স্টাফ রিপোর্টার: দেশের ৮ জেলায় বজ্রপাতে স্কুলছাত্র, কৃষক-কৃষাণীসহ ১৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে কুমিল্লায় পাঁচজন, কিশোরগঞ্জে তিনজন, নেত্রকোনায় দুই, চাঁদপুর, হবিগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, মাদারীপুর ও ঝালকাঠিতে একজন করে। এর ফলে চলতি বছর ঝড়-বৃষ্টির মরসুম শুরু এক দিনে সর্বোচ্চ মৃত্যু দেখলো বাংলাদেশ। গতকাল সোমবার সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত সারাদেশে কালবৈশাখী ঝড়ের মধ্যে এই দুর্ঘটনা ঘটে। ঝড়-বৃষ্টি চলমান থাকায় এই হতাহতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে। এদিকে, গতকাল আবহাওয়া অফিস পূর্বাভাস দিয়েছে, দেশের নয়টি অঞ্চল- রংপুর, দিনাজপুর, রাজশাহী, পাবনা, বগুড়া, ঢাকা, টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ এবং সিলেট অঞ্চলগুলোর ওপর দিয়ে ঝোড়ো হাওয়া বয়ে যেতে পারে। তাই এসব এলাকার নদীবন্দরে তোলা হয়েছে এক নম্বর সতর্কসংকেত।
কুমিল্লা: কুমিল্লার জেলার বরুড়া ও মুরাদনগর উপজেলায় বজ্রপাতে চারজনের মৃত্যু হয়েছে। গতকাল সোমবার বেলা সাড়ে ১১টায় এ ঘটনা ঘটে। বরুড়া উপজেলার খোশবাস ইউনিয়নের পয়ালগাছা গ্রামে বজ্রপাতে দুই স্কুলছাত্রের মৃত্যু হয়। তারা হলো-পয়ালগাছা গ্রামের প্রয়াত খোকন মিয়ার ছেলে ফাহাদ হোসেন (১৩) ও আব্দুল বারেক মিয়ার নাতি সায়মন হোসেন (১৩)। দুজনেই বড়হরিপুর উচ্চবিদ্যালয়ের ৬ষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র। বরুড়া উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা নু এমং মারমা মং বজ্রপাতে মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। অপরদিকে কুমিল্লার মুরাদনগরে কৃষি জমিতে কাজ করার সময় বজ্রপাতে দুই কৃষকের মৃত্যু হয়েছে। এরা হলেন-বাঙ্গরা বাজার থানাধীন কোরবানপুর গ্রামের বীরচরণ দেবনাথের ছেলে নিখিল চন্দ্র দেবনাথ ও আন্দিকুট ইউনিয়নের দেওড়া গ্রামের জসিম উদ্দিন ভুঁইয়ার ছেলে জুয়েল ভুঁইয়া। এ সময় আহত হয়েছেন আরও তিনজন। এ ঘটনার পর আহতরা শ্রবণশক্তি হারিয়েছেন বলে জানা গেছে।
বাঙ্গরা বাজার থানার ওসি মাহফুজুর রহমান জানান, কৃষিকাজ করতে গিয়ে কোরবানপুর গ্রামে বজ্রপাতে দুইজনের মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া গেছে। তাদের মরদেহ পরিবারের কাছে বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে। এছাড়া বেলা সাড়ে ১২টার দিকে দেবিদ্বারের সাহারপাড়ায় বাবার সঙ্গে কৃষিজমি থেকে ধান আনতে গিয়ে মীম আক্তার (১০) নামে এক স্কুলছাত্রীর মৃত্যু হয়। মীম সাহারপাড়া গ্রামের ইমন মিয়ার মেয়ে। সে সূর্যপুর কোটকান্দি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, সে বাবা ও নানার সঙ্গে জমি থেকে কাটা বোরো ধান আনতে যায়। এ সময় বৃষ্টি শুরু হয়। একপর্যায়ে পাশেই বজ্রপাত হলে বিকট শব্দে আতঙ্কিত হয়ে মারা যায় সে। দেবিদ্বার উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ আবুল হাসনাত খাঁন বলেন, শিশু শিক্ষার্থীর মৃত্যুর খবর পেয়েছি। সরকার থেকে তারা পরিবারকে সহায়তা করা হবে।
কিশোরগঞ্জ: কিশোরগঞ্জের হাওরের মিঠামইন ও অষ্টগ্রাম উপজেলায় পৃথক বজ্রপাতে তিনজনের মৃত্যু হয়েছে। গতকাল সোমবার সকাল ও দুপুরে এ ঘটনা ঘটে। নিহতরা হলেন-কিশোরগঞ্জ জেলার মিঠামইন উপজেলার কেওয়ারজোড় ইউনিয়নের রাণীগঞ্জ গ্রামের মৃত আশ্রাব আলীর স্ত্রী ফুলেছা বেগম (৬৫), অষ্টগ্রাম উপজেলার কলমা ইউনিয়নের হালালপুর গ্রামের মৃত যতিন্দ্র দাসের ছেলে ইন্দ্রজিৎ দাস (৩৫) ও একই উপজেলার খয়েরপুর-আব্দুল্লাহপুর ইউনিয়নের খয়েরপুর গ্রামের ইদ্রিস মিয়ার ছেলে স্বাধীন মিয়া (১৫)। অষ্টগ্রাম থানার ওসি মো. রুহুল আমিন, স্থানীয় কলমা ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান রাধাকৃষ্ণ দাস ও মিঠামইন থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) অর্পন বিশ্বাস বজ্রপাতে নিহত হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
নেত্রকোনা: নেত্রকোনায় পৃথক স্থানে বজ্রপাতে মাদরাসা শিক্ষক ও এক শিক্ষার্থীর মৃত্যু হয়েছে। গত রোববার মধ্য রাতে জেলার কলমাকান্দার গোবিন্দপুর গ্রামে ও সোমবার সকালে মদন উপজেলার তিয়শ্রী গ্রামে এ ঘটনা ঘটে। নিহতরা হলেন- কলমাকান্দার নাজিরপুর ইউনিয়নের ধুনন্দ গ্রামের বাসিন্দা দিদারুল ইসলাম। তিনি উপজেলার গোবিন্দপুর বাজার এলাকায় স্থানীয় একটি মাদরাসায় শিক্ষকতা করতেন। অপরদিকে আরাফাত মিয়া (৯) মদন উপজেলার তিয়শ্রী গ্রামের আব্দুস সালামের ছেলে। সে নিজ গ্রামের বাইতুল জান্নাত হাফিজিয়া মাদরাসার শিক্ষার্থী।
চাঁদপুর: চাঁদপুরের কচুয়ায় উপজেলার উত্তর কচুয়া ইউনিয়নের নাহারা গ্রামে বজ্রপাতে বিশাখা সরকার (৩৫) নামে এক কৃষাণীর মৃত্যু হয়েছে। গতকাল সোমবার দুপুরে নিজ বাড়িতে এ ঘটনা ঘটে। নিহত বিশাখা সরকার উত্তর কচুয়া ইউনিয়নের নাহারা গ্রামের হরিপদের স্ত্রী। ওই কৃষাণী বাড়ির পাশের জমি থেকে খড় আনতে গিয়ে বজ্রপাতের শিকার হন। এতে ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়। কচুয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আবাসিক মেডিকেল অফিসার (আরএমও) ডা. জাহিদ হোসাইন বলেন, তার শরীরে কোনো আঘাতের চিহ্ন নেই। তবে বজ্রপাতে আতঙ্কিত হয়ে তিনি মারা যেতে পারেন।
হবিগঞ্জ: হবিগঞ্জের বানিয়াচং উপজেলায় বজ্রপাতে দুরবাসা দাস (৩৫) নামে এক ধান কাটার শ্রমিক নিহত হয়েছেন। এসময় আহত হয়েছেন তার দুই সহোদরসহ তিনজন। গতকাল সোমবার সকালে ও দুপুরে পৃথক বজ্রপাতে এ হতাহতের ঘটনা ঘটে। মৃত দুরবাসা দাস উপজেলার দৌলতপুর ইউনিয়নে আড়িয়ামুগুর বড়হাটি গ্রামের কালাবাসি দাসের ছেলে। বানিয়াচং উপজেলার ভারপ্রাপ্ত প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) সাদ বিন জাহাঙ্গীর জানান, সকালে আড়িয়ামুগুরের পূর্বের হাওরে ধান কাটছিলেন তিন সহোদর। এ সময় বৃষ্টির সঙ্গে বজ্রপাত হলে তারা আহত হন। পরে আহতদের স্থানীয় হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসক দুরবাসা দাসকে মৃত ঘোষণা করেন। আহত সুধন্য দাস ও ভূষণ দাসকে সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। এদিকে একইদিন দুপুরে শিশু বায়জিদ বাগাহাতা গ্রামে তার বাড়ি থেকে হাওরে নিজেদের হাঁসের খামারে যাওয়ার পথে বজ্রপাতে আহত হয়। তাকে স্থানীয়ভাবে চিকিৎসা দেয়া হয়েছে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া: ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্ছারামপুরে সোমবার বিকেলে বজ্রপাতে মানিক মিয়া (৬২) নামে এক কৃষক নিহত হয়েছেন। এ ঘটনায় আহত হয়েছেন হানিফ মিয়া (৬০) নামে অপর এক কৃষক। উপজেলার সোনারামপুর ইউনিয়নের শান্তিপুর গ্রামে এ ঘটনা ঘটে। বাঞ্ছারামপুর থানার উপপরিদর্শক ফারুক আলম জানান, জমিতে কাজ শেষে বাড়ি ফেরার পথে মানিক মিয়া ও হানিফ মিয়া বজ্রপাতের শিকার হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। এরপর তাদের হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসক মানিক মিয়াকে মৃত ঘোষণা করেন।
মাদারীপুর: মাদারীপুর জেলার রাজৈরে বজ্রপাতে কাজল বাড়ৈ (৪০) নামে এক কৃষকের মৃত্যু হয়েছে। সোমবার বিকেলে উপজেলার বাজিতপুর গ্রামে এ দুর্ঘটনা ঘটে। নিহত কাজল ওই গ্রামের জ্ঞান বাড়ৈর ছেলে। জানা গেছে, বিকেলে নিজের জমিতে ধান কাটছিলেন কৃষক কাজল বাড়ৈ। এসময় বৃষ্টি ও বাতাস শুরু হয়। একপর্যায়ে বজ্রপাত হলে গুরুতর আহত হন কাজল। পরে গুরুতর আহত কাজলকে উদ্ধার করে মাদারীপুর ২৫০ শয্যা জেলা হাসপাতালে নিলে দায়িত্বরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। মাদারীপুর সদর মডেল থানার ওসি মো. আদিল হোসেন ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করেন।
ঝালকাঠি: ঝালকাঠির নলছিটি উপজেলায় বজ্রপাতে আসমা আক্তার (২৫) নামে এক প্রসূতির মৃত্যু হয়েছে। গতকাল সোমবার বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে উপজেলার দপদপিয়া ইউনিয়নের উত্তর জুরকাঠি এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। নিহত আসমা আক্তার ওই এলাকার ট্রাকচালক রুবেল মাঝির স্ত্রী। তিনি দুই সন্তানের জননী। নিহতের স্বামী রুবেল মাঝি জানান, তার স্ত্রী টয়লেট থেকে ঘরে ফেরার পথে বজ্রপাতে মারা যান। তার ছোট সন্তানের বয়স ১৫ দিন। বিষয়টি নিশ্চিত করে নলছিটি থানার ওসি আব্দুস সালাম বলেন, বজ্রপাতে এক নারীর মৃত্যুর খবর পেয়েছি। এ ব্যাপারে আইন অনুযায়ী পরবর্তী ব্যবস্থা নেয়া হবে।
এদিকে, আগামী ২৪ ঘণ্টায় সারাদেশে বৃষ্টি হতে পারে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর। সেই সঙ্গে দিনে ও রাতের তাপমাত্রাও কমে যেতে পারে বলে জানিয়েছে সংস্থাটি। সোমবার বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের এ কে এম নাজমুল হকের দেওয়া পূর্বাভাসে এ তথ্য জানানো হয়।
আবহাওয়ার অফিস জানায়, আগামী ২৪ ঘণ্টায় রংপুর, রাজশাহী, ঢাকা, ময়মনসিংহ, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের কিছু কিছু জায়গায় এবং খুলনা ও বরিশাল বিভাগের দু-এক জায়গায় অস্থায়ীভাবে দমকা হাওয়াসহ বিদ্যুৎ চমকানো/বৃষ্টি/বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে। সেই সঙ্গে সারাদেশে দিনের তাপামাত্রা প্রায় অপরিবর্তিত থাকতে পারে এবং রাতের তাপামাত্রা সামান্য হ্রাস পেতে পারে। মঙ্গলবার সন্ধ্যা ৬টা থেকে পরবর্তী ২৪ ঘণ্টায় ঢাকা, ময়মনসিংহ, খুলনা, বরিশাল, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের কিছু কিছু জায়গায় এবং রংপুর ও রাজশাহী বিভাগের দু-এক জায়গায় অস্থায়ীভাবে দমকা হাওয়াসহ বিদ্যুৎ চমকানো/বৃষ্টি/বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে। সেই সঙ্গে সারাদেশে দিন এবং রাতের তাপামাত্রা সামান্য হ্রাস পেতে পারে।
বুধবার (৩০ এপ্রিল) সন্ধ্যা ৬টা থেকে রংপুর, রাজশাহী, ঢাকা, ময়মনসিংহ, খুলনা, বরিশাল, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের দু-এক জায়গায় অস্থায়ীভাবে দমকা হাওয়াসহ বিদ্যুৎ চমকানো/বৃষ্টি/বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে। সেই সঙ্গে সারাদেশে দিন এবং রাতের তাপামাত্রা প্রায় অপরিবর্তিত থাকতে পারে।
বৃহস্পতিবার (১ মে) সন্ধ্যা ৬টা থেকে পরবর্তী ২৪ ঘণ্টায় রংপুর, রাজশাহী, ঢাকা, ময়মনসিংহ খুলনা, বরিশাল ও সিলেট বিভাগের কিছু কিছু জায়গায় এবং চট্টগ্রাম বিভাগের দু-এক জায়গায় অস্থায়ীভাবে দমকা হাওয়াসহ বিদ্যুৎ চমকানো/বৃষ্টি/বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে। সেই সঙ্গে সারাদেশে দিন এবং রাতের তাপামাত্রা প্রায় অপরিবর্তিত থাকতে পারে।
শুক্রবার (২ মে) সন্ধ্যা ৬টা থেকে পরবর্তী ২৪ ঘণ্টায় খুলনা, বরিশাল ও সিলেট বিভাগের কিছু কিছু জায়গায় এবং রংপুর, রাজশাহী, ঢাকা, ময়মনসিংহ ও চট্টগ্রাম বিভাগের দু-এক জায়গায় অস্থায়ীভাবে দমকা হাওয়াসহ বিদ্যুৎ চমকানো/বৃষ্টি/বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে। সেই সঙ্গে সারাদেশে দিন এবং রাতের তাপামাত্রা প্রায় অপরিবর্তিত থাকতে পারে। এছাড়া আগামী পাঁচদিনের মধ্যে বৃষ্টিপাতের প্রবণতা হ্রাস পেতে পারে এবং তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেতে পারে বলে জানিয়েছে সংস্থাটি।