স্টাফ রিপোর্টার: ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত ও মৃত্যুর যোগফল প্রতিদিনই বাড়ছে। ডেঙ্গুর চিকিৎসায় সরকারি-বেসরকারি একাধিক হাসপাতালও রয়েছে। কিন্তু সরকারের প্রায় ৩০টির মতো বিশেষায়িত ইনস্টিটিউিট ও হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের কারও ডেঙ্গু শনাক্ত হলে সেখানে চিকিৎসা মিলছে না। এমনকি এডিস মশা থেকে রক্ষা পেতে রোগীদের মশারি সরবরাহ করা হচ্ছে না। অনেক হাসপাতাল আঙিনায় মশা নিধন কার্যক্রম তেমন নেই। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিশেষায়িত হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীরা কোমরবিডিটি বা বিভিন্ন ধরনের রোগে আক্রান্ত হলে তাদের শারীরিক অবনতির ঝুঁকি বেশি থাকে। বর্তমানে দেশজুড়ে এডিস মশার প্রকোপ বেড়েছে। এমন পরিস্থিতিতে এসব হাসপাতালে এডিস মশা তথা ডেঙ্গু পরিস্থিতি মোকাবেলায় নজর কম দিলে রোগীদের মৃত্যুঝুঁকি বহুগুণ বেড়ে যাবে।
জানা গেছে, সরকারের জেনারেল হাসপাতালের বাইরে হাতেগোনা দু-একটি ছাড়া সারা দেশের বিশেষায়িত হাসপাতালে ডেঙ্গু পরীক্ষা ও চিকিৎসা নেওয়া রোগীর তথ্য নেই স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কাছে। এতে দেশের ১৫টি জাতীয় ইনস্টিটিউট তথা বিশেষায়িত হাসপাতাল, একটি হোমিওপ্যাথিক মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, একটি আয়ুবের্দিক ও ইউনানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং একটি ডেন্টাল মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল ছাড়াও আরও ১৩টি বক্ষ্যব্যাধি হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের কারও ডেঙ্গু শনাক্ত হলে সেখানে চিকিৎসা নেয়া ডেঙ্গু রোগীদের প্রকৃত চিত্র জানা যাচ্ছে না। বিশেষায়িত হাসপাতালগুলোর মধ্যে কেবল মহাখালীর কোভিড-১৯ হাসপাতাল ও শ্যামলীর ২৫০ শয্যার হাসপাতালের ডেঙ্গুর রোগীর তথ্য দেয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে প্রতিদিন ডেঙ্গু রোগীদের যে তথ্য জানানো হয় সেখানে রাজধানীর ২০টি সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত এবং ৫৭টি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ডেঙ্গু রোগী ও মৃত্যুর তথ্য থাকে। এর বাইরে সব সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ডেঙ্গু রোগী ও মৃত্যুর দৈনন্দিন তথ্য দিচ্ছে দপ্তরটি। সেখানে ঢাকার বাইরে বেসরকারি হাসপাতালের ভর্তি ডেঙ্গু রোগীর তথ্য থাকে না।
গত এক সপ্তাহ সরেজমিন রাজধানীর একাধিক বিশেষায়িত হাসপাতাল ঘুরে সেখানে একজন রোগীকেও মশারি ব্যবহার করতে দেখা যায়নি। ডেঙ্গু ভাইরাস প্রতিরোধে কোনো ধরনের প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থাও নিতে দেখা যায়নি রোগী ও হাসপাতাল সংশ্লিষ্টদেরক। সোমবার রাজধানীর জাতীয় কিডনি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের বহির্বিভাগে কিডনি সমস্যা ছাড়াও বেশ কিছু রোগীকে জ্বরের চিকিৎসা নিতে আসতে দেখা যায়। এই হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা. ইশতিয়াক মোশাররফ বলেন, কিডনি রোগীরা ডেঙ্গু আক্রান্ত হতে পারেন। এ ক্ষেত্রে ডায়ালাইসিস চলছে এমন কোমরবিডিটি সম্পন্নদের শক সিনড্রোম হওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে। তাদের আইসিইউ সাপোর্টের প্রয়োজন হতে পারে। আমাদের হাসপাতালে আইসিইউ নেই। এ ধরনের রোগীদের আমরা ঢাকা মেডিকেল বা ডেঙ্গুর পাশাপাশি কিডনি চিকিৎসা আছে এমন হাসপাতাল পাঠিয়ে থাকি। কিডনি ইনস্টিটিউটে মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের দায়িত্ব রয়েছেন ইমিউনোলজি বিভাগের চিকিৎসক ডা. কানিজ ফাতেমা। তিনি বলেন, এখানে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের অনেকেই ডেঙ্গুজ্বরের উপসর্গ দেখা যাচ্ছে।
জুলাই মাসে ১৭৬ জন রোগীর ডেঙ্গুর এনএস-১ পরীক্ষা করা হয়েছে। এ সময় ৪২ জনের আইজিজি এবং ৫৭ জনের আইজিএম পরীক্ষা করা হয়েছে। এর মধ্যে ২৬ জনের আইজিজি ও আইজিএম একসঙ্গে পরীক্ষা করা হয়েছে।
জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানের (নিটোর) তথা পঙ্গু হাসপাতালে খোঁজ নিয়ে সেখানেও একাধিক রোগীর ডেঙ্গু আক্রান্তের তথ্য পাওয়া যায়।
পঙ্গু হাসপাতালের সামনে রাজু নামে এক অভিভাবকের সঙ্গে সোমবার কথা হয় এ প্রতিবেদকের। তিনি জানান, তার ভাই গত দশদিন ধরে এখানে ভাঙা পায়ের চিকিৎসা নিচ্ছেন। গত তিন দিন ধরে জ্বরে ভুগছেন। ডেঙ্গু পরীক্ষা করে পজেটিভ ধরা পড়েছে। চিকিৎসকরা ছাড়পত্র দিয়ে ঢাকা মেডিকেলে রেফার করেছেন। ডেঙ্গুজ্বর ভালো হলে আবার ভর্তি হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন।
পঙ্গু হাসপাতালের প্যাথোলজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. জাহরা আজিজ বলেন, গত এক সপ্তাহেই ৫০ জনের বেশি রোগীর ডেঙ্গু পরীক্ষা করা হয়েছে। যাদের ডেঙ্গু শনাক্ত হচ্ছে তাদের প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। আক্রান্তদের মশারি ব্যবহারের পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হাসপাতাল ও ক্লিনিক শাখার পরিচালক ডা. দাউদ আদনান বলেন, বিশেষায়িত হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের কারও ডেঙ্গু সন্দেহ হলে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়। পজেটিভ হলে পার্শ্ববর্তী জেনারেল হাসপাতালে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এডিস মশা নিধন ও ডেঙ্গুর প্রকোপ মোকাবেলায় জেনারেল হাসপাতালের মতো বিশেষায়িত হাসপাতালগুলোতে একই নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। হাসপাতাল আঙিনা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখা, সিটি করপোরেশনের সহায়তায় নিয়মিত ফগিংয়ের জন্য বলা হয়েছে। কোনো রোগীর ডেঙ্গু হলে মশারি ব্যবহারের জন্য বলা হয়েছে। তবে তারা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কন্ট্রোল রুমে ডেঙ্গু রোগীদের তথ্য পাঠায় কিনা সে ব্যাপারে জানা নেই।
এদিকে সবশেষ গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ঢাকা মেডিকেলে একজন নারী চিকিৎসকসহ ১৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ সময় নতুন করে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন আরও দুই হাজার ৭৪২ জন। নতুন রোগীদের মধ্যে এক হাজার ৭৪০ জন, অর্থাৎ ৬২ দশমিক ৭৩ শতাংশই ঢাকার বাইরের। ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন এক হাজার ১১৯ জন। সব মিলিয়ে এ বছর হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৭২ হাজার ২২৫ জনে। তাদের মধ্যে ৩৪০ জনের মৃত্যু হয়েছে ডেঙ্গুতে। তবে এদিকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দেওয়া তথ্য বলছে, চলতি আগস্টের প্রথম ৮ দিনেই ২০ হাজার ৩৯৩ জন ডেঙ্গু নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এই সময়ে ৮৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। অর্থাৎ প্রতিদিন ডেঙ্গুতে ১০ জনের বেশি মানুষের মৃত্যুর খবর আসছে। মঙ্গলবার সারা দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ৯ হাজার ৪৬৩ জন রোগী ভর্তি ছিলেন। তাদের মধ্যে ঢাকায় চার হাজার ৪৮২ জন এবং ঢাকার বাইরের বিভিন্ন জেলায় চার হাজার ৯৮১ জন।