গ্রামীণ জনপদে শুরু হচ্ছে পিঠা তৈরির উৎসব

খাইরুজ্জামান সেতু/ জহির রায়হান সোহাগ: অগ্রহায়ণ মাসের কেবল ৭ দিন। হালকা কুয়াশা আর হিমেল হাওয়া জানান দিচ্ছে শীত আসছে। শুরু হয়েছে মিষ্টি খেজুরের রস সংগ্রহের প্রস্তুতি। গৌরব আর ঐতিহ্যের প্রতীক মধুবৃক্ষ এই খেজুর গাছ। গ্রামীণ জীবনের প্রাত্যহিক উৎসব শুরু হতে যাচ্ছে খেজুর গাছকে ঘিরে। অযত্ন আর অবহেলায় বেড়ে ওঠা খেজুরগাছের কদর বাড়ছে। খেজুরগাছ সুমিষ্ট রস দেয়। শীতের সকালে নানাভাবে খাওয়া হয় এ রস। রস থেকে তৈরি হয় নানা রকম গুড়। যার ঘ্রাণে মৌ মৌ হয়ে ওঠে বাতাস। সুস্বাদে পুরো শীত মরসুমে চলে বিভিন্ন প্রকারের পিঠাপুলি আর পায়েস খাওয়ার আয়োজন। শীতের সকালে মিষ্টি রোদে খেজুরের রস আর মুড়ি খাওয়ার কি যে মজা আর তৃপ্তি, আহ! মানুষ শহর থেকে গ্রামের নিজ নিজ বাড়িতে বেড়াতে আসে শীত মরসুমে। গ্রামের বাড়িতে বাড়িতে জামাই, মেয়ে, নাতি, নাতনিদের নিয়ে শীত উৎসবকে ঘিরে তৈরি হয় নানা প্রকারের পিঠার আয়োজন। স্বজনদের ছাড়া শীত মরসুমে পিঠা উৎসব জমেই না। পিঠা তৈরিকে কেন্দ্র করে গ্রামের বাড়িতে বাড়িতে আনন্দ উৎসবে মুখরিত হয়ে ওঠে পুরো অঞ্চল। আর পুরো শীত মরসুমে চলে বিভিন্ন প্রকারের পিঠা খাওয়ার ধুম। শীতের সকালের শুরুতেই পরিবারের সদস্যদের নিয়ে বাড়ির উঠোনে জমে ওঠে খেজুরের রস আর মুড়ি খাওয়ার আসর।
শীতের শুরুতেই চুয়াডাঙ্গা জেলার আশপাশ এলাকার গাছিরা খেজুরগাছ থেকে রস সংগ্রহ করতে এখন ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন। রস আহরণের জন্য প্রথমে হাতে দা ও কোমরে দড়ি বেঁধে খেজুরগাছে উঠে নিপুণ হাতে গাছ চাছা-ছেলা করে। পরে ছেলা স্থানে নল বসানো হয়। সেই নল চুইয়ে নেমে আসে সুস্বাদু খেজুর রস। কাকডাকা ভোর থেকে সকাল ৭/৮টা পর্যন্ত গাছ থেকে রস সংগ্রহ করে দুপুর পর্যন্ত রস জাল দিয়ে গুড় তৈরি করা হয়। কেউ কেউ আবার গুড় থেকে পাটালি তৈরি করে বিক্রি করে। আবার বিকেল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত রস সংগ্রহের জন্য গাছে গাছে কলস বাঁধে। সকাল-সন্ধ্যায় গাছিরা শহরের বিভিন্ন অলিগলিতে বাকে করে ফেরি করে রস বিক্রি করে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরসূত্রে জানা গেছে, চুয়াডাঙ্গা জেলায় এবার ১৭৫ হেক্টর জমিতে প্রায় ৫০হাজার খেজুরগাছ রয়েছে যা গতবারের তুলনায় ৭ হেক্টর বেশি জমিতে ২ হাজার ৯শ ৬০টি খেজুরগাছ বেশি লাগানো হয়েছে। এসব গাছ থেকে চলতি বছরে প্রায় ১হাজার ৫শ ৮৪ মেট্রিক টন গুড় উৎপাদন হবে। চুয়াডাঙ্গা জেলার খেজুর রসের যেমন সুনাম রয়েছে তেমনি খেজুর গুড় জেলার চাহিদা মিটিয়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে রফতানিও করা হয়। নতিপোতা গ্রামের গাছি সারাফ মল্লিক জানান, বছরে এই কয়টি মাস খুব পরিশ্রম করতে হয় আমাদের। খুব ব্যস্ত সময় পার করছি খেজুর গাছের পেছনে। শীত মাত্র শুরু হলো তাই গাছে খুব বেশি রস হচ্ছে না। তবুও গাছের রস সংগ্রহ করতে যেতে হচ্ছে কষ্ট করে। শীত যতো বেশি হয় রসও শীতের সাথে সাথে বেশি হয়। প্রতিবছর ১৫০টি খেজুর গাছ থেকে রস সংগ্রহ করি। প্রতি গাছ থেকে গড়ে প্রায় ৪০ কেজি গুড় পাওয়া যায়। প্রতিবছরই ভালো রস নামে গাছ থেকে। কিন্তু এ বছর এখনো শীত ভালো পড়েনি বলে গাছ থেকে খুব একটা রস নামছে না। আশা করা হচ্ছে, আগামী ১০-১৫ দিন পর থেকে পর্যাপ্ত পরিমাণে রস পাওয়া যাবে খেজুর গাছ থেকে। কৃষিবিদদের মতে, দেশের চিনির চাহিদার চার ভাগের এক ভাগ পূরণ হয় এই খেজুরের গুড় থেকে। রসের উৎপাদন বাড়াতে পারলে ভবিষ্যতে দেশে চিনি ও গুড়ের কোনো সঙ্কট থাকবে না।
করিমপুর গ্রামের গাছি সাহাদুল মালিতা জানান, গাছে রস নেই, গাছে রস সংগ্রহ করে খুব একটা লাভ হয় না। খেজুর রস জ্বাল দিতে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার হয় শুকনো ডালপালা। সেই খড়ির দাম অনেক বেশি রস জ্বাল করে খুব একটা পোষায় না। গুড়ের দাম ৬৫-৭০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়। কিন্তু সে তুলনায় অধিকাংশ টাকা ব্যয় হয়ে যায় রস জ্বাল করার খড়ির পেছনেই।
চুয়াডাঙ্গা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপপরিচালক কৃষিবিদ নির্মল কুমার দে জানান, চুয়াডাঙ্গা জেলায় প্রচুর খেজুর গাছ রয়েছে। মাটির গুণে এখানকার খেজুর গাছের রস ও খেজুরের গুড় সুস্বাদু। কৃষকদের উৎপাদিত খেজুর রস, গুড় ও পাটালী বিশেষ প্রক্রিয়াজাত করণের মাধ্যমে বিদেশে রফতানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব। এছাড়া খেজুরের রস ও গুড় বিক্রি করে কৃষকেরা তাদের সংসারে আর্থিক সচ্ছলতা বয়ে আনতে পারেন। খেজুর রসে এখন বাদুড় থেকে ছড়ানো নিপা ভাইরাসের প্রকোপ মাঝে মাঝে দেখা দেয়। রাতে রস খেতে এসে এই ভাইরাসের জীবাণু রসে দিয়ে যায় বাদুড়। তবে গাছ জাল দিয়ে ঘিরে দিলে বাদুড় বসতে পারে না। তাছাড়া রস গরম করে বা সেদ্ধ করে খেলে বিপদের সম্ভাবনা থাকে না। কারণ তাপে এই ভাইরাসের জীবাণু ধ্বংস হয়ে যায়।

এছাড়া, আরও পড়ুনঃ

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More