বাজারকেন্দ্রিক দুটি পক্ষের শক্তির মহড়া গড়িয়েছে খুনোখুনিতে
ফলোআপ : চুয়াডাঙ্গার ভালাইপুরে জোড়া খুন দুই গ্রামের আধিপত্যের লড়াই
স্টাফ রিপোর্টার: চুয়াডাঙ্গা-মেহেরপুর সড়ক ধরে ৭ কিলোমিটার পথ গেলে ভালাইপুর বাজারের পাঁচরাস্তার মোড়। সদর উপজেলার ঝোড়াঘাটা-হুচুকপাড়া, আলমডাঙ্গা উপজেলার কয়রাডাঙ্গা এবং দামুড়হুদা উপজেলার কলাবাড়ীর সংযোগ রাস্তা এসে মিশেছে এই মোড়ে। তিন গ্রামের মানুষের ব্যবসা-বাণিজ্য ও চলাচল সবই ভালাইপুরকেন্দ্রিক। জেলার অন্যতম সবজির মোকাম ভালাইপুরে গত মঙ্গলবার (২৫ এপ্রিল) জোড়া খুনের ঘটনা ঘটে। কাপড়ের দোকানে দরদাম করা নিয়ে ঘটনার সূত্রপাত। তুচ্ছ সেই ঘটনা বড় আকার ধারণ করে বাজারকেন্দ্রিক দুটি পক্ষের শক্তির মহড়ায়।
স্থানীয় বাসিন্দা ও বাজারের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দীর্ঘদিন ধরেই ঝোড়াঘাটা-হুচুকপাড়া ও কয়রাডাঙ্গা গ্রামের বাসিন্দাদের মধ্যে ভালাইপুর বাজারে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে দ্বন্দ্ব চলে আসছিলো। এই লড়াইয়ের জেরেই তুচ্ছ ঘটনা গড়িয়েছে খুনোখুনিতে। একপক্ষ দোকান কর্মচারীকে বাড়ি থেকে তুলে আনতে গিয়ে এবং অন্য পক্ষ প্রতিরোধ গড়তে গিয়ে জড়িয়ে পড়ে সংঘাতে। যাতে নিহত হন কয়রাডাঙ্গা গ্রামের দুই তরুণ। এ ঘটনায় হওয়া মামলার আসামিদের বাড়ি ঝোড়াঘাটা-হুচুকপাড়ায়।
বদলে যাওয়া ভালাইপুর: ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত আতঙ্কের জনপদ ছিলো ভালাইপুর মোড়। দিনে-রাতে প্রায়ই এই মোড় ও আশপাশে ছিনতাই, চাঁদাবাজি, অপহরণের ঘটনা ঘটতো। মাঝেমধ্যে খুনের ঘটনাও ঘটতো। স্বাধীনতার আগে থেকেই চুয়াডাঙ্গা শহরের বড়বাজার মাথাভাঙ্গা নদীর তীরে ছিলো বৃহত্তর কুষ্টিয়ার সবচেয়ে বড় পানের মোকাম। হাট-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, ১৯৯৮ সালের এক শনিবার বাইসাইকেল রাখাকে কেন্দ্র করে একজন পানচাষির সঙ্গে ইজাদারের কর্মীর হাতাহাতি হয়। সে সময় কিছু লোক পানচাষিদের সংগঠিত করে ভালাইপুর নিয়ে যান। কয়রাডাঙ্গা গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা নুরুজ্জামান লাল্টুসহ বেশ কয়েকজনের উদ্যোগে ভালাইপুরে পানের স্থায়ী হাট বসে। পরবর্তী সময় বাজারটি কাঁচামালের মোকামে পরিণত হয়। বর্তমানে সপ্তাহের সাতদিনই ভোর থেকে রাত পর্যন্ত মরসুমি ফল, ফসল ও সবজির জমজমাট বেচাকেনা চলে। সেখানে একের পর এক গড়ে উঠছে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান-মার্কেট।
দুই গ্রামের আধিপত্যের লড়াই: সাত-আট মাস আগে ভালাইপুর বাজার সমিতির নির্বাচন হয়। নির্বাচনে কয়রাডাঙ্গা গ্রামকেন্দ্রিক প্যানেল থেকে দেলোয়ার হোসেন ওরফে দীপু সভাপতি এবং ঝোড়াঘাটা-হুচুকপাড়াকেন্দ্রিক প্যানেল থেকে সোহেল রানা ওরফে শান্তি সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। এ নির্বাচনে মুখোমুখি অবস্থানে দাঁড়িয়ে যায় দুই গ্রামের বাসিন্দারা। ২৫ এপ্রিল রাতে ছুরিকাঘাতে নিহত ব্যক্তিদের একজন আলমসাধুর চালক কয়রাডাঙ্গা গ্রামের সজল আহমেদ (২৭)। তার বাবা আমজাদ হোসেন বলেন, ‘ভালাইপুর বাজারের ভোটের আগেত্তিই দুই গ্রামের হুমরা-চুমড়াদের মদ্দি গো-গোল ছিলো। কেউ কারু দেকতি পাইরতো না। অনেকেই মনে কইরেলো ভোটের পর সপ ঠিক হয়ে যাবে। ঠিক হয়ে গেলি আমার সুনাডার এভাবে মরতি হতো না।’ হত্যা মামলায় বাজার কমিটির সাধারণ সম্পাদক সোহেল রানা এবং কমিটির উপদেষ্টা ছানোয়ার হোসেনকে হুকুমের আসামি করা হয়েছে। তাদের বাড়ি ঝোড়াঘাটা-হুচুকপাড়ায়।
বাজার কমিটির সভাপতি দেলোয়ার হোসেন বলেন, এই বাজার স্থাপনের শুরু থেকেই ব্যবসায়ীদের নিরাপত্তাসহ ব্যবসার উপযুক্ত পরিবেশ বজায় রাখতে নিরন্তর কাজ করে চলেছেন। সেখানে সাধারণ সম্পাদক সোহেল রানা ও উপদেষ্টা ছানোয়ার হোসেন বাজারে অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি করতে কিশোর গ্যাং তৈরিতে মদদ দেয়াসহ নানান অনৈতিক কাজ করে আসছেন। ২৫ এপ্রিল হত্যা মামলায় যাদের আসামি করা হয়েছে, তার বেশির ভাগই ওই কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য। নিহত এনজিওকর্মী মামুন অর রশিদের বাবা আবদুল আজিজ বলেন, ‘সজল ও মামুনকে যারা নৃশংসভাবে খুন করলো, তারা সবাই সবার পরিচিত। শুধু দলাদলির কারণে ছেলে দুটোর প্রাণ গেলো।’
চুয়াডাঙ্গা সদর থানার ওসি মাহাব্বুর রহমান জানান, জোড়া খুনের ঘটনায় ১৫ জনের নাম উল্লেখসহ ১০ থেকে ১৫জন অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তিকে আসামি করে একটি হত্যা মামলা করা হয়েছে। এজাহারভুক্ত আসামিদের মধ্যে পুলিশ দুজনকে এবং র্যাব একজনকে গ্রেফতার করেছে। বাকিদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে। এক প্রশ্নের জবাবে ওসি বলেন, বাজারকেন্দ্রিক আধিপত্যের বিষয়টি তার জানা নেই। তবে সজল ও মামুন খুনের মূলে কাপড়ের দোকানে ছামেনা খাতুনের অপমানের বিষয়টিই এখন পর্যন্ত নিশ্চিত হওয়া গেছে।
পুলিশ ও স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ২৫ এপ্রিল বেলা দুটোর দিকে ভালাইপুর গ্রামের ছামেনা খাতুন ভালাইপুর বাজারের আশরাফুল বস্ত্রালয়ে কাপড় কিনতে আসেন। এ সময় দোকানের কর্মচারী রিয়নের সঙ্গে দরদাম নিয়ে তার তর্কবিতর্ক হয়। ছামেনার সঙ্গে রিয়ন খারাপ ব্যবহার করেন এবং দোকান থেকে বের করে দেন। বিষয়টি তিনি বাড়িতে গিয়ে ছেলে টিপু সুলতানকে জানান।
টিপু সুলতান তার বন্ধু সজল, পলাশ, রাসেল, জুয়েল, আনিছুর, লিখন, হালিম ও মামুনকে নিয়ে ভালাইপুরের ওই কাপড়ের দোকানে আসামির সঙ্গে কথা বলতে আসেন। দোকান কর্মচারী রিয়ন সেখানে না থাকায় রাত আনুমানিক আটটার দিকে সবাই তার (মো. রিয়ন) বাড়িতে যান। মামলার বাদী স্বপন আলী এজাহারে উল্লেখ করেছেন, রিয়ন দুপুরের ঘটনার জন্য অনুশোচনা প্রকাশ করলে তাকে মোটরসাইকেলে উঠিয়ে টিপু সুলতানের মায়ের কাছে ক্ষমা চাওয়ার জন্য ভালাইপুরের দিকে রওনা দেন। ভালাইপুর বাজারের জিনারুল স্টোরের সামনে পৌঁছুলে আসামিরা পূর্বপরিকল্পিতভাবে দেশীয় অস্ত্র নিয়ে প্রতিরোধ করে। এরপর ছানোয়ার ও সোহেল রানার হুকুমে আসামিরা অতর্কিত হামলা চালান। ধারালো অস্ত্রের এলোপাতাড়ি কোপে সজলের পেট ও মামুনের বুক ক্ষতবিক্ষত হয়ে যায়।
ঘটনার বিষয়ে ছামেনা খাতুন বলেন, কাপড়ের দোকানের ঘটনাটি তার ছেলে টিপু সুলতান সন্ধ্যায় মীমাংসা করে আসেন। রাতে যদি দল বেঁধে দোকানের কর্মচারীকে হুচুকপাড়া থেকে তুলে আনতে না যেতেন, তাহলে এভাবে খুনখারাবি হতো না।