তাপপ্রবাহ এখনই কাটছে না : বর্ষা আসতেও দেরি

সাগরে দুটি লঘুচাপের কারণে মরসুমি বায়ু আসতে দেরি

স্টাফ রিপোর্টার: জ্যৈষ্ঠ মাসে তীব্র গরমে অতিষ্ঠ দেশবাসীর মনে একটাই প্রশ্ন, তাপপ্রবাহ কাটবে কবে? বর্ষা আসতে আর কতোদিন? কিন্তু কোনো ক্ষেত্রেই স্বস্তির খবর আপাতত নেই আবহাওয়া অধিদপ্তরের কাছে। চলমান তাপপ্রবাহ এখনই কাটছে না বলে আভাস মিলেছে। আর বর্ষা আসতেও হচ্ছে দেরি। এপ্রিলজুড়ে তাপপ্রবাহে নাভিঃশ্বাস উঠেছিলো জনজীবনে; তাপমাত্রার রেকর্ডও হয়েছিলো তখন। মে মাসের শুরুতে বৃষ্টিতে পরিস্থিতি কিছুটা সহনীয় হলেও গত সপ্তাহ খানেক ধরে প্রচ- গরমে প্রাণ আবার ওষ্ঠাগত। তাপমাত্রা এপ্রিল ছাড়িয়ে না গেলেও বাতাসে আর্দ্রতা বেশি থাকার কারণে গরম হয়ে উঠেছে অসহনীয়, সেই সঙ্গে বিদ্যুতের আসা-যাওয়া নগর জীবনে বাড়িয়েছে ভোগান্তি। ৫০ বছর বয়সী জেসমিন নাহারের এই গরমের ভয়ে কাজ থাকলেও বাইরে বের হতে চাচ্ছিলেন না। আবার ঘরে থেকেও নিস্তার পাচ্ছিলেন না।

জেসমিনের ভাষ্যে, ‘বিশেষ কাজে বাসার বাইরে যাওয়া দরকার, সেটা করতে পারছি না। কারণ রোদে প্রচ- মাথা ব্যথা করে। কিন্তু বাসায় যে আরাম করে থাকবো, সেই উপায়ও কম। দিনের মধ্যে কতোবার যে কারেন্ট চলে যায়!’

জ্বালানি সঙ্কটে বিদ্যুৎ উৎপাদন যে ব্যাহত হচ্ছে, তাতে লোডশেডিং আরও দুই সপ্তাহের মতে থাকবে বলে জানিয়েছেন বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। কিন্তু তাপদাহ? আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে, আগামী পাঁচ থেকে ছয় দিন সারাদেশে মৃদু, মাঝারি এবং তীব্র তাপপ্রবাহ অব্যাহত থাকবে।

আবহাওয়াবিদ ড. আবুল কালাম মল্লিক বলেন, এই পাঁচ-ছয় দিনে দেশের বিভিন্ন জায়গায় বিচ্ছিন্নভাবে বৃষ্টি নামতে পারে। তবে ১৩ তারিখের আগে সামগ্রিকভাবে তাপমাত্রা কমিয়ে ফেলার মতো ভারী বৃষ্টির দেখা পাওয়া যাবে না। তিনি বলেন, ‘রোবাবর কিশোরগঞ্জ, ফেনী, চট্টগ্রামের কিছু কিছু জায়গায় বৃষ্টি হয়েছে।’ সিলেটে হবে। খুলনায় সন্ধ্যার পর হালকা বৃষ্টি হবে। কিন্তু এই সামান্য পরিমাণ বৃষ্টি বিদ্যমান তাপপ্রবাহকে কমাতে পারবে না। ‘১২ থেকে ১৩ তারিখের পর থেকে আকাশ মেঘলা থেকে মেঘাচ্ছন্ন হবে, তাপমাত্রাও কমতে শুরু করবে। ১৩ তারিখ যদি বৃষ্টি হয়, তবে চলমান তাপ্রবাহের ঊর্ধ্বগতি অনেকটাই কমে গিয়ে কিছুটা স্বস্তিদায়ক পরিস্থিতি তৈরি হবে’ তিনি জানান, গত কয়েকদিন ধরে দেশের তাপমাত্রা ৪৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস থেকে ৪১ ডিগ্রির মাঝে ওঠানামা করছে, যা স্বাভাবিকের চেয়ে স্টেশন ভেদে ২ থেকে ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি। রোববার দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় দিনাজপুরে, ৪১ দশমিক ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস। চুয়াডাঙ্গায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিলো ৩৮ দশমিক ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ঢাকায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিলো ৩৭ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস।

থার্মোমিটারের পারদ ৩৬ থেকে ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসে উঠলে আবহাওয়াবিদরা তাকে মৃদু তাপপ্রবাহ বলে। উষ্ণতা বেড়ে ৩৮ থেকে ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস হলে তাকে বলা হয় মাঝারি তাপপ্রবাহ। আর তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি ছাড়িয়ে গেলে তাকে তীব্র তাপপ্রবাহ বলা হয়।

আবহাওয়া অধিদপ্তর আগামী ২৪ ঘণ্টায় রাজশাহী, নওগাঁ, নীলফামারী ও দিনাজপুর জেলার ওপর দিয়ে তীব্র তাপপ্রবাহের আভাস দিয়েছে। ঢাকা, ময়মনসিংহ, খুলনা, বরিশাল বিভাগসহ রংপুর ও রাজশাহী বিভাগের অবশিষ্টাংশ এবং মৌলভীবাজার, চাঁদপুর ও নোয়াখালী জেলার উপর দিয়ে মৃদু থেকে মাঝারি তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে এবং তা অব্যাহত থাকতে পারে।

ড. মল্লিক জানান, চলমান তাপপ্রবাহের মধ্যে গরম অসহনীয় হওয়ার মূল কারণ হল বাতাসে জলীয় বাষ্পের পরিমাণ বেশি। তিনি বলেন, ‘বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ছোঁয়া বাংলাদেশেও লেগেছে। তাছাড়া, এল নিনো সক্রিয় অবস্থায় যাওয়া শুরু করায় এখানে আকাশ প্রায় মেঘমুক্ত। সুতরাং, ৮ থেকে ১২ ঘণ্টা ধরে প্রখর সূর্যের আলো ভূপৃষ্ঠে পতিত হতে থাকে। ‘একারণেই বাতাসের গতিবেগ কম, বাতাসে জলীয় বাষ্পের আধিক্য বেশি। অস্বস্তিও বেশি। তবে এটা শুধু বাংলাদেশেই হচ্ছে, তা না। বাংলাদেশসহ আশেপাশের সকল অঞ্চলের তাপমাত্রাই এখন বেশি।’ এল নিনো জলবায়ুর একটি বিশেষ অবস্থা; যা প্রশান্ত মহাসাগরের বিষুবীয় অঞ্চলের পানির উপরিভাগকে উত্তপ্ত করে তোলে, যার প্রভাব পড়ে অয়ন বায়ু ও পারিপার্শিক জলবায়ুর উপর।

আবহাওয়াবিদ মল্লিক বলেন, এল নিনো সক্রিয় হওয়ায় বর্তমানে বাংলাদেশসহ ভারতের হরিয়ানা, রাজস্থান, উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, দিল্লি, বিহার, পশ্চিমবঙ্গ, মেঘালয়, ত্রিপুরা, নাগাল্যান্ড, অরুণাচল, মিয়ানমার, ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, থাইল্যান্ড, পাকিস্তান, আফগানিস্তান; এ পুরো অঞ্চল এখন ‘হিট ইঞ্জিন’ হিসেবে কাজ করছে। বাংলাদেশে এখন মরসুমি বায়ু প্রবাহিত হওয়ার সময়। কিন্তু এখনও তা না আসাকে চলমান তাপপ্রবাহের অন্যতম কারণ হিসেবে দেখান তিনি।

ঋতুর পরিক্রমায় জুন মাসের মাঝামাঝিতে বাংলায় বর্ষা ঋতু নামে। ভারত মহাসাগর থেকে দক্ষিণ-পশ্চিম মরসুমি এই সময় প্রচুর জলীয় বাষ্প নিয়ে স্থলভাগে এসে ব্যাপক বৃষ্টি ঝরায়। তাতে অবসান ঘটে গ্রীষ্মকালের। আষাঢ় মাস জুনের মাঝামাঝিতে শুরু হলেও দক্ষিণ-পশ্চিম মরসুমি বায়ু অধিকাংশ সময় জুন মাসের শুরুতেই স্থলভাগে এসে পড়ে, ফলে ধীরে ধীরে বৃষ্টির প্রবণতা বাড়ে। তবে এবার সাগরে দুটি লঘুচাপের কারণে মরসুমী বায়ু আসতে দেরি হবে বলে আবহাওয়াবিদরা বার্তা দিচ্ছেন।

ড. মল্লিক বলেন, ‘বঙ্গোপসাগরে মিয়ানমার উপকূলে ৭ তারিখ একটা লঘুচাপ তৈরি হতে পারে এবং আরব সাগরে একটি সুস্পষ্ট লঘুচাপ এখনও আছে। দুই সাগরে দুই লঘুচাপ বিদ্যমান থাকার কারণে বাংলাদেশ ও ভারতের উপর মরসুমি বায়ু প্রবাহ আরম্ভ হতে কিছুটা দেরি হতে পারে।’ তিনি এটাও জানান, গত কয়েকবছর ধরেই জুনের প্রথম সপ্তাহে দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল এবং দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের তাপমাত্রা কিছুটা অস্বাভাবিক আচরণ করছে। ‘সাধারণত আমাদের দেশের চট্টগ্রাম বিভাগে মরসুমি বায়ু প্রবাহ জুনের প্রথম সপ্তাহে শুরু হয় এবং সারাদেশে তা বিস্তার লাভ করতে করতে ১৪ জুন পর্যন্ত লাগে। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিশেষ করে ২০১৫ সালের পর থেকে দেখা যাচ্ছে যে মরসুমি বায়ু আরম্ভ হতে এবং বাংলাদেশের ওপর বিস্তার লাভ করতে সময় লাগছে।’ ‘যেমন, গত বছর লাগলো ২৩ জুন, তার আগের বছর ১৭ জুন, তারও আগে বোধহয় ১৩ বা ১৪ জুন। সুতরাং, মরসুমি বায়ুপ্রবাহটা একটু অস্বাভাবিক বলে মনে হচ্ছে। আর, বর্ষাকালের আরম্ভ এবং বিদায়, দুই ক্ষেত্রেই সিজনাল শিপমেন্ট-এর কারণে কিছুটা ব্যত্যয় পরিলক্ষিত।’ এবছরও মরসুমি বায়ুর স্বস্তি পেতে জুনের তৃতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে বলে ড. মল্লিক মনে করেন। ভারতের আবহাওয়া বিভাগ জানিয়েছে, এ বছর আন্দামান দ্বীপে সময়ের আগে মরসুমি বায়ু চলে এলেও ভারত উপকূলে তা আসতে স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে দেরি হবে। তারা বলছে, স্বাভাবিক সময়ে ৫ জুনের মধ্যে মরসুমি বায়ুর বাংলাদেশ উপকূলে পৌঁছার কথা থাকলেও ৪ জুনও তা অনেক দূরে রয়েছে। তবে শ্রীলঙ্কা এরই মধ্যে মরসুমি বায়ুর দেখা পেয়েছে।

 

এছাড়া, আরও পড়ুনঃ

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More