গাংনীতে গমের মাঠ পরিদর্শনে দেশী-বিদেশী বিজ্ঞানী দল
গমের ব্লাস্ট প্রতিরোধে বাংলাদেশর ভূমিকা খুবই ইতিবাচক
গাংনী প্রতিনিধি: গমের ব্লাস্ট প্রতিরোধে বাংলাদেশের বিজ্ঞানী, কৃষক ও কৃষি বিভাগের ভূমিকার ভূয়সী প্রশংসা করলেন বিশে^র বিভিন্ন দেশের বিজ্ঞানীরা। গত শুক্রবার দুপুরে গাংনীর শিশিরপাড়া মাঠে বারি গম-৩৩ এবং বিডাব্লিউএমআরআই গম-৩ ক্ষেত পরিদর্শন করেন আন্তর্জাতিক পর্যায়ে গম গবেষণায় কর্মরত এসকল বিজ্ঞানীরা।
সাংবাদিকের সাথে সাক্ষাতে তারা বলেন, ২০১৬ সালে বাংলাদেশ প্রথম ব্লাস্ট দেখা দেয় মেহেরপুর জেলার গমক্ষেতে। যা গম আবাদ অনিশ্চতার মধ্যে ফেলে দেয়। কিন্তু স্বল্প সময়ের মধ্যে ২০১৭ সালে এদেশের গম বিজ্ঞানীরা ব্লাস্ট প্রতিরোধী গমের জাত বারি গম-৩৩ এবং পরবর্তীতে বিডাব্লিউএমআরই গম-৩ জাত রিলিজ করেন। যা কোনো স্বাভাবিক বিষয় ছিলো না। বারি গম-৩৩ আবাদ সম্প্রসারণের মাধ্যমে এ অঞ্চল থেকে ব্লাস্ট প্রায় মুক্ত হতে চলেছে। যা বিশে^ গমের ইতিহাসে একটি মাইলফলক হয়ে থাকবে।
বাংলাদেশের বিজ্ঞানী, কৃষি বিভাগ, কৃষক ও বীজ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের প্রশংসা করে বিজ্ঞানীরা আরও বলেন, গমের ব্লাস্ট প্রতিরোধে বাংলাদেশ বিশ্ব দরবারে একটি নজির সৃষ্টি করেছে। ব্লাস্ট প্রতিরোধী জাত দুটি শুধু ব্লাস্টই প্রতিরোধ করেনি পাশাপাশি পুরনো জাতের চেয়ে ফলনও বেশি দিচ্ছে। এতে চাষিরা বেশি লাভবান হচ্ছেন এবং গম উৎপাদনে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ।
জানা গেছে, বাংলাদেশ গম ও ভুট্টা গবেষণা ইন্সটিটিউট (বিডব্লিউএমআরআই)’র আঞ্চলিক কেন্দ্র যশোরে গমের ব্লাস্ট রোগ ব্যবস্থাপনা বিষয়ে একটি আন্তর্জাতিক প্রশিক্ষণ কোর্স চলমান। এ কোর্সে ভারত, নেপাল, চীন, জাপান, ইথিওপিয়া, জাম্বিয়া, ব্রাজিল, মেক্সিকো, সুইডেন ও বাংলাদেশের মোট ৩০জন বিজ্ঞানী অংশগ্রহণ করছেন। প্রশিক্ষণের অংশ হিসেবে ব্লাস্ট প্রতিরোধী গমের জাতগুলো ব্লাস্ট আক্রান্ত জেলা মেহেরপুরে কতটুকু সফল তা পর্ববেক্ষণের লক্ষ্যে শুক্রবার (৩ মার্চ) মেহেরপুর জেলার বিভিন্ন এলাকার গমক্ষেত পরিদর্শন করেন প্রশিক্ষণার্থী বিজ্ঞানীরা।
পরিদর্শন দলের নেতৃত্বে থাকা বাংলাদেশ গম ও ভুট্টা গবেষণা ইন্সটিটিউটের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মোহাম্মদ রেজাউল কবীর জানান, এই পরিদর্শনের উদ্দেশ্য হলো মাঠ পর্যায়ে গমের ব্লাস্ট রোগ ব্যবস্থাপনা ও ব্লাস্ট প্রতিরোধী জাতের কার্যকারীতা স্বচক্ষে দেখা ও লব্ধজ্ঞান নিজ দেশে প্রয়োগ করা। প্রশিক্ষণ দলের সাথে আরও উপস্থিত ছিলেন গাংনী উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা আব্দুর রউফ, সিমিট বাংলাদেশের কৃষি উন্নয়ন কর্মকর্তা হারুন-অর-রশিদ, উপ-সহকারী কৃষি অফিসার রবিউল ইসলাম ও স্বদেশ সিড পরিচালক মাজেদুল হক মানিকসহ এলাকার গমচাষিবৃন্দ।
কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা আব্দুর রউফ বলেন, কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে ব্লাস্ট প্রতিরোধী জাত আবাদ করার জন্য চাষিদের পরামর্শ দেয়া চলামান রয়েছে। একই সাথে ব্লাস্ট প্রতিরোধী জাতের প্রদর্শনী, বীজ সংরক্ষণ ও চাষিদের সরকারি নানা সহযোগিতা দেয়া হচ্ছে। যাতে এ অঞ্চল থেকে ব্লাস্ট দূর করা যায়।
সিমিট মেক্সিকোর প্রধান রোগতত্ত্ববীদ ড. পবন সিং বলেন, হুইট ব্লাস্ট প্রতিরোধে বাংলাদেশি বিজ্ঞানীদের উদ্ভাবন বারি গম-৩৩ এ অঞ্চলে গম আবাদের নিশ্চয়তা এনে দিয়েছে। আমরা সকলে একসাথে কাজ করছি যাতে সারাবিশে^র চাষিরা নির্বিঘেœ গম আবাদ করতে পারেন।
জাপানি প্রফেসর ড. সইচিরো আসুকে বলেন, প্রতিরোধী জাত আষ্কিার করার জন্য নতুন নতুন জিনের উপস্থিতি সনাক্ত করতে হবে। আমরা সিমিট ও বিডাব্লিউএমআরআই’র সহযোগিতায় নতুন জিন শনাক্ত করার জন্য গবেষণা করে যাচ্ছি।
সিমিট গবেষক ড. ডেব হডসন বলেন, এটা সত্যিই প্রশংসার দাবিদার যে, ২০১৬ সালে ব্লাস্ট রোগ দেখা যাওয়ার পর বাংলাদেশ এ রোগ মোকাবেলায় সফল হয়েছে। প্রতিরোধী জাতের বীজ উৎপাদনে স্থানীয় বীজ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান এগিয়ে এসেছে যা খুবই ইতিবাচক।
সুইডিস কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ড. আকাশ চৌদে বলেন, সুইডেনে কোনো ব্লাস্ট রোগ নেই। তবে রোগ প্রতিরোধে তাদের গবেষণার ফলাফল বাংলাদেশ ব্যবহার করে উপকৃত হতে পারে এবং তারা সহযোগিতা করার জন্য কাজ করছেন।
চীনের বিজ্ঞানী ড. খাংহুও শিয়াং এবং ব্রাজিলের বিজ্ঞানী ড. মরিসিও বলেন, এই প্রশিক্ষণে বিভিন্ন দেশের সরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠানে কর্মরত বিজ্ঞানীগণ অংশগ্রহণ করছেন। প্রশিক্ষণলব্ধ জ্ঞান নিজ নিজ দেশে কাজে লাগিয়ে ব্লাস্ট রোগের হাত থেকে গম ফসলকে রক্ষা করাই হলো প্রশিক্ষণের মূল উদ্দেশ্য। বাংলাদেশে প্রশিক্ষণে আসতে পেরে প্রশিক্ষণার্থীরা খুবই উচ্ছ্বসিত।
পরিদর্শন দলের প্রধান বিডাব্লিউএমআরআই ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. রেজাউল কবীর বলেন, ২০১৬ সালে প্রথম ব্লাস্ট রোগ দেখা দেয়ার পর থেকে বাংলাদেশ গম ও ভুট্টা গবেষণা ইনস্টিটিউট বিভিন্ন দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থার সহযোগিতায় গবেষণা করে যাচ্ছে। এ পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটি বারি গম-৩৩ ও বিডাব্লিউএমআরআই গম-৩ নামে দুটি ব্লাস্ট প্রতিরোধী জাত উদ্ভাবন করেছে। ব্লাস্ট প্রতিরোধী জাত কৃষক মাঠে সম্প্রসারণের ফলে যশোর অঞ্চলে তথা সারাদেশে গমের আবাদ বৃদ্ধি পেয়েছে। মেহেরপুর জেলায় যেখানে প্রথম ব্লাস্ট রোগ দেখা দিয়েছিলো সেখানে গত বছরের তুলনায় এবার ৩ হাজার হেক্টর বেশী জমিতে গম আবাদ হয়েছে।