মহাসিন আলী : মেহেরপুরে মাঠ জুড়ে চলছে পেঁয়াজের চাষ। কোথাও তাহেরপুরী আবার কোথাও সুখসাগর জাতের পেঁয়াজ। এ জেলার উৎপাদিত পেঁয়াজ এলাকার চাহিদা পূরণ করে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় রফতানি হয়ে থাকে। গত দুই বছর পেঁয়াজের ফলন ও দাম ভালো পেয়ে এবারও স্বপ্নপূরণের আশায় কৃষক পেঁয়াজ চাষ করছেন। তবে দুঃশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়ায় সংরক্ষণের জন্য। জেলায় সবজি ও মসলা জাতীয় ফসল সংরক্ষণের জন্য কোনো হিমাগার নেই। সঠিকভাবে সংরক্ষণ করতে পারলে ফসল কম নষ্ট হতো; কৃষক বেশি দামও পেতেন। এলাকায় গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজের চাষও বাড়ছে বলে জানিয়েছেন কৃষি বিভাগের কর্মকর্তারা। আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় অন্যান্য ফসলের সাথে সাথী ফসল হিসেবেও পেঁয়াজ চাষ করে থাকেন এ জেলার চাষিরা। সাথী ফসল হিসেবে আখ, ভুট্টা ও কলারক্ষেতে পেঁয়াজ চাষ করে অধিক লাভবান হচ্ছেন চাষিরা।
মেহেরপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের দেয়া তথ্যমতে, এ বছর জেলার তিন উপজেলায় পেঁয়াজ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ২ হাজার ৩৬৫ হেক্টর ধরা হয়েছিলো। সে লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে মেহেরপুর পেঁয়াজ চাষ হয়েছে ৩ হাজার ৩২০ হেক্টর জমিতে। যার মধ্যে মেহেরপুর সদর উপজেলায় সুখসাগর ও তাহেরপুরী জাতের পেঁয়াজ মিলিয়ে এক হাজার ৩০০ হেক্টর জমিতে, গাংনী উপজেলায় ৮৭০ হেক্টর জমিতে তাহেরপুরী পেঁয়াজ ও মুজিবনগরে এক হাজার ১৫০ হেক্টর জমিতে সুখসাগর জাতের পেঁয়াজ চাষ হয়েছে।
মুজিবনগর উপজেলার মানিকনগর গ্রামের পেঁয়াজ চাষি শেখ শফিউদ্দিন বলেন, সাথী ফসল হিসেবে কলার সাথে পেঁয়াজ চাষে লাভ বেশি। কলার গাছ বড় হতে হতেই পেঁয়াজ উঠে যায়। ফলে এক খরচে দুই ফসল পাওয়া যায়। তিনি আরও বলেন, আবহাওয়া ভালো থাকলে ৪০ হাজার থেকে ৫০ হাজার টাকা খরচে প্রতিবিঘা জমিতে সুখসাগর জাতের ১২০ থেকে ১৪০ মন পেঁয়াজ পাওয়া অসম্ভব কিছু নয়। আর কৃষক যদি প্রতিমণ পেঁয়াজ ৮শ টাকায় পাইকারী বিক্রি করতে পারে তবে তিন মাসের এ ফসলে কৃষক কমপক্ষে ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকা লাভ করতে পারবেন। গত বছরের প্রথম দিকে কৃষককে ২ হাজার টাকা মণ দরে ও শেষের দিকে ৮শ টাকা মণ দরে পেঁয়াজ বিক্রি করতে দেখা গেছে।
মুজিবনগর উপজেলার সোনাপুর গ্রামের কৃষক ফিরোজ আহমেদ মাস্টার জানান, গত বছর ভালো দাম পেয়ে এবছরও মুজিবনগর উপজেলার চাষিরা পেঁয়াজ চাষে ঝুঁকেছেন। কিন্তু গেলোবার আম্পানের আঘাতে এলাকার কৃষক সুখসাগর পেঁয়াজের বীজ উৎপাদন করতে পারেননি। বাধ্য হয়ে এবার ভারতীয় বীজের ওপর নির্ভরশীল হতে হয়েছে। এতে অনেকে ভালো বীজ পেলেও অনেকের ভাগ্যে জুটেছে খারাপটা। তাই অনেকের জমিতে একাধিকবার সুখসাগর জাতের বীজ ছিটাতে হয়েছে। বিধায় এসব কৃষক প্রতিমণ পেঁয়াজের দাম কমপক্ষে এক হাজার টাকা না পেলে লাভবান হতে পারবেন না।
গাংনী উপজেলার কোদাইলকাটি গ্রামের পেঁয়াজচাষি হোসেন আলী বলেন, প্রতিবিঘা জমিতে পেঁয়াজ চাষ করতে প্রায় ৬ মণ তাহেরপুরী বীজ পেঁয়াজ রোপণ করতে হয়। এলাকায় কাঠ পেঁয়াজ নামে পরিচিত এ পেঁয়াজ প্রতি বিঘায় ৭০ থেকে ৮০ মণ উৎপাদন হয়। তিন মাসেই ক্ষেত থেকে এ পেঁয়াজ তোলা যায়। আর আবহাওয়া ভালো হলে একবিঘায় উৎপাদিত তাহেরপুরী পেঁয়াজ বিক্রি করে ৬০-৭০ হাজার টাকা লাভ করা সম্ভব। তবে পেঁয়াজ ওঠার পরে বৃষ্টি হলে কিংবা দাম কম হলে পেঁয়াজ সংরক্ষণের জন্য কৃষকের কোনো সুযোগ থাকে না। তাই মেহেরপুরে সবজি ও মসলা সংরক্ষণে হিমাগার জরুরি বলে চাষিরা মনে করেন।
গাংনী উপজেলার কুমারীডাঙ্গা গ্রামের চাষি নওশের আলী বলেন, প্রতি বছরেই ৪-৫ বিঘা জমিতে পেঁয়াজ চাষ করি। কিন্তু এই পেঁয়াজগুলো সংরক্ষণ করা যায় না। তাই পেঁয়াজ তোলার পরপরই কম দামেই বিক্রি করে দিতে হয়। সংরক্ষণ করা গেলে পেঁয়াজচাষিরা বেশি লাভবান হবেন। একই কথা জানালেন এলাকার পেঁয়াজচাষি কামরুল হাবিবুর, রহমানসহ অনেকেই।
গাংনী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কেএম শাহাবুদ্দিন বলেন, অন্যান্য বছরে উপজেলার বিভিন্ন গ্রামের মাঠে সবজি চাষ বেশি হয়। বাজারে পেঁয়াজের দাম বেশি হওয়ায় কৃষক পেঁয়াজ চাষে ঝুঁকেছেন। কৃষি বিভাগের লোকজন করোনার মাঝেও কৃষকের পাশে থেকে পরামর্শ দিয়ে আসছেন। যার ফলেই এ উপজেলায় লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে চারগুন বেশি জমিতে পেঁয়াজ চাষ হয়েছে। তিনি মনে করেন এ জেলায় হিমাগার থাকলে জেলার চাষিরা অধিক লাভবান হবেন।
মেহেরপুর কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের উপ-পরিচালক স্বপন কুমার খাঁ জানান, মেহেরপুর জেলার মাটি সবধরনের ফসলের জন্য উর্বর। এ বছর পেঁয়াজের লক্ষ্যমাত্রার দেড়গুন বেশী পেঁয়াজ চাষ হয়েছে। আমরা আশা করছি আগামীতে আরও বেশি পেঁয়াজ চাষ হবে। কৃষকদের দীর্ঘদিনের দাবি হিমাগার। কিন্তু বেসরকারিভাবে কেউ হিমাগারের জন্য এগিয়ে আসে না। আমি সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে হিমাগারের প্রয়োজন বলে জানিয়েছি।