সিঁদুর খেলায় মেতে ওঠে চুয়াডাঙ্গা-মেহেরপুরসহ সারাদেশের হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা
স্টাফ রিপোর্টার: কেউ কারও গালে, কেউবা কারও কপালে সিঁদুর ছুঁয়ে দিচ্ছেন। কেউ আবার আলতো ছোঁয়ায় প্রিয়জনকে রাঙাচ্ছেন লাল টুকটুকে সিঁদুরে গতকাল বুধবার বিকেলে চুয়াডাঙ্গা ও মেহেরপুরসহ সারাদেশের পূজাম-পগুলোতে এভাবেই সিঁদুর খেলায় মাতেন হিন্দু ধর্মের নারীরা। তবে বিকেল গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে আনন্দ-উৎসবে রাশ টেনে ভক্তদের কাঁদিয়ে বিদায় নেন দেবী দুর্গা। বুধবারের বিকেলটা ছিলো হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের জন্য একই সঙ্গে আনন্দের ও বেদনার। শারদীয় দুর্গোৎসবের শেষ দিন বুধবার ছিলো মহাদশমী। সকাল ৮টা ৫০ মিনিটে দর্পণ-বিসর্জনের মাধ্যমে বিদায় জানানো হয় দেবী দুর্গাকে। পরে বিকেল ৪টা থেকে শুরু হয় প্রতিমা বিসর্জন। শেষ দিন র্যাব-পুলিশের কঠোর নিরাপত্তায় শান্তিপূর্ণভাবে প্রতিমা বিসর্জনের পালা শেষ হয়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজরদারিতে ম-প থেকে প্রতিমা বের করা হয়। এর আগে মায়ের হাজারো ভক্তকুল মন্দিরে-ম-পে দিনভর তাদের ভক্তি জ্ঞাপন করেন। বিশ্ব-শান্তির সঙ্গে বাংলাদেশের হাজার বছরের গর্ব-ঐতিহ্য হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান মিলে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি অটুট থাকার প্রার্থনা করা হয়। কামনা করা হয় সব অসুর শক্তির বিনাশ। এ সময় ভক্তরা দই ও খই ভোগ দেন। পরে আরতি ও অঞ্জলি, শেষে প্রতিমা বিসর্জনের মধ্যদিয়ে সমাপ্তি ঘটে এবারের দুর্গোৎসবের। বিজয়া দশমীতে দেশ ও দেশের মানুষের মঙ্গল কামনা করা হয়। পাঁচ দিনব্যাপী দুর্গোৎসবের শেষ দিনে ম-পে ম-পে দশমীর বিহিত পূজার মধ্যদিয়ে ঘটে সমাপ্তি। অতপর দেবীর বিসর্জন আর শান্তিজল গ্রহণ। চ-ীপাঠ, বোধন ও অধিবাসের মধ্যদিয়ে ষষ্ঠী তিথিতে আনন্দময়ীর আগমনে গত ১ অক্টোবর থেকে দেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দুর্গোৎসবের সূচনা হয়। পরের পাঁচদিন ধরে চুয়াডাঙ্গা ও মেহেরপুরসহ দেশব্যাপী ম-পগুলোতে পূজা-অর্চনার মধ্য দিয়ে ভক্তরা দেবী দুর্গার প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন। হিন্দু বিশ্বাসে-টানা পাঁচ দিন মৃন্ময়ীরূপে ম-পে ম-পে থেকে বিসর্জনের মধ্যদিয়ে ফিরে গেছেন কৈলাসে স্বামী শিবের সান্নিধ্যে। এক বছর পর নতুন শরতে আবার তিনি আসবেন ‘পিতৃগৃহে’। এবার দেবী দুর্গা জগতের মঙ্গল কামনায় গজে (হাতি) চড়ে মর্ত্যালোকে (পৃথিবী) আসেন। এতে প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঝড় বৃষ্টি হবে এবং শস্য ও ফসল উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে। অন্যদিকে স্বর্গে বিদায় নেন নৌকায় চড়ে। যার ফলে জগতের কল্যাণ সাধিত হবে। দশমী তিথিতে প্রতিমা বিসর্জনে তার সাঙ্গ হলো গতকাল বুধবার। সারাদেশে এবছর ৩২ হাজার ১৬৮টি ম-পে দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হয়।
চুয়াডাঙ্গায় গতকাল বুধবার সকালে দর্পণ-বিসর্জনের মাধ্যমে বিদায় জানানো হয় দেবী দুর্গাকে। চুয়াডাঙ্গা জেলায় ১২৩টি মন্ডপে দুর্গোৎসবের আয়োজন করা হয়। এর মধ্যে সদর উপজেলায় ২৩টি, আলমডাঙ্গায় ৪২টি, দামুড়হুদায় ১৪টি, দর্শনায় ১৮টি ও জীবননগরে ২৬টি। এর মধ্যে চুয়াডাঙ্গার বড় বাজার সার্ব্বজনীন দুর্গা মন্দির, দৌলদিয়াড় বারোয়ারী দুর্গামন্দির, দাস পাড়া দুর্গা মন্দির, মালোপাড়া দুর্গা মন্দির, বেলগাছী দুর্গা মন্দির, আলুকদিয়া দুর্গা মন্দির অন্যতম। বিসর্জনের আগে গতকাল সকাল থেকেই চুয়াডাঙ্গা বড় বাজার মন্দিরশ শহরের সব মন্দিরে উলুধ্বনি-শঙ্খনিনাদে হিন্দু রমণীদের পরম আকাক্সিক্ষত সিঁদুর খেলায় মুখর আর আনন্দ উৎসবে মেতে ওঠে সবাই। বিকেল সাড়ে ৩টার পর থেকে প্রতিমা বিসর্জনের উদ্দেশ্যে বের করা হয় বিজয়া শোভাযাত্রা। শোভাযাত্রাটি মন্দির প্রাঙ্গন থেকে শুরু হয়ে শহরের প্রধান প্রধান সড়ক ঘুরে শহীদ হাসান চত্বরে এসে পৌঁছুলে ঢাক-কাসর আর গানের তালে তালে নাচতে থাকে ভক্তরা। প্রায় আধাঘন্টাব্যাপী সড়ক জুড়ে আনন্দ উৎসবে মুখরিত হয়ে ওঠে গোটা শহর। সন্ধার পর্যন্ত মাথাভাঙ্গা নদীর জ্বীনতলা মল্লিকপাড়া ঘাটে গিয়ে দেবী বিসর্জন দেয়া হয়। এ সময় ঢাকের শব্দে আর ধূপের গন্ধে মুখরিত হয়ে উঠে গোটাঘাট এলাকা। একদিকে দাসপাড়া, মালোপাড়া, দৌলাতদিয়াড় তালতলা, কুলচারা, আলুকদিয়া এলাকার পূজাম-পগুলো নদীর বিভিন্ন অস্থায়ী ঘাটে প্রতিমাগুলোর বিসর্জন দেয়া হয়। সকালে দেয়া হয় দর্পণ ঘট বিসর্জন। জেলার ১২৩টি প্রতিমা বিভিন্ন নদীতে বিসর্জন দেয়া হয়। এর মধ্যদিয়ে শেষ হয় সনাতন ধর্মাবলম্বীদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব। সনাতন ধর্মের বিশ্বাস অনুযায়ী, বিসর্জনের মধ্যদিয়ে দেবী ফিরে গেলেন স্বর্গলোকের কৈলাসে স্বামীর ঘরে। পরের বছর শরতে আবার তিনি আসবেন এই ধরণীতে যা তার বাবার গৃহ। প্রতিমা বিসর্জনের জন্য সব ধরণের নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। গতকাল বুধবার বেলা ৪টা থেকে চুয়াডাঙ্গা শিশুস্বর্গের পাশে মাথাভাঙ্গা নদীতে শুরু হয় বিসর্জন। চুয়াডাঙ্গা বড় বাজার দুর্গামন্দির, দৌলাতদিয়ার দক্ষিণপাড়া বারোয়ারী দুর্গামন্দিরসহ বিভিন্ন মন্দিরের প্রতিমা এখানে বির্সজন দেয়া হয়। ঢাকের বাদ্য আর গান-বাজনা ছাড়া বিদায়ের করুণ ছায়ায় সারিবদ্ধভাবে একে একে মাথাভাঙ্গা নদীতে বিসর্জন দেয়া হয় প্রতিমা। সড়কে পুলিশের টহল ও ফায়ার সার্ভিসের টিমও দায়িত্ব পালন করে।
বাংলাদেশ পূজা উদযাপন কমিটি চুয়াডাঙ্গা জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক কিশোর কুমার কু- জানান, ‘চুয়াডাঙ্গা জেলায় ১২৩ ম-পে এবার দুর্গোৎসবের আয়োজন করা হয়েছিল। বুধবার সন্ধ্যায় আলমডাঙ্গার কুমার নদ, চুয়াডাঙ্গা সদরের মাথাভাঙ্গা নদী এবং জীবননগর ও দামুড়হুদা এলাকার প্রতিমাগুলোর অধিকাংশ ভৈরব নদে বিসর্জন দেয়া হয়। আলমডাঙ্গা উপজেলার খুদিয়াখালী শ্মশানঘাটে প্রায় ২০টি প্রতিমা বিসর্জন দেয়া হয়। এ সময় হাজারো নারী-পুরুষ নেচে গেয়ে উল্লাস প্রকাশ করে।
সরোজগঞ্জ প্রতিনিধি জানিয়েছেন, চুয়াডাঙ্গার সরোজগঞ্জ এলাকায় সকল স্থানে প্রতিমা বিসর্জন দেয়া হয়েছে। সকলের বুকে ছিলো তাই বিসর্জনের বেদনা। প্রতিধ্বনিত হয় মা তুমি আবার এসো। এবার সরোজগঞ্জ এলাকায় ৯টি পূজাম-প তৈরি হয়। কুতুবপুর ইউনিয়নের বোয়ালিয়া, সিন্দুরিয়া, হাসানহাটি, আলিয়ারপুর ও পদ্মবিলা ইউনিয়নের ধুতুরহাট দাসপাড়া প্রতিমা বিসর্জন দেয়া হয় নবগঙ্গা নদীতে। শঙ্করচন্দ্র ইউনিয়নের সরোজগঞ্জ কাচারিপাড়া ও গড়াইটুপি ইউনিয়ের গড়াইটুপি পালপাড়া, গড়াইটুপি মাঝেরপাড়া ও তেঘরির প্রতিমা বিসর্জন দেয়া হয় চিত্রা নদীতে।
আলমডাঙ্গা ব্যুরো জানিয়েছে, কুমার নদের ভরা বুকে বিজয়া দশমীতে আলমডাঙ্গা পৌর এলাকার সবগুলি এবং কালিদাসপুর গ্রামের প্রতিমা কুমার নদে বিসর্জন দেয়া হয়েছে। বরাবরের মতন এ বিসর্জন উপলক্ষে কুমার নদের তীরে ভক্ত ও দর্শনার্থীদের ঢল নামে। সন্ধ্যার পর পর বিসর্জন দেয়া হয় সব কটি প্রতিমা। বুধবার দেবী বিসর্জনের মধ্য দিয়ে শারদীয় দুর্গোৎসবের পাঁচ দিনব্যাপী সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ হল। বিকেল থেকে শুরু উপচেপড়া ভিড় ছিলো গভীর রাত পর্যন্ত। নবমী বিহিত পূজা, মহাপ্রসাদ বিতরণ, আরতিসহ ধর্মীয় নানা অনুষ্ঠানের পাশাপাশি আলোচনা সভা ও সীমিত আকারে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। বিসর্জনস্থল কুমার তীরেও পর্যাপ্ত পুলিশের উপস্থিতি ছিল। সন্ধ্যায় বিসর্জনের আগ মূহুর্তে শারদীয় দূর্গাপূজা বিসর্জনের ঘাট পরিদর্শন করেন পৌর মেয়র হাসান কাদির গনু, উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. রনি আলম নূর, সহকারী কমিশনার (ভূমি) রেজওয়ানা নাহিদ, উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আবু মুছা, সাধারণ সম্পাদক ইয়াকুব আলী মাস্টার, পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি দেলোয়ার হোসেন, সম্পাদক মতিয়ার রহমান ফারুক, আলমডাঙ্গা থানার অফিসার ইনচার্জ সাইফুল ইসলাম, পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) মোহাম্মদ আব্দুল আলীম, পুলিশ পরিদর্শক (অপারেশন) একরামুল হোসাইন, কাউন্সিলর জহুরুল ইসলাম স্বপন। পরে শারদীয় দুর্গাপূজা বিসর্জনের সময় উপস্থিত ছিলেন জেলা আ.লীগের সহসভাপতি জেলা পূজা উৎযাপন কমিটির সহসভাপতি প্রশান্ত অধিকারী, উপজেলা তথ্য অফিসার সিগ্ধা দাস, উপজেলা পূজা উদযাপন কমিটির সভাপতি ডা. অমল কুমার বিশ্বাস, জেলা পূজা উদযাপন কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক নয়ন সরকার, পৌর সভাপতি পরিমল কুমার ঘোষ, সাধারণ সম্পাদক জয় বিশ্বাস, হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রীস্টান ঐক্য পরিষেদের সভাপতি মনিন্দ্রনাথ দত্ত, সাধারণ সম্পাদক বিশ্বজিৎ সাধু খাঁ, পৌর সভাপতি লিপন বিশ্বাস, সাধারণ সম্পাদক পলাশ আচার্য, বিশিষ্ঠ ব্যবসায়ী বিজেস কুমার রামেকা, মদন কুমার সাহা, মিলন কুমার প্রমুখ।
দর্শনা অফিস জানিয়েছে, ব্যাপক উৎসাহ উদ্দীপনা ও কড়া পুলিশি নিরাপত্তার মধ্যদিয়ে দর্শনা ও আশপাশ এলাকায় শান্তিপূর্ণভাবে প্রতিমা বিসর্জন সম্পন্ন হয়েছে। গতকাল বুধবার বিজয়া দশমির দিনে মাথাভাঙ্গার তীরে মেমনগর ঘাটে দর্শনা পৌরসভার দর্শনা আমতলা হরিজন, কেরুজ, পুরাতনবাজার, রামনগর দাশপাড়া, সর্দারপাড়া ও পারকৃষ্ণপুর হালদারপাড়া মন্দিরের ৫টি প্রতিমা একত্রিত হয়ে শুরু হয় উৎসব। এসময় ঢাকের তালে তালে মুখরিত হয়ে উঠে নদীর তীর। সমাগম ঘটে অসংখ্য দর্শনার্থীর। শেষে বিকেল ৫টার দিকে মাথাভাঙ্গা নদীতে প্রতিমা বিসর্জন দেয়া হয়। কোথায় কোনো অপ্রিতিকর ঘটনার খবর পাওয়া যায়নি।
মেহেরপুর অফিস জানিয়েছে, মেহেরপুরে নিñিদ্র নিরাপত্তার মাধ্যমে শেষ হলো দুর্গার প্রতিমা বিসর্জন। নেচে-গেয়ে দুর্গা দেবীর প্রতিমা বিসর্জন দিয়েছেন ভক্তরা। এর মাধ্যমে এই বছরের মতো শেষ হলো সনাতন ধর্মাবলম্বীদের দুর্গাপূজা। গতকাল বুধবার বিকেলে দুর্গা দেবীর প্রতিমা বিসর্জন শুরু করেন ভক্তরা। চলে সন্ধ্যা পর্যন্ত। মেহেরপুর জেলার একযোগে ৩৭টি পূজাম-পে মা দূর্গাকে বিসর্জন দেয়ার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়। দুপুরের পর থেকে মেহেরপুর শহরের সমস্ত পূজাম-পের প্রতিমাগুলোকে নিয়ে শোভাযাত্রা বের করা হয়। ঢাকঢোল বাজিয়ে, নাচ গানের মধ্যদিয়ে প্রতিমাগুলোকে নিয়ে মেহেরপুর শহরের প্রধান প্রধান সড়ক প্রদক্ষিণ শেষে সন্ধ্যার পরপরই একযোগে ভৈরব নদে বিসর্জন দেয়া শুরু করে।
মুজিবনগর প্রতিনিধি জানিয়েছেন, মেহেরপুরের মুজিবনগর নিñিদ্র নিরাপত্তার মাধ্যমে শেষ হলো দুর্গার প্রতিমা বিসর্জন। মুজিবনগর উপজেলার বাবুপুর, মহাজনপুর, কোমরপুর, বল্লভপুর, রতনপুর, দারিয়াপুর ও মোনাখালী গ্রামের ৭টি প্রতিমা নেচে-গেয়ে বিসর্জন দিয়েছেন ভক্তরা। মুজিবনগর থানা ইনচার্জ (ওসি) মেহেদী রাসেন বলেন, মুজিবনগরে শান্তিপূর্ণভাবে সবকটি প্রতিমা বিসর্জন দেয়া হয়েছে।