ঝিনাইদহ প্রতিনিধি: শেষের পথে চৈত্র মাস। পাট বীজ বপনের মরসুম চলছে। অথচ দেখা নেই বৃষ্টির। অনেক স্থানে শুকিয়ে গেছে জলাশয়। গভীরে চলে গেছে পানির স্তর। কোথাও নলকূপে পানি উঠছে না, আবার কোথাও খুবই কম পানি উঠছে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দাবি, ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহারে নিয়ম মানা হচ্ছে না। এ কারণে দিন দিন নিচে চলে যাচ্ছে পানির স্তর। নিয়ম রয়েছে, প্রতি কিলোমিটারের মধ্যে একটির বেশি গভীর নলকূপ স্থাপন নিষিদ্ধ। তবে এই নিয়ম অমান্য করে যত্রতত্র ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন করা হচ্ছে। এ কারণে পানির সঙ্কট দেখা দিয়েছে। নলকূপ স্থাপনে জড়িত লোকজনের মতে, সাধারণত ২০ থেকে ৩০ ফুট গভীরে পানির স্তর পাওয়া যায়। এখন ৩০ থেকে ৩৫ ফুট নিচেও পানির স্তর মিলছে না। জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের তথ্য মতে, নির্ধারিত নকশা মেনে ঝিনাইদহ জেলায় ৩১ হাজার নলকূপ রয়েছে। এসব নলকূপে পানির ঘাটতি নেই।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঝিনাইদহ জেলার ৬ উপজেলায় প্রায় অর্ধ লক্ষাধিক নলকূপে পানি কম উঠছে। পানির শ্রমিকরা বলছেন, সাধারণত ২০ থেকে ৩০ ফুট মাটির নিচে পানির স্তর পাওয়া যায়। কিন্তু এখন নলকূপ স্থাপন করতে গিয়ে ৩০ থেকে ৩৫ ফুট নিচেও পানির লেয়ার মিলছে না। জেলা কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন বলছে, তাদের অনুমতি নিয়ে জেলায় ১৭০টির মতো গভীর এবং ৭ হাজার ৯২১টি অগভীর নলকূপ রয়েছে। তবে তাদের অনুমতি ছাড়া ব্যক্তি উদ্যোগে জেলার বিভিন্ন এলাকায় আরও কয়েক হাজার গভীর ও অগভীর নলকূপ রয়েছে। এসব নলকূপ থেকে নিয়ম না মেনে যত্রতত্র পানি উত্তোলন করায় পানির স্তর নেমে যাচ্ছে। যার প্রভাব পড়ছে বাসা বাড়ির অগভীর নলকূপে। পানি নিয়ে কাজ করা জেলা জনস্বাস্থ্য অধিদপ্তর, বিএডিসি এবং পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা বলছেন, প্রায় ৮ মাস বৃষ্টি না হওয়ায় পানির প্রাকৃতিক উৎসগুলো ক্রমেই শুকিয়ে যাচ্ছে। সম্প্রতি হালকা বৃষ্টি হলেও তা কোনো প্রভাব ফেলেনি। এর মধ্যে অতিরিক্ত ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন করে ইরিধানের জমিতে সেচ দেয়া এবং গরমের মাত্রা বেড়ে যাওয়ায় ধীরে ধীরে জেলার নলকূপগুলোর এমন অবস্থা তৈরি হয়েছে। এছাড়া নিয়ম রয়েছে এক কিলোমিটারের মধ্যে গভীর নলকূপ স্থাপন করা যাবে না। কিন্তু সেই নিয়ম না মেনে যত্রতত্র ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন করায় এমন সঙ্কট দেখা দিয়েছে। ফলে গৃহস্থালীর কাজে যেমন অচলাবস্থা দেখা দিয়েছে তেমনি গৃহপালিত পশু-পাখির বিশুদ্ধ পানির উৎসেরও সঙ্কট দেখা দিয়েছে। জনস্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, ব্যক্তি উদ্যোগে যারা বাড়িতে নলকূপ বসিয়েছেন তারা জনস্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরামর্শ নিলে শুষ্ক মরসুমে পানির এমন সঙ্কট হতো না।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, জেলার মধ্যে শৈলকুপাতেই রয়েছে ৩৭ হাজার ৫০০ নলকূপ। যার ভেতরে এই মুহূর্তে বেশিরভাগ নলকূপে পানি কম উঠছে। এর মধ্যে অনেক টিউবওয়েল পানি না ওঠায় অকেজো হয়ে পড়েছে। অথচ উপজেলায় সরকারি নলকূপ রয়েছে মাত্র ১৫০০। টিউবয়েল ব্যবসায়ী মাসুদুর রহমান জানান, তাদের শ্রমিকরা গ্রামাঞ্চলে নলকূপ বসিয়ে থাকে। সাধারণত ২০ থেকে ২৪ ফুট মাটির নিচে পানির লেয়ার বা স্তর পাওয়া যায়। কিন্তু এখন নলকূপ স্থাপন করতে গিয়ে ৩২ থেকে ৪০ ফুট নিচে পানির লেয়ার মিলছে। তবুও পর্যাপ্ত পানি উঠছে না। জেলার পরিবেশ ও জীব বৈচিত্র সংরক্ষণ কমিটির সভাপতি মাসুদ আহম্মদ সঞ্জু জানান, দেশের মধ্যে চরম ক্ষরাপ্রবণ এলাকা এই ঝিনাইদহসহ আশপাশের অঞ্চল। গবেষণা বলছে মরু এলাকার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে এটি। তাছাড়া দেশের অন্য এলাকা থেকে জলাশয়ও কম। এক কিলোমিটারের মধ্যে গভীর নলকূপ না বসানোর নিয়ম থাকলেও কেউ মানছে না। পানি প্রবাহের উৎস নদ-নদী ভরাট করে দখল হয়ে যাচ্ছে। যার ফলে এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। এখন পানির স্তর স্বাভাবিক রাখতে নদী খনন করতে হবে। নিয়ম মেনে গভীর নলকূপ স্থাপনে নজরদারি করতে হবে।
কোটচাঁদপুর শহরের বাসিন্দা শফিকুর রহমানের ভাষ্য, চলতি মরসুমে নলকূপে পানি কম উঠছে। মোটরচালিত নলকূপে একেবারেই পানি উঠছে না। শৈলকুপা উপজেলার যুগনী গ্রামের কলেজ শিক্ষক হাসিবুর রহমানের বাড়িতে দুটি নলকূপ রয়েছে। এগুলোতে পর্যাপ্ত পানি উঠছে না। পানি সঙ্কটে গৃহস্থালি কাজে সমস্যা হচ্ছে।
জেলা শহরের হামদহ এলাকার গৃহবধূ জাকিয়া বেগম বলেন, ‘আমাদের বাড়িতে মোটর দিয়েও খুবই কম পানি উঠছে। এতে খুবই সমস্যা হচ্ছে।’
শৈলকূপা উপজেলার মনোহরপুর গ্রামের আব্দুর রহমান মিল্টন জানান, মাসখানেক আগেও তাদের নলকূপে অল্প অল্প পানি উঠেছে। তবে ১৫ দিন ধরে কোনো পানিই উঠছে না। এলাকার অধিকাংশ বাড়ির নলকূপেই পানি উঠছে না বলে দাবি তার। বিষয়টি নিয়ে বগুড়া ইউনিয়নের আওদা গ্রামের সুজন সরকার বলেন, ‘আমার বাড়ির নলকূপে কিছুদিন ধরেই পানি কম উঠছিলো। এখন সপ্তাহ হতে চলল আর পানিই উঠছে না।’
জনস্বাস্থ্য অধিদপ্তর ঝিনাইদহের নির্বাহী প্রকৌশলী আমিনুল ইসলাম জানান, জেলাজুড়ে কত হাজার বেসরকারি বা ব্যক্তি উদ্যোগে নলকূপ রয়েছে তা আমাদের পরিসংখ্যানে নেই। তবে সরকারিভাবে জেলায় ১৬ হাজার গভীর ও ১৭ হাজার অগভীর নলকূপ রয়েছে। এসব নলকূপে পানির স্বাভাবিক অবস্থা রয়েছে। তিনি জানান, বিভিন্ন ফোরামে বা সরকারের নীতি নির্ধারণী মহলে তারা জানিয়েছেন যেন ডিজাইন মাফিক নলকূপ স্থাপনের আইন পাস হয়। প্রকৌশলীদের পরামর্শ নিয়ে নলকূপ স্থাপন করলে শুষ্ক মরসুমে পানির সঙ্কট কমবে।
ঝিনাইদহ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের সহকারী প্রকোশলী (ক্ষুদ্র সেচ) সামিউল পারভেজ জানান, ইরি মরসুম ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহার করে ধানের জমিতে সেচকাজ করেন কৃষকরা। এ সময়টা বছরের শুষ্ক এবং উষ্ণকাল। এ সময় নদ-নদীর পানি কমে আসে। যে কারণে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর কিছুটা নেমে যায়। তাই এ সময় পানি ব্যবহারে সচেতন হতে হবে। বিশেষ করে সংশ্লিষ্ট দপ্তরের নিয়ম মেনে পাম্প স্থাপন করলে সমস্যা কিছুটা কমবে।