জীবনযুদ্ধে বেরিয়ে লাশ হলেন নারীসহ ১৪ শ্রমিক
সিলেটে ট্রাক-পিকআপের মুখোমুখি সংঘর্ষ : দুমড়েমুচড়ে গেছে দুই বাহন
স্টাফ রিপোর্টার: সিলেটে ট্রাক-পিকআপ সংঘর্ষে নারীসহ ১৪ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন অন্তত ১১ জন। তাদের উদ্ধার করে সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। গতকাল বুধবার সকাল সাড়ে ৫টার দিকে নাজিরবাজারের কুতুবপুর এলাকায় এই দুর্ঘটনা ঘটে। দুর্ঘটনার পর ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে যানজটের সৃষ্টি হয়। সিলেট মহানগর পুলিশের দক্ষিণ সুরমা থানার ওসি মো. শামসুদ্দোহা সংবাদমাধ্যমকে জানান, ‘একটি বড় ট্রাক ও পিকআপের সংঘর্ষে এ দুর্ঘটনা ঘটেছে। নিহত ব্যক্তিরা সবাই নির্মাণ শ্রমিক। নিহতরা হলেন-সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার ভাটিপাড়া গ্রামের মো. সিজিল মিয়া (৫৫), একলিম মিয়া (৫৫), হারিছ মিয়া (৬৫), সৌরভ মিয়া (২৭), সাজেদুর (৬০), বাদশা মিয়া (৩০), সাধু মিয়া (৫০), রশিদ মিয়া (৫০) ও মেহের (২৫); সুনামগঞ্জের শান্তিগঞ্জ উপজেলার শাহীন মিয়া (৪০), দুলাল মিয়া (২৬) ও আওলাদ হোসেন (৫০); হবিগঞ্জের চুনারুঘাটের আমিনা বেগম (৪৫) এবং নেত্রকোনার বারহাট্টার আওলাদ মিয়া (৪০)। এদিকে এ ঘটনায় গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী বেগম মন্নুজান সুফিয়ান। একই সঙ্গে নিহত ও আহত শ্রমিকদের আর্থিক সহায়তার ঘোষণা দিয়েছেন তিনি। এ দুর্ঘটনায় নিহতের প্রত্যেক পরিবারকে দুই লাখ টাকা করে দেয়া হবে। বুধবার এক শোকবার্তায় নিহতদের রুহের মাগফিরাত কামনা করেন প্রতিমন্ত্রী এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান। শ্রম প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘এটি একটি অত্যন্ত হৃদয়বিদারক দুর্ঘটনা। হতাহতরা সবাই শ্রমজীবী দরিদ্র মেহনতি মানুষ। শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের অধীন বাংলাদেশ শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশন তহবিল থেকে নিহত শ্রমিকদের প্রত্যেক পরিবারকে দুই লাখ এবং আহতদের চিকিৎসায় প্রত্যেককে ৫০ হাজার টাকা করে সহায়তা দেয়া হবে।’ এ ছাড়া সিলেটের জেলা প্রশাসক মো. মজিবর রহমান জানান, তাৎক্ষণিক নিহতদের পরিবারকে ২০ হাজার ও আহতদের পরিবারকে ১০ হাজার করে টাকা দেয়া হয়েছে। সিলেট ফায়ার সার্ভিসের উপ-পরিচালক মো. মনিরুজ্জামান সংবাদমাধ্যমকে জানান, মালবাহী ট্রাকটি সিলেটের দিকে আসছিল। আর শ্রমিকদের বহনকারী পিকআপ ভ্যানটি যাচ্ছিলো বিপরিত দিকে। মুখোমুখি সংঘর্ষে দুই বাহনই দুমড়েমুচড়ে যায়। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, সিলেট নগর থেকে একটি পিকআপযোগে অন্তত ৩০ জন নির্মাণ শ্রমিক ওসমানীনগর উপজেলার গোয়ালাবাজার যাচ্ছিলেন। সকাল সাড়ে ৫টার দিকে পিকআপটি দক্ষিণ সুরমার নাজিরবাজার এলাকার কুতুবপুর নামক স্থানে পৌঁছলে মুনশীগঞ্জ থেকে ছেড়ে আসা সিলেটগামী বালুবহনকারী একটি ট্রাকের সংঘর্ষ হয়। এতে ঘটনাস্থলেই ১১ জন নিহত হন। খবর পেয়ে দক্ষিণ সুরমা থানা পুলিশ এবং সিলেট ও ওসমানীনগরের ফায়ার সার্ভিস স্টেশনের একাধিক ইউনিট ঘটনাস্থলে পৌঁছে হতাহতদের উদ্ধার করে ওসমানী হাসপাতালে পাঠায়। এ সময় স্থানীয়রাও সহযোগিতা করেন। দুর্ঘটনার পর নাজিরবাজারের দুদিকে সিলেট-ঢাকা মহাসড়কে কয়েক কিলোমিটার দীর্ঘ যানজটের সৃষ্টি হয়। পরে পুলিশের তৎপরতায় ৩ ঘণ্টা পর সাড়ে ৮টার দিকে যান চলাচল স্বাভাবিক হয়। দুর্ঘটনায় আহত তরুণ নির্মাণ শ্রমিক পল্লব আহমদ (২৫) ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে তিনি বলেন, ‘ঢাকার দিক থেকে আসা ট্রাকটি যখন ডান পাশে এসে আমাদের পিকআপটিকে ধাক্কা দেয়, তখন খুব জোরে শব্দ হয়। ট্রাকটি দ্রম্নতবেগে আসছিল। মনে হয় চালক ঘুমিয়ে ছিলেন। সজোরে ধাক্কা খেয়ে আমাদের পিকআপটি উল্টে যায়। আমি মাথায় আঘাত পাই। এরপর আমার আর কিছু মনে নেই।’
পিকআপে থাকা আহত রবিউল ইসলাম বলেন, হঠাৎ বিপরীত দিক থেকে একটি ট্রাক এসে আঘাত করলে আমাদের পিকআপ উল্টে যায়। ট্রাকটি সড়কে তার ডানে চলে এসেছিল। দুর্ঘটনায় আমি আর বাবা আহত হলেও প্রাণে বেঁচে আছি।? তবে আমার বড় চাচা আর নেই।’ সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে শের ইসলাম বলেন, বিপরীত দিকে থেকে আসা ট্রাকের ভুলেই এতগুলো প্রাণ ঝরে গেল। আমার ভাই মারা গেছেন। আরও কয়েকজন বন্ধু ও স্বজন আহত হয়েছেন। এদিকে ওসমানী হাসপাতালের প্রাঙ্গণে হতাহতদের স্বজনরা ভিড় করেন। তাদের অনেকের কান্নায় হাসপাতালের বাতাস ভারী হয়ে উঠে। নিহতদের মধ্যে এক সপ্তাহ আগে বেড়ানোর কথা বলে সুনামগঞ্জের দিরাই থেকে সিলেটে এসেছিলেন সৌরভ। পরে বাড়ির লোকদের না জানিয়েই পরিচিতদের সঙ্গে নির্মাণ শ্রমিকের কাজে যোগ দেন। এ দিকে বাড়িতে তার বিয়ের জন্য পাত্রী পছন্দ করে রেখেছিলেন তার মা। ছেলের মৃত্যুর খবর শুনে স্বামী সিরাজ মিয়ার সঙ্গে হাসপাতালে ছুটে আসেন আমিনা বেগম। তিনি কান্না জড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘আমার পুতরে (ছেলে) বিয়া কারইতে আসলাম, মেয়ে দেখি রাখছিলাম গো। আমার পুতের কিতা হইল, তোমরা আমার পুতরে আনি দেও।’ আমিনা বেগমের মতো আরও অনেকে কান্নায়-আহাজারি করতে দেখা যায় হাসপাতালে। হাফিজা বেগম নামে আরেক নারী জানান, রাত ৪টার দিয়ে তার মেয়ের জামাই মেহের বাসা থেকে কাজের জন্য বের হয়ে আসে। তিনি নির্মাণ শ্রমিকের কাজ করতেন। পরে মেহেররে সঙ্গে থাকা লোকজনের মাধ্যমে খবর পান সড়ক দুর্ঘটনায় আহত মেহেরকে ওসমানী হাসপাতালে আনা হয়েছে। হাসপাতালে এসে জানতে পারেন মেহের মারা গেছে। তিনিও কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলতে থাকেন, এখন তার মেয়ের কি হবে। কারা দেখবে তাদের, এ কথা বলতে বলতে প্রায় অজ্ঞান হয়ে পড়েন তিনি। তখন পাশে থাকা আরেক নারী হাফিজা বেগমকে ধরে রাখেন। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স সিলেটের উপ-পরিচালক মনিরুজ্জামান সংবাদমাধ্যমকে বলেন, আমরা খবর পেয়েই ঘটনাস্থলেই ছুটে আসি। সকাল ৭টা পর্যন্ত ১১ জনের মৃতদেহ ও অন্তত ১০ জন গুরুতর আহতকে উদ্ধার করে ওসমানী হাসপাতালে পাঠানো হয়। আমরা আসার আগে স্থানীয়রা আরও আহত কয়েকজনকে উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠান। পরে হাসপাতালে আরও তিনজনের মৃত্যু হয়। ভাটিপাড়ায় বুকফাটা কান্না নিহত ১৪ জনের মধ্যে সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার ভাটিপাড়া গ্রামের বাসিন্দাই ৯ জন। নিহতদের বাড়িতে বাড়িতে এখন চলছে শোকের মাতম। শোকাচ্ছন্ন স্বজনরা করছেন বুকফাটা কান্না। তাদের কেউ হারিয়েছেন সন্তান, কেউ হারিয়েছেন স্বামী, কেউ ভাই। স্বজনহারাদের কান্নায় ভারী হয়ে উঠেছে ওই গ্রামের আকাশ-বাতাস। সংবাদমাধ্যমে দুর্ঘটনার খবর ছড়িয়ে পড়লে স্বজনহারারা বিলাপ করতে শুরু করেন। অতি দরিদ্র এসব পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম সদস্যদের হারিয়ে নির্বাক হয়ে পড়েন তারা। আশপাশের গ্রামগুলোতে মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়ায় নিহতদের বাড়িতে দলে দলে চলে আসে মানুষজন। নিহত রশিদ মিয়ার স্ত্রী রাফিছা বেগম জানান, ছয় মাস আগে একমাত্র মেয়ের বিয়ে দেয়া হয়েছে। মেয়ের বিয়ের ঋণের টাকা পরিশোধ করতে রশিদ শনিবার সিলেটে ছাদ ঢালাইয়ের কাজ করতে যান। পরিবারে আয় করার মতো আর কেউ নেই। এভাবে ভাটিপাড়া গ্রামে ৯টি পরিবার নিস্ব হয়ে পড়ে এই দুর্ঘটনায়।