মহাসিন আলী/শেখ শফি: প্রশাসনের অনুমতি ছাড়াই মেহেরপুর মুজিবনগর উপজেলার ভারত সীমান্তবর্তী কয়েকটি গ্রামে পরচুলা (চুলের ক্যাপ) তৈরির কারখানা গড়ে উঠেছে। কম মজুরিতে এসব কারখানায় শিশুসহ বিভিন্ন বয়সের মানুষ কাজ করছে। অল্প পুঁজির এ ব্যবসায় কারখানা মালিকরা লাভবান হলেও মানা হচ্ছে না স্বাস্থ্যবিধি। এলাকাবাসীর অভিযোগ এসব কারখানায় চোরাপথে আসা ভারতের করোনা আক্রান্ত রোগীর কেটে ফেলা চুল ব্যবহৃত হচ্ছে। এখনই এ কার্যক্রম বন্ধ না করলে এলাকায় লাফিয়ে লাফিয়ে করোনা সংক্রমণ বৃদ্ধি পাবে। এ নিয়ে এলাকাবাসীর মধ্যে আতঙ্ক ছড়াচ্ছে। মেহেরপুর সিভিল সার্জন ডা. নাসির উদ্দিন জানান, মাত্র ৪টি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত মুজিবনগর উপজেলায় মঙ্গলবার করোনা পজেটিভ রোগী শনাক্ত হয়েছে ৪ জন। আর গত ৫ দিনে ১৬ জন করোনা পজেটিভ রোগী শনাক্ত হয়েছে। এছাড়া এ পর্যন্ত করোনা পজেটিভ ৩ রোগী মারা গেছে। বর্তমানে চিকিৎসাধীন রয়েছেন ২৬জন। আর সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন ৯৮জন। স্থানীয়রা জানিয়েছে, মুজিবনগর উপজেলার আম্রকানন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক সোহরাব হোসেনের ভবরপাড়া, সোনাপুর ও নাজিরাকোনা গ্রামে ৪টি, বাগোয়ান ইউনিয়নের ইউপি সদস্য ভবরপাড়া গ্রামের বাসিন্দা মি. দিলিপ মল্লিকের ভবরপাড়া গ্রামে ৪টিসহ এলাকায় মোট ৬টি, আনন্দবাস গ্রামের মামুনের ভবরপাড়া ও সোনাপুর গ্রামে ২টি, সোনাপুর গ্রামের আলতাব হোসেনের একই গ্রামের পশ্চিমপাড়ায় একটি, মাঝপাড়া গ্রামের তেঁতুলতলায় ওই গ্রামের মিলনের একটি, সোনাপুর গ্রামের কলোনিপাড়ায় ওই গ্রামের রাবেয়া খাতুনের ২টি ও সোনাপুর গ্রামের পশ্চিশপাড়ায় বাশারের একটি চুলের ক্যাপ তৈরির কারখানা আছে। এসব কারখানায় চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদা উপজেলার বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে ভারত থেকে আসা চুল ব্যবহার করা হচ্ছে। স্থানীয় সোনাপুর গ্রামের ইউপি সদস্য সোহরাব হোসেন, আশরাফুল ইসলামসহ সচেতনমহল জানিয়েছে, ভারতের করোনা রোগীর কেটে ফেলা এসব চুল চোরাই পথে এসে এসব কারখানায় তা ব্যবহার হচ্ছে। তাদের আরো অভিযোগ কারখানার কারিগররা কোন প্রকার সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখছে না ও করোনা ভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধে কোন প্রকার মাস্ক ব্যবহার করছে না। ছোট্ট ঘরে একই সাথে অনেকগুলো কারিগর এক সাথে কাজ করছে। এতে স্বাস্থ্যবিধি বিঘিœত হচ্ছে। ওসব কারখানার কারিগরসহ সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকি বেড়ে যাচ্ছে। এখনই এসব কারখানা বন্ধ করে দেয়া দরকার।
ভবরপাড়া গ্রামের সোহাগসহ আরও অনেকে জানান, মুজিবনগর উপজেলা সংলগ্ন চুয়াডাঙ্গা জেলার দামুড়হুদা উপজেলার কুতুবপুর গ্রামের শরিফুল ইসলাম, জাহাজপোতা গ্রামের আব্বাস এবং মুজিবনগর উপজেলার আনন্দবাস গ্রামের সামাদসহ এলাকার বেশ কিছু অসাধু ব্যবসায়ী মুজিবনগর এলাকায় চুল বিক্রি করে। এসব অপরিষ্কার ভারতীয় চুল মুজিবনগর উপজেলার গৌরীনগর খালপাড়ার লিয়াকত, মহিষনগর গ্রামের জালাল মিস্ত্রি, গৌরীনগর গ্রামের কিবরিয়া, ভবেরপাড়া গ্রামের জামান ও একই গ্রামের রাজ্জাকের বাড়িসহ এলাকার প্রায় ১৫-২০টি বাড়িতে পরিস্কার ও লম্বা চুল বাছাই করা হচ্ছে। স্কুলের ছোট ছেলে-মেয়েরা এসব চুল বাছাই ও পরিষ্কার করে থাকে। এক্ষেত্রে তাদের স্বাস্থ্যবিধির কোনো বালাই নেই। তারা সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখে না এবং মাস্ক ব্যবহার করে না। ছোট্ট একটা বেঞ্চে ৪-৫ জন বসে চুল বাছাই ও পরিস্কার করার কাজ করছে।
মুজিবনগর বিজিবি কোম্পানি কমান্ডার সুবেদার আমজাদ হোসেন বলেন, বর্তমানে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত সীল করা। তাই ভারত থেকে মুজিবনগরে চুল ঢুকছে বলে আমি মনে করি না। এছাড়া মুজিবনগরের পুরা সীমান্ত বিজিবি’র নজরদারিতে আছে।
মুজিবনগর উপজেলার আম্রকানন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক সোহরাব হোসেন বলেন, ঢাকাতে আছে বায়ার। যাদের মাধ্যমে আমরা পরচুলা (চুলের ক্যাপ) তৈরির কাজ পাই। তারা চীন থেকে আমদানি করা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন জীবাণুমুক্ত চুল বিভিন্ন কুরিয়ার ও পরিবহনের মাধ্যমে আমাদের কারখানায় পৌঁছে দেয়। আমাদের এসব কারখানাগুলোতে বিধবা, স্বামী পরিত্যক্তা, বেকার যুবক-যুবতীরা ওই চুল দিয়ে চীনের চাহিদানুযায়ী বিভিন্ন ধরনের পরচুলা (চুলের ক্যাপ) তৈরি করে। পরে ওইগুলো আমরা ঢাকার বায়ারের কাছে পৌঁছে দেয়।
এদিকে ইউপি সদস্য ভবরপাড়া গ্রামের বাসিন্দা মি. দিলিপ মল্লিক জানান, আমরা কখনই ভারত থেকে আসা চুল আমাদের কারখানায় ব্যবহার করি না। হতে পারে আমাদের কারখানায় ব্যবহৃত চুল বাংলাদেশ, ভারত কিংবা চীনের; যা আমরা বায়ারের মাধ্যমে পাই। আমাদের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শ্রমিকরা বায়ারদের অর্ডার মোতাবেক কাজ করে তাদের হাতে পৌঁছে দেয়। এতে আমরা কাজ অনুযায়ী ৫শ হতে ১৫শ টাকা পর্যন্ত পেয়ে থাকি।
মুজিবনগর উপজেলার বাগোয়ান ইউপি চেয়ারম্যান আইয়ূব হোসেন বলেন, ব্যবসার আগে স্বাস্থ্য। আমরা চায় না করোনা ভাইরাস মহামারী আকার ধারণ করুক। আমি আমার ইউনিয়নে অতিসত্বর মাইকিং করে এ ব্যবসা বন্ধের আদেশ দেব এবং এ ব্যাপারে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করবো।
এদিকে মুজিবনগর উপজেলা নির্বাহী অফিসার সুজন সরকার বলেন, আমরা মুজিবনগর উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধে জনসচেতনতা বৃদ্ধিতে কাজ করে যাচ্ছি। আমরা নিয়মিত প্রচার প্রচারণা চালাচ্ছি, মাস্ক বিতরণ করছি, ভ্রাম্যমাণ আদালত বসাচ্ছি। প্রয়োজনে আমরা অভিযান চালিয়ে চুলের এ ব্যবসা বন্ধ করে দেবো।