ঝিনাইদহের মহেশপুরে গুলি করে এক বাংলাদেশি যুবককে হত্যা করেছে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ। গত বুধবার ভোরে মহেশপুর উপজেলার শ্যামকুড় এলাকায় ঘটনাটি ঘটেছে। গুলি ছোড়ার কারণ গরু চোরাচালান বা পারাপার। চার-পাঁচজন যুবক গরু নিয়ে আসছিলেন। বিএসএফ তাদের লক্ষ্য করে গুলি ছুড়লে হত্যাকা-টি ঘটে। অন্য দিকে তার লাশ বেলা ২টা পর্যন্ত উন্মুক্ত মাঠে পড়েছিলো। সীমান্তে আন্তর্জাতিক আইন রয়েছে। দুনিয়ার সব সীমান্তে কমবেশি একই ধরনের আইন বলবৎ আছে। তবে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে বাস্তবতা ভিন্ন। সীমান্তে অব্যাহত লাশ পড়া থেকে তা সহজে অনুমেয়। তা-ও একতরফা বাংলাদেশির লাশ পড়ছে। গত বছরের ডিসেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে লালমনিরহাট সীমান্তে বিএসএফ গুলি চালিয়ে আরও দু’জন বাংলাদেশিকে হত্যা ও একজনকে আহত করে। ঝিনাইদহের মতো ওই ঘটনার হুবহু একই বিবরণ পাওয়া যাচ্ছে। গরু পারাপার করতে বাংলাদেশিদের একটি দল সীমান্তে পারাপার করছিলো, তাদের লক্ষ্য করে বিএসএফ গুলি চালায়।
ভারত সীমান্তে বাংলাদেশি হত্যা সাধারণ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশকেন্দ্রের হিসেবে, গত বছরের নভেম্বর পর্যন্ত গুলি করে হত্যা করা হয়েছে ১২ বাংলাদেশিকে, আহত হয়েছেন আরও অনেকে। এ সময় আট বাংলাদেশিকে অপহরণ করা হয়। একই সাথে নিপীড়ন, লাঞ্ছনা ও নির্যাতনের ঘটনা সব সময় বহাল ছিলো।
মানবাধিকার সংগঠনগুলোর বরাতে ডয়েচে ভেলের এক খবরে জানা যাচ্ছে, ২০২২ সাল পর্যন্ত ছয় বছরে সীমান্তে বিএসএফ ১৬৪ বাংলাদেশিকে হত্যা করে। একই সময় তাদের হামলায় ১৪০জন আহত হন, ১১৯ জনকে অপহরণ করে নিয়ে যায়। আন্তর্জাতিক ওই নিউজ এজেন্সির হিসাবে, ২০২১ সালে ১৯ জন, ২০২০ সালে ৪৯ জন, ২০১৯ সালে ৪৩ জন, ২০১৮ সালে ১৪ জন ও ২০১৭ সালে ২৪ জনকে হত্যা করা হয়। বন্ধুত্বপ্রতিম দু’টি দেশের মধ্যে ‘সীমান্ত হত্যা’ একটি ধাঁধা। দু’টি দেশ ধারাবাহিকভাবে নিজেদের গভীর সম্পর্ক এগিয়ে নিচ্ছে বলে দাবি করছে। অথচ প্রতিবেশীদের হত্যা করা বন্ধ করতে পারছে না। বিএসএফের পক্ষ থেকে সবসময় একটি কথা বলা হয়, সীমান্তে হত্যার শিকার হচ্ছে অপরাধীরা। সংস্থাটির ভাষায়-চোরাচালন, পাচারসহ নানা অবৈধ কাজের সাথে যারা জড়িত তাদের হত্যা করা হচ্ছে। এ ধরনের অপরাধে ভারতীয় নাগরিকদের সায় না থাকলে চলতে পারে না। অথচ কখনো একই অপরাধে ভারতীয় নাগরিক হত্যা হয়নি।
হত্যা নিয়ে বড় প্রশ্ন হলো- একজন অপরাধীকে সীমান্তরক্ষীরা হত্যা করতে পারে কি-না? প্রাণ হারানো বাংলাদেশিদের লক্ষণ পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায়; তাদের ওপর সরাসরি গুলি করা হচ্ছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মাথাসহ শরীরের নাজুক জায়গায় গুলিবিদ্ধ হয়ে তারা মারা যাচ্ছেন। অপরাধ প্রতিরোধে তাদের বিচারের আওতায় আনার কোনো চেষ্টা এতে পরিলক্ষিত হয় না; বরং মনে হয় টার্গেট করে গুলি করা হচ্ছে। সীমান্ত হত্যার ৯০ শতাংশ গুলিতে হচ্ছে। যেখানে বিএসএফের ও ভারত সরকারের শীর্ষ কর্মকর্তারা প্রতিনিয়ত সীমান্ত হত্যা শূন্যে নামিয়ে আনার অঙ্গীকার করছেন। তাদের কৃত অঙ্গীকার রক্ষায় সততার পরিচয় পাওয়া যায় না।
আরও গুরুতর বিষয় হচ্ছে- মানুষ হত্যাকারীদের বিচারের কোনো উদ্যোগ ভারতে দেখা যায় না। চাঞ্চল্যকর ফেলানি হত্যার বিচার শেষ পর্যন্ত প্রহসনে পর্যবসিত হয়েছে। যারা সরাসরি এ হত্যায় জড়িত ছিলো; সাক্ষ্য প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও তাদের কোনো শাস্তি হয়নি। এখনও নির্বিচারে হত্যার শিকার বাংলাদেশি পরিবারগুলো কোনো প্রতিকার পাচ্ছে না। সীমান্তে মানুষ হত্যাকে অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করতে চাইছে না ভারত। কোনোভাবে এটি সৎ প্রতিবেশী আচরণ নয়। এ ব্যাপারে মানবাধিকার সংস্থা, নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে জোরালো প্রতিবাদ আসা উচিত। ভারতের অভ্যন্তরেও অনুরূপ আওয়াজ উঠতে হবে।