সারা বিশ্ব তাকিয়ে আছে বাংলাদেশে সুষ্ঠু নির্বাচন দেখতে

বৈঠক পররাষ্ট্রুমন্ত্রী মোমেনকে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ব্লিঙ্কেন : বাইডেনকে লেখা প্রধানমন্ত্রীর চিঠি হস্তান্তর

স্টাফ রিপোর্টার: মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্থনি ব্লিঙ্কেন নিজের দফতরে সোমবার বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আবদুল মোমেনের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। অত্যন্ত হৃদ্যতাপূর্ণ পরিবেশে দ্বিপক্ষীয় ওই বৈঠক হয়। পরে ড. মোমেন ও তার সফরসঙ্গীদের পাশে নিয়ে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ব্লিঙ্কেন সাংবাদিকদের বলেন, গত ৫০ বছরে বাংলাদেশ এবং যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যকার সম্পর্ক ব্যাপক বৃদ্ধি পেয়েছে। দুই দেশের মানুষের সম্প্রীতির বন্ধন, জলবায়ু, স্বাস্থ্যসেবাসহ সাম্প্রতিক সময়ে যেসব কাজ হয়েছে তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ১০ লাখের বেশি রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দেয়ায় আমরা বাংলাদেশের প্রশংসা করছি অসাধারণ উদারতার জন্য। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, সারা বিশ্ব তাকিয়ে আছে বাংলাদেশে সুষ্ঠু নির্বাচন দেখতে। ব্লিঙ্কেনের বক্তব্যকে স্বাগত জানিয়ে ড. মোমেন বলেন, বাংলাদেশের প্রতিটি বাঙালির ধমনিতেই গণতান্ত্রিক চেতনা প্রবাহিত। গণতন্ত্রের জন্য ৩০ লাখ বাঙালি রক্ত দিয়েছে। ড. মোমেন বলেন, একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের গুরুত্বের ব্যাপারে আমরাও একমত। সর্বশেষ নির্বাচনে আমরা ২৫ হাজার পরিদর্শককে স্বাগত জানিয়েছিলাম। সামনের নির্বাচনেও একই ব্যবস্থা থাকবে। বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশন অত্যন্ত শক্তিশালী এবং একান্তভাবেই স্বাধীন। নির্বাচনের সময় তারাই সবকিছুর দায়িত্ব পালন করেন।

ব্লিঙ্কেনের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন (ডিএসএ) নিয়ে আলোচনাকালে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুল মোমেন ব্লিঙ্কেনকে বলেছেন, ডিএসএ করেছি, কিন্তু গণমাধ্যমের স্বাধীনতা খর্ব করার জন্য তা করিনি। আওয়ামী লীগ গণমাধ্যমের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে। আমাদের দেশে ১২৫১টা দৈনিক পত্রিকা প্রকাশিত হয়। ৪৩টি প্রাইভেট টিভি নেটওয়ার্ক আছে। তারা হাইপার অ্যাকটিভ। আমরা কোনো কিছু খর্ব করি না। বৈঠক শেষে সেখানকার একটি হোটেলে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে এসব কথা বলেন মোমেন।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানান, বাংলাদেশে বিরোধী দল চাইলে যখন-তখন বিক্ষোভ করতে পারে বলে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে জানানো হয়েছে। তিনি বলেন, ‘আমি বলেছি, একমাত্র সরকারি এবং বেসরকারি সম্পত্তি কেউ ধ্বংস করলে আমরা তাকে শাস্তি দিই। সরকারের এ বিষয়ে বাধ্যবাধকতা রয়েছে। মত প্রকাশের স্বাধীনতার নামে কেউ জনজীবন বিঘিœত করতে পারে না।’

মানবাধিকার বিষয়ে আলোচনার প্রসঙ্গে ডক্টর মোমেন বলেন, ‘তারা (যুক্তরাষ্ট্র) বলেছে কয়েকজন লোকের বিষয়ে ন্যায়বিচার করার জন্য। তখন বলেছি, আমরা অবশ্যই ন্যায়বিচার করব। কারণ আমরা আইনের শাসন ও সুশাসন চাই।’ বৈঠকে অন্যান্য আলোচনার বিষয়ে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘বৈঠকে বাংলাদেশের শ্রম অধিকার পরিস্থিতি নিয়ে আলাপ হয়েছে। ধর্মীয় স্বাধীনতা সুরক্ষা, ব্যবসা-বাণিজ্য এবং অর্থনৈতিক সহযোগিতা বৃদ্ধি, রোহিঙ্গা সমস্যার টেকসই সমাধান, যুক্তরাষ্ট্রে পালিয়ে থাকা বঙ্গবন্ধুর খুনি রাশেদ চৌধুরীকে বাংলাদেশের কাছে ফেরত দেয়াসহ দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতার নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে।’ বৈঠকে ব্লিঙ্কেনের সঙ্গে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ প্রসঙ্গ এনেছেন জানিয়ে মোমেন বলেন, ‘আমরা বলেছি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে মানুষ কষ্টে আছে। আপনারা যুদ্ধ বন্ধ করেন, আপনাদের ক্ষমতা আছে; লাগলে আমাদেরও সাহায্য নিতে পারেন।’ তিনি জানান, অ্যান্থনি ব্লিঙ্কেন বলেছেন, বাংলাদেশের নাগরিকদের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের মধ্যকার বন্ধনের ওপর ভর করে যুক্তরাষ্ট্র সামনের দিনগুলোতেও বাংলাদেশের পাশে থাকবে। বাংলাদেশের সামগ্রিক উন্নয়নে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা অব্যাহত থাকবে।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানান, স্বাধীনতা দিবসের শুভেচ্ছায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে পাঠানো চিঠিতে বাংলাদেশের অগ্রগতি ও উন্নতি কামনা করে ‘জয় বাংলা’ বলে অভিবাদন জানানোয় মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে ধন্যবাদ জানান। মার্কিন প্রেসিডেন্টের চিঠির জবাব দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বৈঠকে বাইডেনকে লেখা প্রধানমন্ত্রীর সেই চিঠি হস্তান্তর করেছেন তিনি। পাশাপাশি আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে অবাধ ও নিরপেক্ষ করতে সম্পূর্ণ স্বাধীন একটি নির্বাচন কমিশন গঠন করা হয়েছে বলে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্থনি ব্লিঙ্কেনকে নিশ্চিত করেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী।

এদিকে ওই বৈঠকের পর জামায়াত-শিবিরের লোকজন চুপসে গেছেন। যারা এতদিন গুজব ছড়িয়েছিলেন যে, বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে যুক্তরাষ্ট্র তলব করেছে তারাও চরম হতাশায় নিপতিত হন। নিউইয়র্ক সিটির ব্রুকলিন, জ্যাকসন হাইটস, ক্যালিফোর্নিয়ার লস অ্যাঞ্জেলেস, মিশিগানের ডেট্রয়েট, ওয়াশিংটন মেট্রো এলাকার বিভিন্ন স্থানে মহল বিশেষের আনন্দ-উল্লাসের প্রস্তুতি ছিল। এ জন্য সংশ্লিষ্ট মহলের উচ্চ পর্যায়ের লোকজনও অপেক্ষায় ছিলেন। কিন্তু সবাই চুপসে গেছেন বলে জানা যায়।

এর বিপরীতে রাজনীতি সচেতন প্রবাসীরা বঙ্গবন্ধুর কূটনৈতিক নীতি ‘কারও সঙ্গে বৈরিতা নয়-সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব’ অটুট রাখতে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মোমেনের কূটনৈতিক তৎপরতার প্রশংসা করেছেন। দুই পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সংক্ষিপ্ত ব্রিফিংয়ের খবর ছড়িয়ে পড়ার পরই মহলবিশেষের মধ্যে হতাশার ভাব দেখা যায়। তারা গত কয়েক দিন থেকেই বলাবলি করছিলেন, ওই বৈঠকের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে আরেক দফা নিষেধাজ্ঞা জারি হতে পারে এবং নির্বাচন অনুষ্ঠানে কেয়ারটেকার সরকারের রূপরেখাও জানিয়ে দেয়া হবে। ব্রিফিংয়ের আগে দুই দেশের এই দুই শীর্ষ কূটনীতিকের সঙ্গে থাকা কর্মকর্তাদের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় ও বহুপাক্ষিক ইস্যুতে কথা হয়েছে। সেখানে থাকা কূটনীতিকরা আভাস দিয়েছেন, বাংলাদেশের এগিয়ে চলা, মানবাধিকার ও শ্রমিক অধিকার নিশ্চিতে নানা পদক্ষেপ গ্রহণকে সাধুবাদ জানিয়েছেন ব্লিঙ্কেন। সে সময় ড. মোমেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি আবারও অনুরোধ জানিয়েছেন বাংলাদেশের উন্নয়ন-অভিযাত্রায় অর্থনৈতিক সহযোগিতার দিগন্ত আরও প্রসারের জন্য। মোমেন ব্লিঙ্কেনকে আরও জানিয়েছেন, র‌্যাবের কর্মকা-ে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার পাশাপাশি ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তায় সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে বাংলাদেশ সরকার। ধর্মীয় সম্প্রীতির ঐতিহাসিক প্রক্রিয়া জাগ্রত রাখতেও বদ্ধপরিকর বাংলাদেশ।

যুক্তরাষ্ট্র সফরে যাওয়ার আগে ৫ এপ্রিল সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেন জানান, আমেরিকা আমাদের বন্ধু রাষ্ট্র। উন্নয়নের মহাসড়কে যাত্রার সময়ে আমেরিকা যথেষ্ট গুরুত্ব দিচ্ছে বাংলাদেশকে। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমাকে দাওয়াত দিয়েছেন। আমরা খুব ভাগ্যবান, কারণ পরপর তিনবার তার দাওয়াত পেলাম। নির্বাচন প্রসঙ্গে ব্লিঙ্কেনের সঙ্গে আলাপ নিয়ে ডক্টর মোমেন বলেন, ‘আমরা চাই স্বচ্ছ ও সুষ্ঠু নির্বাচন। আমেরিকাও চায় স্বচ্ছ ও সুষ্ঠু নির্বাচন। এ নিয়ে আমাদের মধ্যে কোনো দ্বিমত নেই।’ সোমবারের বৈঠকে একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকারের গৃহীত পদক্ষেপগুলো তুলে ধরা হয়েছে বলে জানান পররাষ্ট্রমন্ত্রী। বাংলাদেশের পক্ষে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ ইমরানসহ দূতাবাসের অন্য কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

কূটনৈতিক সূত্র জানিয়েছে, সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহের কারণে কূটনৈতিক অঙ্গনে আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল মোমেন-ব্লিঙ্কেনের এ বৈঠক। বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ইতিবাচক সম্পর্কের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে চায়। ডক্টর একে আবদুল মোমেন যুক্তরাষ্ট্রের সামনে সেই অবস্থান তুলে ধরেছেন।

এছাড়া, আরও পড়ুনঃ

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More