মাজেদুল হক মানিক:
বৈদ্যনাথতলা আম্রকানন। বাংলাদেশের ইতিহাসের পাতায় এ নামটি স্বর্ণাক্ষরে লেখা। কেননা ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল এই আমবাগানে বাংলাদেশের প্রথম সরকার শপথ গ্রহণ করেছিলো। যে সরকারের নেতৃত্বে নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্যদিয়ে জন্ম নেয় স্বাধীন বাংলাদেশ। দিন বদলের সাথে সাথে হারিয়ে যেতে বসেছে সেই আম্রকানন। দৃষ্টিনন্দন আমবাগান প্রতি বছর জেলা প্রশাসন ইজারা দিয়ে রাজস্ব আয় করলেও সংরক্ষণের উদ্যোগ নেই। ইতিহাস অনুসন্ধানে আসা দর্শনার্থীরা আম গাছের জরাজীর্ণ অবস্থা থেকে আফসোস করে থাকেন। তবে দীর্ঘদিন পরে হলেও আমাবাগান রক্ষায় কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
বাগানের ইতিহাস সম্পর্কে স্থানীয়রা বলেন, শপথের সেই সময় থেকে মাঝখানে কেটে গেছে অর্ধশত বছর। তখন প্রায় আড়াই হাজার আম গাছ ছিলো। সেই সময় আম গাছগুলোর বয়স ছিলো পঞ্চায়োর্দ্ধ। এখন একেকটি গাছের বয়স একশো বছরের ওপরে। বর্তমানে কয়েক প্রজাতির ছোট বড় প্রায় এক হাজার গাছ রয়েছে। মারা গেছে অসংখ্য গাছ। বিশালাকৃতির গাছগুলো মাথা উঁচু করে যেন সাক্ষ্য দিচ্ছে জমিদার চারুবাবুর শাসন আর বাংলাদেশের স্বাধীনতার রক্তিত্ব সূর্যোদয়ের ঐতিহাসিক ঘটনার।
মুজিবনগর স্মৃতিসৌধে স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে দীর্ঘ প্রায় পঞ্চাশ বছর ধরে দশনার্থীদের ইতিহাস শোনাচ্ছেন সুভাষ মল্লিক। তিনি বলেন, অবিভক্ত বাংলার জমিদার কেদারনাথ রায় তার স্ত্রীর আচারের বাগান হিসেবে এ আমবাগানটি তৈরি করেন। বাগানটিতে যেদিকে তাকাবেন লম্বাসারি দেখতে পাবেন। কোন দিকে এলোমেলো নেই। আমগাছের বেশিরভাগ আম বেশ টক। আমের আকার দেখতে বেশ সুন্দর হলেও টক তাই কাঁচা খাওয়া যায় না। কেদারনাথ রায়ের এই আমবাগান দেশ বিভাগের পরে পূর্বপাকিস্তান সরকার এবং একাত্তরের পর থেকে বাংলাদেশ সরকারের অধীনে চলে যায়।
স্থানীয়রা জানান, জমিদার কেদারনাথ রায় ছিলেন প্রভাবশালী জমিদার। জমিদার বাড়ির পাশেই তিনি স্ত্রীর আচারের জন্য এ আমবাগান তৈরি করেন। আড়াই হাজার আম গাছ লাগানো হয় বাগানটিতে। গাছগুলো বিভিন্ন সারিতে লাগানো। সবদিক থেকেই গাছের সারি দেখা যায়।
স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় যে সরকার গঠন হয়েছিলো তা প্রবাসী সরকার/অস্থায়ী সরকার/মুজিবনগর সরকার/প্রথম সরকার হিসেবে পরিচিত। ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল এই বাগানের মধ্যে সরকারের মন্ত্রিপরিষদ সদস্যরা শপথ গ্রহণ করেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অনুপস্থিতে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহম্মেদ, পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমেদ, অর্থমন্ত্রী ক্যাম্পেন এম মনসুর আলী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এএইচএম কামরুজ্জামান শপথ গ্রহণ করেছিলেন।
স্থানীয়রা জানান, বাগানের মধ্যে এখনও অনেক গাছের ডালপালা শুকিয়ে আছে। এভাবে পুরো গাছ শুকিয়ে যায়। ঝড়ে ভেঙে পড়ে অনেক গাছ। তাছাড়া অনেক গাছেই পরগাছা জন্মে গাছ ক্ষতিগ্রস্থ করছে। এতোকিছুর পরেও কারও কোন নজর নেই বাগানের দিকে।
গেল ১০ এপ্রিল যশোরের মনিরামপুর থেকে আসা দর্শনার্থী আবির হোসেন জানান, আমবাগানের অনেক নাম শুনেছি। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে বাগানের নামটি চিরস্মরণীয়। বাগান দেখতে ভালো লাগছে। তবে সংরক্ষণের ব্যবস্থা না থাকায় খুব কষ্ট হচ্ছে। নতুন প্রজন্মের মাঝে মুক্তিযুুদ্ধর ইতিহাস তুলে ধরতে বাগানটি রক্ষা করার দাবি করেন তিনি।
জানা গেছে, সরকারি সম্পদ হিসেবে প্রতি বছর জেলা প্রশাসন থেকে আমবাগান ইজারা দেয়া হয়। ইজারার অর্থ চলে যায় সরকারি কোষাগারে। অথচ পরিচর্যা করার কোনো উদ্যোগ নেই। বাগান থেকে আসা রাজস্ব দিয়ে বাগান পরিচর্যার কোনো নিয়ম নেই বলে জানিয়েছেন জেলা প্রশাসনের এক কর্মকর্তা।
পরিবেশবাদী সংগঠনের প্রতিনিধি সাংবাদিক রফিকুল আলম বলেন, এলাকার পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় এ ধরনের বাগান থাকা অত্যান্ত জরুরি। ইতিহাস ঐতিহ্য রক্ষা ও পরিবেশের জন্য এ বাগানটি দ্রুত সংরক্ষের উদ্যোগ নিতে হবে।
তবে দীর্ঘদিনের হতাশার পর এবার আশার বাণী শোনালেন জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ও মেহেরপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ফরহাদ হোসেন। তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের একটি বিশেষজ্ঞ দল বাগানটি পরিদর্শন করেছে। গাছগুলো টিকিয়ে রাখার জন্য তারা নানা তথ্য নিয়েছেন। আর কোনো গাছ যাতে মারা না যায় সে লক্ষ্যে কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে।