ঝিনাইদহে প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে নারী কেলেঙ্কারিসহ অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ

 আত্মহত্যা করেছেন চাচাতো ভাইয়ের স্ত্রী : ভাগিয়ে বিয়ে করেছেন আরেক স্ত্রীকে

খাইরুল ইসলাম নিরব, ঝিনাইদহ: চাচাতো ভাইয়ের প্রথম স্ত্রীকে উত্যক্ত করতেন। বিষয়টি জানাজানি হলে চরমপন্থি সন্ত্রাসীদের দিয়ে ভয়ভীতি দেখান। একপর্যায়ে আত্মহত্যা করেন ওই নারী। এই চাচাতো ভাইয়ের দ্বিতীয় স্ত্রীকে অফিস সহায়ক পদে নিয়োগ দিয়েছেন। পরে তাকে বিয়ে করেছেন। অডিটের কথা বলে বিদ্যালয়ের শিক্ষক-কর্মচারীদের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন তিনি। সরকারিভাবে নিষিদ্ধ করা হলেও নোট-গাইড কিনতে শিক্ষার্থীদের উৎসাহিত করতে পুস্তক প্রকাশকদের কাছ থেকে নিয়েছেন মোটা অঙ্কের কমিশন। বেতনের অর্থ ইএফটিতে পেতে হলে ভুল তথ্য সংশোধনের নামে শিক্ষক-কর্মচারীদের কাছ থেকে হাতিয়েছেন টাকা। এতো অভিযোগ যার বিরুদ্ধে, তিনি আবু আহমেদ বিশ্বাস। ঝিনাইদহ সদর উপজেলার হরিশংকরপুর জেসি মাধ্যমিক বিদ্যাপীঠের প্রধান শিক্ষক।
২০১০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে বিদ্যালয়টিতে যোগদানের পর থেকে একের পর এক অনিয়ম, দুর্নীতি ও নারী কেলেঙ্কারি যেন পিছু ছাড়ছে না তার। খোদ শিক্ষা কর্মকর্তাও বলছেন, আবু আহমেদ শিক্ষক নামধারী একজন লম্পট।
আবু আহমেদের গ্রামের বাড়ি ঝিনাইদহের শৈলকুপা উপজেলার রূপদাহ ব্যাসপুরে। সরেজমিনে বিদ্যালয়ে গিয়ে তার দেখা পাওয়া দুষ্কর। শিক্ষকদের অভিযোগ, সহকারী প্রধান শিক্ষক আমিরুল ইসলামকে দায়িত্বে রেখে শুধু হাজিরা খাতায় স্বাক্ষর করে বেরিয়ে যান আবু আহমেদ। এতে বিদ্যালয়ের কার্যক্রম পরিচালনায় বিঘœ ঘটছে।
ভুক্তভোগী শের আলী জানান, আবু আহমেদ আমার চাচাতো বড় ভাই। সে প্রকৃতপক্ষে শিক্ষক নামের একটা লম্পট। ১৯৯৯ সালে আমি বিয়ে করি ঝিনাইদহ সদর উপজেলার হলিধানী ইউনিয়নের বিনোদপুর গ্রামে। বিয়ের দেড় মাস পর থেকে আমার স্ত্রীকে প্রতিনিয়ত উত্যক্ত করে আবু আহমেদ। লোকলজ্জায় বিষয়টি গোপন রাখলেও একপর্যায়ে প্রতিবাদ করলে তা জানাজানি হয়ে যায়। ঘটনা ধামাচাপা দিতে চরমপন্থি সন্ত্রাসীদের দিয়ে ভয়ভীতি দেখায় সে। আমার স্ত্রী আমার ঘরের মধ্যে কাপড়ের রশিতে ঝুলে আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে হয়। তিনি বলেন, ২০০৪ সালে পদ্মাকর ইউনিয়নের সমসপুর গ্রামের ইব্রাহিম মল্লিকের বড় মেয়ে অন্তরা খাতুনকে দ্বিতীয় বিয়ে করি। আমার দুটি ছেলে সন্তান রয়েছে। বড় ছেলে মেহেদী হাসান বাবু (২০) অনার্সে পড়ে। ছোট ছেলে জুনায়েদ হাসান লাবু (১৩) সপ্তম শ্রেণিতে লেখাপড়া করে।
শের আলী জানান, হাটগোপালপুর বাজারে জমি কিনে ২০১২ সালে বাড়ি করি। সেখানে পরিবার রেখে আমি কাজের জন্য সিঙ্গাপুরে আসি। অতীতের অপকর্ম ভুলে আবু আহমেদের সাথে যোগাযোগ রাখি। ছেলেদের লেখাপড়ার জন্য তার মাধ্যমে ঝিনাইদহ শহরে বাসা ভাড়া করি। এরই মাঝে আমি দেশে আসলে স্ত্রী আমাকে জানায় আবু আহমেদ যে বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সেখানে অফিস সহায়ক পদে চাকরির সুযোগ আছে, আমি ওই স্কুলে চাকরি করবো। আমি প্রথমে রাজি না থাকলেও সন্তান ও শ্বশুরবাড়ির এলাকা হওয়ায় সকলের অনুমতিক্রমে চাকরিতে আবেদন করাতে রাজি হই। সে সময় আবু আহমেদ আমার গ্রামের বাড়িতে এসে স্ত্রীকে চাকরি দেয়ার কথা বলে। সে জানায় এই পদে চাকরি পাওয়ার জন্য ১০ থেকে ১২ লাখ টাকা দেয়ার লোক রয়েছে। তোরা নিজের লোক বলে তোদের কাছ থেকে বেশি নিবো না, তোরা ৩ লাখ ৩০ হাজার টাকা জোগাড় কর। একথা বলার কিছুদিন পর টাকা নিয়ে চাকরি দেয়। প্রবাসে আমার ছুটি শেষ হলে আমি আবার সিঙ্গাপুরে চলে যাই। একপর্যায়ে আমার দ্বিতীয় স্ত্রীর সাথে আবু আহমেদ পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়ে।
তিনি বলেন, স্ত্রীর পরকীয়ার বিষয়টি নিয়ে কাছের লোকজন জানালে আমি দেশে চলে আসি। প্রতিবাদের একপর্যায়ে আমার স্ত্রী হাটগোপালপুরের বাসা থেকে ঝিনাইদহ শহরে চলে যায়। এরপর আমাকে তালাকের কাগজ পাঠায়। পরে জানতে পারি ঝিনাইদহ শহরের আদর্শপাড়ায় একটি বাসায় গোপনে ভাড়া ছিল। অসামাজিক কর্মকা-ের অভিযোগে ওই বাড়ি মালিক তাকে বের করে দেয়। এখন শুনছি সে নাকি আবু আহমেদের বিবাহিত স্ত্রী। এই দুঃসময়ে দুই সন্তানকে বছর দুয়েক নিজে রান্না করে খাওয়াতে হয়েছে। এসব কথা বলতে বলতে কেঁদে ফেলেন তিনি।
শের আলী জানান, প্রায় ১৫ বছর সিঙ্গাপুর থেকে যে টাকা পাঠিয়েছি তা এখন আবু আহমেদের পকেটে। হাটগোপালপুরের বাড়িও এখন আমার নেই। ছেলেরা এতিমের মতো চলাফেরা করে। এসব সহ্য করতে না পেরে আবারও কিছুদিন আগে প্রবাসে পাড়ি জমিয়েছি। ১৮ বছরের সংসারে আমার জীবনের সবকিছু শেষ করে দিয়েছে; আমি এখন নিরুপায়। এই লম্পট আবু আহমেদের কঠোর বিচার দাবি করছি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিদ্যালয়ের এক সহকারী শিক্ষক জানান, ২০২৩ সালে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অডিটের কথা বলে সব শিক্ষকের কাছ থেকে ১২ থেকে ১৮ হাজার করে মোট ২ লাখ ৮০ হাজার টাকা সহকারী প্রধান শিক্ষক আমিরুলের মাধ্যমে ঘুষ উত্তোলন করে। ঘুষের টাকা তিনি ব্যাংকের মাধ্যমে অডিটে আসা ব্যক্তিদের দিয়েছেন মর্মে শিক্ষকদের জানান। পরে শিক্ষক আশপাশের বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সাথে কথা বলে জানতে পারেন অডিটে আসা কর্মকর্তারা কোন ঘুষ নেননি।
তিনি জানান, আমার কোনো সার্টিফিকেট জাল নেই, কেন আমি অডিটের নামে ঘুষ দিব। কেন আমার বেতনের টাকা থেকে ১২ হাজার ৯ শত টাকা জোরপূর্বক ঘুষ নিলেন। এভাবে করে বিদ্যালয়ের কর্মচারীদেরও তিনি ছাড় দেননি। বিদ্যালয়টি এখন ধ্বংসের মুখে।
ওই বিদ্যালয়ের ধর্মীয় শিক্ষিকা জাহানারা খাতুন, ক্রীড়া শিক্ষক হেলাল উদ্দিন ও সমাজ বিজ্ঞানের শিক্ষক তুষার কান্তি ঘোষের কাছে জানতে চাইলে তারা ঘুষের টাকা দেওয়ার কথা স্বীকার করেন।
মিন্টু মুন্সি নামে স্থানীয় এক বাসিন্দা জানান, একজন প্রধান শিক্ষক যদি এমন হয় তাহলে শিক্ষার্থীরা তার কাছ থেকে কি শিখবে। এই দুর্নীতিবাজ লম্পট শিক্ষকের বিচার দাবি করছি।
জানতে চাইলে বিদ্যালয়ের আরেক শিক্ষক বলেন, প্রধান শিক্ষকের দ্বিতীয় স্ত্রী আমাদের প্রতিষ্ঠানের অফিস সহায়ক। গর্ভবর্তী হওয়ায় তিনি ৬ মাসের মাতৃত্বকালীন ছুটিতে ছিলেন। সম্প্রতি হাটগোপালপুরে প্রধান শিক্ষকের ভাড়া বাসায় গিয়েছিলাম। বাচ্চার বয়স ৪১ দিন হওয়ায় একটি অনুষ্ঠানে দাওয়াত দিয়েছিলেন। বিবাহের বিষয়টি আগে গোপন থাকলেও বাচ্চা হওয়ার পর তা জানতে পারি।
অপর এক শিক্ষক বলেন, বেতনের জন্য ইএফটি কার্যক্রম সংশোধনের নামে ২ হাজার টাকা করে নিয়েছেন প্রধান শিক্ষক। ভাইয়ের বউ ভাগিয়ে নিয়ে তার বিবাহের ঘটনাটি ন্যাক্কারজনক হলেও সত্য।
নোট গাইড কোম্পানির এক প্রতিনিধি জানান, স্কুলের শিক্ষার্থীদের মাঝে নোট গাইড চালিয়ে দেওয়ার কথা বলে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে প্রতারণা করেছেন প্রধান শিক্ষক আবু আহমেদ।
এর আগে আবু আহমেদের বিচার চেয়ে ঝিনাইদহ সদর থানা ও সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বরাবর লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন তার বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া কন্যা নিপা। তৎকালীন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এসএম শাহীন অভিযোগের বিষয়টি তদন্তের জন্য সদর উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা কামরুজ্জামানকে তদন্তের দায়িত্ব দেন। শিক্ষা কর্মকর্তা তদন্তে গেলে তাকেও চাপের মুখে পড়তে হয়। সে সময় আওয়ামী লীগের নেতাদের ছত্রছায়ায় তিনি প্রভাব খাটিয়ে পার পেয়ে যান। ওই বিদ্যালয়ের সহকারি প্রধান শিক্ষক আমিরুল ইসলাম বলেন, অডিটের নামে আমি কোন শিক্ষকের কাছ থেকে ঘুষের টাকা নেয়নি।
অভিযোগের বিষয়ে প্রধান শিক্ষক আবু আহমেদ বলেন, বিদ্যালয়ে মোট ২৩ জন শিক্ষক-কর্মচারী রয়েছেন। তাদের কাছ থেকে অডিটের নামে ঘুষ নেওয়ার কথা ভিত্তিহীন বলে দাবি করেন। বিদ্যালয়ের সাড়ে ৫শ শিক্ষার্থীর মাঝে নোট গাইড কেনার ব্যাপারে পুস্তক প্রকাশকের কাছ থেকে কমিশন নেয়ার অভিযোগও অস্বীকার করেন তিনি।
অফিস সহায়ক ও চাচাতো ভাইয়ের স্ত্রী অন্তরা খাতুনকে বিবাহের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটি ব্যক্তিগত বিষয়, এই ব্যাপারে কথা বলবেন না। এ ব্যাপারে উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার শেখ কামরুজ্জামান বলেন, আবু আহমেদ শিক্ষক নামধারী একজন লম্পট। তিনি নিজ প্রতিষ্ঠানে চাচাতো ভাইয়ের স্ত্রীকে নিয়োগ বোর্ডের মাধ্যমে ছোট বোন পরিচয় দিয়ে চাকুরি দিয়েছিলেন। পরবর্তীতে শুনছি তিনি নাকি অফিস সহায়ক অন্তরা খাতুনকে বিবাহ করেছেন। সম্প্রতি তার একটা সন্তানও হয়েছে বলে শিক্ষকরা আমাকে জানিয়েছেন। তবে দ্বিতীয় বিয়ে সম্পর্কে উপজেলা শিক্ষা অফিসকে তিনি অবগত করেননি। জানতে চাইলে জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার আব্বাস উদ্দিন বলেন, বিষয়টি আমার জানা নেই। তবে এ বিষয়ে লিখিত অভিযোগ পেলে তদন্তপূর্বক আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

এছাড়া, আরও পড়ুনঃ

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়, কিন্তু ট্র্যাকব্যাক এবং পিংব্যাক খোলা.

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More