স্টাফ রিপোর্টার: আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে নির্বাচনে বিএনপি যাবে না বলে আবারো দলের অবস্থান স্পষ্ট করেছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। আগামী নির্বাচন নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে গতকাল শুক্রবার বিকেলে রাজধানীর গোপীবাগে ‘নীরব পদযাত্রা’ পূর্ব সংক্ষিপ্ত সমাবেশে তিনি এ বিষয়ে কথা বলেন।
মির্জা ফখরুল বলেন, বিদেশিদের কাছে প্রধানমন্ত্রী বলছেন, আওয়ামী লীগের অধীনে খুব ভালো নির্বাচন হবে, সবাই অবাধে ভোট দিতে পারবে। ঘোড়াও হাসতে শুরু করেছে এই কথা শুনে। আমরা স্পষ্টভাষায় আজকে বলতে চাই, সেই নির্বাচনে বিএনপি, বাংলাদেশের মানুষ যাবে না। বাংলাদেশের মানুষ কোনো দিনই সেই নির্বাচন মেনে নেবে না। আমাদের মরহুম নেতা শফিউল আলম প্রধানের কথায় বলতে হয় কুত্তা মার্কা নির্বাচনে বিএনপি আর যাবে না, দেশের মানুষ যাবে না।
মির্জা ফখরুল বলেন, আমাদের সোজা কথা। অনেক ক্ষতি করেছেন আমাদের। এ দেশের যে স্বপ্ন ছিল, যে আকাক্সক্ষা ছিল সব কিছুকে ভেঙে ধূলিসাৎ করে দিয়েছেন। বিদেশে টাকা পাচার করে দিয়ে বাংলাদেশকে শেষ করে ফেলেছেন। আমরা আমাদের হিস্যা চাই। তিনি বলেন, উন্নয়ন উন্নয়ন বলছেন। উন্নয়ন কোথায়? উন্নয়ন হয়েছে আপনাদের। সাধারণ মানুষের কোনো উন্নয়ন হয়নি। সাধারণ মানুষের দিকে তাকিয়ে দেখুন কি অবস্থা তাদের।
মির্জা ফখরুল বলেন, আজকে আমাদের একটাই কথা। দুই কথা, তিন কথা, চার কথা বলে সময় নষ্ট করার দরকার নাই। এই মুহূর্তে চাই পদত্যাগ, এই মুহূর্তে চাই পদত্যাগ। পদত্যাগ করুন, দেশের মানুষকে বাঁচতে দিন। অন্যথায় দেশের মানুষই তার ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
দেয়ালের লিখন পড়–ন: মির্জা ফখরুল বলেন, কয়েক দিন আগে ওরা বলত বিএনপি আন্দোলন করতে পারে না। এখন আন্দোলনকে ভয় পেয়ে তারা আন্দোলনকে পাহারা দেয়। পাহারা দিয়ে আন্দোলন ঠেকানো যায়? ঠেকানো যাবে না। তখন পালাবার পথ খুঁজে পাবে না ওরা। এখনো বলছি সময় আছে, দেয়ালের লিখন পড়–ন, মানুষের ভাষা বুঝুন, গ্রামের যান দেখুন। ইউনিয়ন পর্যায়ে বিএনপির নেতৃত্বে কিভাবে হাজার হাজার মানুষ পদযাত্রা করেছে। আজকে সত্যিকার অর্থেই এই সরকারের পদত্যাগের দাবি সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। এখনো সময় আছে পদত্যাগ করুন, পদত্যাগ করে সংসদ বিলুপ্ত করুন এবং নতুন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে ক্ষমতা দিয়ে নতুন নির্বাচনের ব্যবস্থা করুন। অন্যথায় তখন জনগণ আপনাদেরকে সেই সুযোগ দেবে না।
দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে কারাবন্দী করে এবং ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে বিদেশে নির্বাসিত করে রেখে বিএনপির আন্দোলন বন্ধ করতে পারেনি বলেও মন্তব্য করেন দলটির মহাসচিব।
সরকারের পদত্যাগসহ ১০ দফা এবং বিদ্যুৎ-গ্যাস-দ্রব্যমূল্য কমানোর দাবিতে যুগপৎ আন্দোলনের অংশ হিসেবে শুক্রবার মহানগর বিএনপি রাজধানীতে দুইটি পদযাত্রা হয়।
মহানগর দক্ষিণের উদ্যোগে গোপীবাগ ওয়াক্তিয়া মসজিদের সামনে সমাবেশ করে বিকেল ৪টায় পদযাত্রা শুরু করে। বিশাল পদযাত্রাটি মধুমিতা সিনেমা হল, টিকাটুলী, দয়াগঞ্জ, ধোলাইখাল মোড়, রায়সা বাজার মোড় হয়ে নয়াবাজারে নবাব ইউসুফ মার্কেট পর্যন্ত পাঁচ কিলোমিটার পথ পেরিয়ে শেষ করে।
মহানগর উত্তরের উদ্যোগে উত্তরার কবি জসিম উদ্দিন সড়ক থেকে আবদুল্লাহপুর পর্যন্ত আড়াই কিলোমিটার পদযাত্রা হয়। এই পদযাত্রায় দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন নেতৃত্ব দেন।
যুগপৎ আন্দোলনের অংশ হিসেবে একই সময়ে লিবারেল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি-এলডিপি কাওরান বাজার থেকে এবং গণফোরাম-পিপলস পার্টি মতিঝিলের ইডেন কমপ্লেক্সের সামনে থেকে পদযাত্রা করে।
এছাড়া সকালে সমমনা জাতীয়তাবাদী জোট বিজয় নগরে আলরাজি কমপ্লেক্সের সামনে থেকে এবং পেশাজীবী গণতান্ত্রিক জোট পুরানা পল্টন থেকে জাতীয় প্রেসক্লাব পর্যন্ত পদযাত্রা করে।
রাষ্ট্রপতি নির্বাচন প্রসঙ্গে: মির্জা ফখরুল বলেন, এই যে রাষ্ট্রপতি বলে একজন নির্বাচন করছে। আমরা কিছু জানি? কেউ কিছু জানে? উনি (নবনির্বাচিত রাষ্ট্রপতি) নিজেও জানতেন না। টেলিভিশনে সাক্ষাৎকার দিয়ে উনি বলেছেন, আমি নিজেও জানতাম না। এই রাষ্ট্রপতির নির্বাচনই প্রমাণ করে যে, সংবিধান যেটা আছে এই সংবিধান দিয়ে এ দেশের সমস্যার এখন সমাধান হবে না। এ জন্য এই সংবিধান সংশোধন করতে হবে। অবশ্যই আমরা যে ২৭ দফা দিয়েছে সেই ২৭ দফার মধ্যে আমরা এই সংবিধান সংশোধনের কথা বলেছি। আমরা বলেছি, রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা, প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা, মন্ত্রীদের ক্ষমতা-এগুলোর ভারসাম্য আনতে হবে এবং সব মানুষের অংশ থাকে সে ধরনের নির্বাচন ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য একটা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ব্যবস্থাকে কিভাবে স্থায়ী করা যায় তার চিন্তা করতে হবে।
ওরা পুলিশকে ব্যবহার করছে: মির্জা ফখরুল বলেন, ওরা পুলিশকে ব্যবহার করছে। আইন ও সালিস কেন্দ্র একটা পরিসংখ্যানে বলেছে, গত ১৩ মাসে ৭২ জনকে বিনাবিচারে এক্সট্রা জুডিশিয়াল কিলিং করা হয়েছে, হত্যা করা হয়েছে। অন্যায়ভাবে রাজনৈতিক কর্মকা-ে বাধা দেয়া হচ্ছে। গত বছর আগস্ট মাস থেকে আমরা যে আন্দোলন শুরু করেছি তাতে প্রায় ১০ নেতাকে রাজপথে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। আমাদের নেতাকর্মীদেরকে সম্পূর্ণ বেআইনিভাবে গ্রেফতার করা হচ্ছে। এই ঢাকা শহরে এমন একটা বিএনপির নেতাকর্মীর বাড়ি নাই যেখানে পুলিশ হানা দেয়নি, তল্লাশি বা রেইট করেনি, ধরে নিয়ে চলে যায়নি। আমরা সবাই জেলে গেছি। জেলে যাচ্ছি, আসছি। এখন আমাদের অনেক নেতাকর্মী জেলে আছে। সেই জেলে নিয়ে কিন্তু বিএনপিকে আটকিয়ে রাখতে পারছে না।
তিনি বলেন, বিএনপি ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য এই আন্দোলন করছে না। বিএনপি লড়াই করছে জনগণের মুক্তির জন্য, এই দেশকে বাঁচানোর জন্য, এই দেশকে সত্যিকার অর্থে একটা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিণত করার জন্য। আজকে আওয়ামী লীগের ব্যর্থতায় এ দেশটা একটা অকার্যকর রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। কোথাও কোনো সফলতা নেই। আজকে দেখুন গণতান্ত্রিক সম্মেলন হচ্ছে আমেরিকাতে। সেখানে বাংলাদেশকে দাওয়াত করে নাই, গতবারও করে নাই। এটা আমাদের জন্য আনন্দের কথা নয়।
দেশে নৈরাজ্য চলছে: বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের দৌরাত্ম্যের চিত্র তুলে ধরে বিএনপি মহাসচিব বলেন, কয়েক দিন আগে নিশ্চয় দেখেছেন, বরিশালে একজনের দোকান দখল করে নিয়েছে। প্রায় ৭০টা দোকান এখন লিখে দিতে হচ্ছে যে, দোকানের ভাড়া ওই আওয়ামী লীগারকে দিতে হবে। দোকানের মালিক নিতে পারবে না। এই একটা নৈরাজ্য চলছে। যেভাবে খুশি দেশটাকে তারা চালানোর চেষ্টা করছে। আওয়ামী লীগ মূলত একটা সন্ত্রাসী দল। আওয়ামী লীগ কোনো দিন জনগণের ভোট নিয়ে নির্বাচিত হয়ে আসে নাই। আওয়ামী লীগ সব সময়ই জনগণকে ভয় দেখিয়ে, ত্রাস সৃষ্টি করে একটা ত্রাসের রাজত্ব করে ক্ষমতায় যাওয়ার চেষ্টা করেছে। আজকে আবারো সেইভাবে ত্রাস সৃষ্টি করে মানুষকে ভয় দেখাচ্ছে।
দেশে গণলুট চলছে: মির্জা ফখরুল বলেন, আজকে এমন চুরি করেছেন যে, এখন ব্যাংকে টাকা নাই। ডলার নাই। এলসি খুলতে পারে না, জিনিসপত্র আনতে পারে না। চুরির একটা সীমা আছে এরা সব সীমা ছাড়িয়ে গেছে। পত্রিকায় বেরিয়েছে ফরিদপুরের ওদের পাচারের ঘটনা। সেখানে দেখা যাচ্ছে একজন না আরো অনেকে আছে জড়িত, তাদের আত্মীয়স্বজন বন্ধু-বান্ধব সবাই। এ গণলুট চলছে। এ অবস্থার সমাপ্তি ঘটাতে জনগণের সাথে নিয়ে রাজপথে আন্দোলনের মধ্যদিয়ে এই সরকারের পতন ঘটানো হবে বলে হুঁশিয়ারি দেন মির্জা ফখরুল।
স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস বলেন, আজকে বিদ্যুতের কি অবস্থা। ঘরে মা-বোনেরা ভালো জানেন। আমি প্রতিবেশি দেশ সম্পর্কে কোনো কথা বলতে চাই না। কিন্তু প্রতিবেশী দেশে কিছু লুটেরার সাথে আঁতাত করে একটা সরকার কিভাবে একটা দেশকে লুট করতে পারে তার একটা প্রমাণ ওই আদানি না কি প্যাদানি একটা আছে। শুনছেন না ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হবে তাকে। এক লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা ২৫ বছরে। বিদ্যুৎ দিক বা না দিক। আরে ভাই শ্বশুর বাড়ি আরকি। যেমনি খুশি তেমনি নিইয়া যাইব। কার সাথে এই চুক্তি করেছে? ভারতীয় সরকারের সাথে নয়, একজন সাধারণ বাটপারের সাথে এই কাজটা করল।
তিনি বলেন, এই সরকার থাকা অবস্থায় মানুষের মুখে হাসি ফুটবে না, এ দেশে মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে হলে চাই দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে, চাই আমার নেতা তারেক রহমানকে, চাই বিএনপিকে।
মহানগর দক্ষিণের আহ্বায়ক সভাপতি আবদুস সালাম ও সদস্যসচিব রফিকুল আলম মজনুর পরিচালনায় গোপীবাগে পদযাত্রাপূর্ব সংক্ষিপ্ত সমাবেশে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল নোমান, বিএনপির মহানগরের সদস্য ইশরাক হোসেন বক্তব্য রাখেন।
এই পদযাত্রায় বিএনপির খায়রুল কবির খোকন, শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস, ফজলুল হক মিলন, মীর নেওয়াজ আলী, সেলিম রেজা হাবিব, কাজী হাবিবুল বাশার, ইউনুস মৃধা, আবদুস সাত্তার, মো: মোহন, হাবিবুর রশীদ হাবিব, তানভীর আহমেদ রবিন, মুক্তিযোদ্ধা দলের ইশতিয়াক আজিজ উলফাত, সাদেক আহমেদ খান, যুবদলের মুনায়েম মুন্না, ইসহাক সরকার, স্বেচ্ছাসেবক দলের এস এম জিলানি, মহিলা দলের হেলেন জেরিন খান, শ্রমিক দলের মোস্তাফিজুল করীম মজুমদার, জাসাসের জাকির হোসেন রোকনসহ অঙ্গসংগঠনের নেতারা উপস্থিত ছিলেন। বেলা আড়াইটায় উত্তরায় কবি জসিম উদ্দিন সড়কের মোড় থেকে পদযাত্রাপূর্ব সংক্ষিপ্ত সমাবেশ হয়। মহানগর উত্তরের আহ্বায়ক আমান উল্লাহ আমান ও সদস্যসচিব আমিনুল হকের সঞ্চালনায় সমাবেশে দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন, আবদুল মঈন খান, ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বক্তব্য রাখেন।
দুইটি ‘নীরব’ পদযাত্রায় বিভিন্ন ওয়ার্ড থেকে মহানগর বিএনপি, যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল, মহিলা দল, মুক্তিযোদ্ধা দল, কৃষক দল, তাঁতী দল, মৎস্যজীবী দল, ছাত্রদল, জাসাসের হাজার হাজার নেতাকর্মী অংশ নেয়।
সরকারের পদত্যাগ, সংসদ বিলুপ্ত, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনসহ ১০ দফার সাথে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য, বিদ্যুৎ-গ্যাসের দাম কমানোর দাবিতে বিএনপিসহ সমমনা দলগুলো গত ডিসেম্বর থেকে যুগপৎভাবে অভিন্ন কর্মসূচি নিয়ে রাজপথে আন্দোলন শুরু করে। গত দেড় মাসে তারা দেশব্যাপী গণমিছিল, অবস্থান কর্মসূচি, বিক্ষোভ সমাবেশ ও বিভাগীয় সমাবেশ, ইউনিয়ন পর্যায়ে পদযাত্রার কর্মসূচি করেছে।