রেনলাইন পার হয়। এরপরও এই গেটে কিছুই নেই। আমি খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে দায়িত্ব পালন করি। ব্যারিকেড না থাকায় সারাক্ষণ ঝুঁকিতে থাকতে হয়।
সাবদারপুর স্টেশনের সহকারী স্টেশন মাস্টার গোলাম রসুল বলেন, স্টেশনের পাশেই টি-৬০ নামে উন্মক্ত গেটের দায়িত্ব পালন করেন ফাতেমা খাতুন সুমি। যেহেতু গেটটি উন্মুক্ত সেক্ষেত্রে তাকে রোদ, বৃষ্টি, ঝড়ে দায়িত্ব পালনে তাকে অনেক বেগ পেতে হয়। তার কর্তব্য পালনকালে আন্তঃনগর, লোকালসহ অনেকগুলো ট্রেন ডিসবাস হয়। সুমি যে ঝুঁকি নিয়ে দায়িত্ব পালন করে আসছেন, সেটি আমাদের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ জানে এবং খুব দ্রুতই ওই গেটের একটি সমাধান হবে বলে আশা করছি।