প্রধানমন্ত্রী পদে এক ব্যক্তি দুই বারের বেশি নয় : পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন দাবি
ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে জামায়াতের আলোচনায় দ্বিকক্ষ সংসদে একমত : দ্বিমত বহুত্ববাদে
স্টাফ রিপোর্টার: প্রধানমন্ত্রী পদে এক ব্যক্তি সর্বোচ্চ দুই মেয়াদে বা দশ বছর থাকতে পারবেন-এমন প্রস্তাব দিয়েছে জামায়াতে ইসলামী। রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ভারসাম্য আনয়নে জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল (এনসিসি) গঠনও চায় দলটি। এছাড়া, দ্বি-কক্ষ বিশিষ্ট সংসদ প্রতিষ্ঠায় একমত হলেও দলটির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে- তবে, নির্বাচন হতে হবে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (পিআর) পদ্ধতিতে। গতকাল শনিবার জাতীয় সংসদ ভবনের এলডি হলে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে বৈঠকে জামায়াত দলীয় এই অবস্থান তুলে ধরে। ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে দীর্ঘ বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের কাছে দলের পক্ষ থেকে এসব প্রস্তাব দেয়ার কথা জানান জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের। তিনি জানান, জাতীয় সংসদ ও রাষ্ট্রপতির মেয়াদ অপরিবর্তিত রাখার পক্ষে মতামত দিয়েছে জামায়াত। ঐকমত্য কমিশন এক বছর মেয়াদ কমিয়ে চার বছর করার প্রস্তাব দিলেও জামায়াত চায়-এই মেয়াদ পাঁচ বছরই থাকুক। আব্দুল্লাহ তাহের জানান, সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৭০-এর কিছু সংশোধনীর বিষয়ে ঐকমত্য কমিশনের প্রস্তাবের সঙ্গে তারা একমত হয়েছেন। সেটি হচ্ছে-সংবিধান পরিবর্তন, অর্থবিল বা বাজেট অনুমোদন এবং আস্থা ভোট ছাড়া বাকি যেকোনো বিষয়ে একজন সংসদ সদস্য যেকোনো দলের ও মতের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে পারবেন। এছাড়া, সংবিধানের মূলনীতিতে সংবিধান সংস্কার কমিশন যে ‘বহুত্ববাদ’ সংযোজনের প্রস্তাব দিয়েছে, সেটির বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে জামায়াত বলেছে-আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস স্থাপনে একত্ববাদের বিষয়টি পুনরায় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। প্রসঙ্গত, এর আগে ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে তিন দফা বৈঠকে টানা দুই মেয়াদের পর বিরতি দিয়ে একই ব্যক্তি আবারও প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন-এমন প্রস্তাব দিয়েছে বিএনপি। এছাড়া দলটি দ্বি-কক্ষ বিশিষ্ট সংসদের প্রস্তাবে একমত হলেও আইনসভার নির্বাচন বিদ্যমান পদ্ধতিতেই করার পক্ষে মত দেয়। জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল গঠনের প্রস্তাবেও একমত হয়নি বিএনপি। সংস্কার প্রস্তাবের এই তিনটি ইস্যুতে বিএনপির বিপরীত অবস্থান নিল জামায়াত। অবশ্য সংসদ, প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির মেয়াদ পাঁচ বছরই থাকার পক্ষে ঐকমত্য দেখা গেল বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে। জামায়াতের নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মুহাম্মদ তাহেরের নেতৃত্বে ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে আলোচনায় অংশ নেন দলটির সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আজাদ, মাওলানা রফিকুল ইসলাম খান, এহসানুল মাহবুব জোবায়ের, ঢাকা মহানগর দক্ষিণের আমির নুরুল ইসলাম বুলবুল, কেন্দ্রীয় প্রচার ও মিডিয়া সেক্রেটারি মতিউর রহমান আকন্দ, কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের সদস্য সাইফুল আলম খান মিলন, জামায়াতের আইনজীবী শিশির মোহাম্মদ মনির। প্যানেল সদস্য হিসেবে ছিলেন মহিউদ্দিন সরকার। অন্যদিকে, ঐকমত্য ককিশনের সহ-সভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজের নেতৃত্ব্বে আলোচনায় অংশ নেন কমিশনের সদস্য ড. বদিউল আলম মজুমদার, সফর রাজ হোসেন, ড. ইফতেখারুজ্জামান ও সাবেক বিচারপতি এমদাদুল হক এবং প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী (ঐকমত্য) মনির হায়দার। বৈঠক শেষে আলোচনার বিষয়বস্তু ও দলীয় প্রস্তাবসমূহের বিষয়ে জামায়াত নেতা আব্দুল্লাহ তাহের সাংবাদিকদের বলেন, দীর্ঘ সময় আলোচনার পরেও তা অসমাপ্ত রয়েছে। বিষয়গুলো খুব পটেনশিয়ালি বের হয়ে আসা উচিত, এজন্য আমরা তাড়াহুড়ো করছি না। তিনি বলেন, আজ অনেকগুলো বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। আমরা কিছু কিছু বিষয়ে একমত হতে পেরেচি। কিছু কিছু বিষয়ে আমরা তাদেরকে (ঐকমত্য কমিশন) প্রস্তাব দিয়েছি। সেটা ওনারা বিবেচনার জন্য রেখেছেন। কিছু বিষয়ে আমাদের আরও আলোচনা প্রয়োজন। তিনি বলেন, আমরা জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিলের (এনসিসি) প্রস্তাবের সঙ্গে নীতিগতভাবে একমত হয়েছি। কিন্তু, পাওয়ার (ক্ষমতা) ও অথোরিটির বিষয়ে আরো আলোচনা প্রয়োজন। যেসব ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে অন্তর্ভুক্ত করে এনসিসি গঠনের প্রস্তাব দেয়া হয়েছে সেখানে কমিশন রাষ্ট্রপতি ও প্রধান বিচারপতির কথা বলেছে। আমরা তাতে ‘না’ বলেছি। আমরা বলেছি-তারা দুইজন রাষ্ট্রের দুটি সর্বোচ্চ জায়গায় আছেন। দেশে জরুরি অবস্থায় অনেক সময রাষ্ট্রপতির কাছে ধর্ণা দিতে হয়, অনেক সময় জুডিসিয়াল সিদ্ধান্তের প্রয়োজন হয়। তাই ওনাদের এই কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত না করাই ভালো হবে। অবশ্য, এনসিসির কাঠামোগত বিষয়ে আমরা নীতিগতভাবে একমত হয়েছি। কারণ, এটা একটি নতুন প্রস্তাব। জামায়াতের পক্ষ থেকে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (পিআর) পদ্ধতিতে নির্বাচনের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে জানিয়ে ডা. তাহের বলেন, আমরা শুরু থেকেই যে সংস্কার প্রস্তাব দিয়েছি, সেখানে আমরা পিআর সিস্টেমে নির্বাচনের কথা বলেছি। অর্থাৎ নির্বাচন হবে দলের ভিত্তিতে। সারাদেশে যে দল যে পরিমাণ ভোট পাবে, সেই অনুপাতে তারা সংসদে আসন পাবে। তিনি বলেন, বাংলাদেশের নির্বাচনে যে দুর্নীতি ও জবরদখল হচ্ছে এবং ভোটবিহীন নির্বাচনের যে ফলাফল হচ্ছে; পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন হলে সেটা বন্ধ হয়ে যাবে। টাকার খেলাও বন্ধ হবে। পিআর পদ্ধরি পক্ষে যুক্তি দেখিয়ে জামায়াতের এই নেতা বলেন, পৃথিবীর ৬০টির বেশি দেশে এই পদ্ধতি চর্চা হচ্ছে। দু-একটি প্রশ্ন ছাড়া এটা মোটামুটিভাবে কার্যকর বলে প্রমাণিত। গত তিন মেয়াদের নির্বাচন নিয়ে আমাদের যে অভিজ্ঞতা, এর থেকে উত্তরণে পিআর পদ্ধতি বাংলাদেশের জন্য উত্তম হবে এবং অনেক ঝামেলা থেকে আমরা পরিত্রাণ পাবো। তিনি বলেন, রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ভারসাম্যের বিষয়ে জামায়াত একমত পোষণ করেছে।
বাস্তবসম্মত সংস্কারে সহযোগিতা করবে জামায়াত: আব্দুল্লাহ তাহের ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে বৈঠক শেষ হওয়ার আগে বিরতিতে জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের সাংবাদিকদের বলেন, দ্বি-কক্ষ বিশিষ্ট সংসদের বিষয়ে জামায়াত একমত হয়েছে। দ্বি-কক্ষ বিশিষ্ট সংসদের রূপ, কাঠামো ও নির্বাচনপদ্ধতি নিয়ে আরো আলোচনা হবে। সংবিধান সংস্কার প্রস্তাবের বিষয়ে তিনি বলেন, যেকোনো ব্যক্তি বা দলীয় স্বার্থের ঊর্ধ্বে গিয়ে জনস্বার্থ রক্ষায় কাজ করবে জামায়াত। ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে আলোচনার শুরুতে আব্দুল্লাহ তাহের বলেন, ইতিবাচক ও বাস্তবসম্মত সংস্কারে জামায়াত পূর্ণ সহযোগিতা করবে। দেশ ও জাতির জন্য কল্যাণকর সংস্কারে জামায়াত পরিপূর্ণভাবে ঐকমত্য পোষণ করে। তিনি বলেন, মানুষের মধ্যে ব্যাপক হতাশা আছে। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে দ্বিতীয় স্বাধীনতা বা নতুন বাংলাদেশ পেয়েছি। কিন্তু আসলেই স্বাধীন হয়েছি কি-না তা সময় বলে দেবে। নতুন যে সুযোগ তৈরি হয়েছে, তা যেন অতীতের মতো হারিয়ে না যায়। সেজন্য আমাদের অনেক বেশি সাবধান হতে হবে। প্রয়োজনে কঠোর হতে হবে। মৌলিক বিষয়গুলো সংশোধনের জন্য ভূমিকা পালন করতে হবে। দলটির আমিরে জামায়াত ডা. শফিকুর রহমানের নেতৃত্বে ৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আহত ও চিকিৎসাধীন আন্দোলনকারীদের দেখতে যান তিনি। সে সময়ের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে ডা. তাহের বলেন, সেখানে গিয়ে আমরা লক্ষ্য করি যে অসুস্থ ও পঙ্গু রোগীদের ৮০ ভাগই ছিলেন সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ। যেমন- দিনমজুর, রিকশাচালক ও ফেরিওয়ালা। এই আন্দোলনে সাধারণ জনমানুষের যে অসামান্য অবদান রয়েছে সেটাকে কোনোভাবেই ভুলে যাওয়া যাবে না। চব্বিশের আন্দোলনের যারা এখনো হাসপাতালের বিছানায় কাতরাচ্ছে, তাদের পুনর্বাসনে অন্তর্বর্তী সরকার আরো বেশি দায়িত্বশীল হতে পারতো। সরকারের আরো অনেক কিছুই করার ছিল। জামায়াত টেকসই গণতন্ত্রের চর্চা করে জানিয়ে তাহের বলেন, আমাদের দলে নির্ধারিত সময়ে নির্বাচন হয়। প্রচার ও প্যানেল ছাড়া গোপন ব্যালেটে নির্বাচন হয়। দেশে এমন নির্বাচন চাই, যাকে দুনিয়া স্বীকৃতি দেবে। গত তিন মেয়াদে নির্বাচনের নামে নৈরাজ্য হয়েছে। যার পরিণতি সমগ্র জাতি ভোগ করছি। জামায়াত দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ চায় জানিয়ে তিনি বলেন, আজকের দুরাবস্থার পেছনে দুর্নীতি সবচেয়ে বেশি দায়ী। ভোট ছাড়া নির্বাচিত হওয়া হচ্ছে বড় দুর্নীতি।
জামায়াতের প্রতিনিধি দলের সঙ্গে আলোচনার শুরুতে ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, রাষ্ট্র সংস্কারের উদ্যোগ অন্তর্বর্তী সরকারের নয়। এটা বাংলাদেশের গণমানুষের দীর্ঘদিনের আকাক্সক্ষার ফলাফল। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে চলমান আলোচনার উদ্দেশ্য থাকবে একটি জাতীয় সনদ তৈরি করা। আমরা একটা সাম্যের বাংলাদেশ গড়ার সুযোগ পেয়েছি। তাই আমাদের আলোচনার উদ্দেশ্য থাকবে, একটি জাতীয় সনদ তৈরি করা। সংস্কারের উদ্যোগ শুধু রাজনৈতিক দলগুলোর স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় নয় উল্লেখ করে আলী রীয়াজ বলেন, বাংলাদেশের গণমানুষ সংস্কারের এই গুরুদায়িত্ব রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজ, গণমাধ্যমসহ প্রতিটি দায়িত্বশীল পক্ষকে অর্পণ করেছেন। আমরা সেই লক্ষ্যে কাজ করতে চাই। যেখানে কোনো মানুষকে দ্বিতীয়বার বিচারবহির্ভূত হত্যা, গুম, খুনের শিকার হতে হবে না।
মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়, কিন্তু ট্র্যাকব্যাক এবং পিংব্যাক খোলা.