সৌদির অনুদানের কথা বলে বিভিন্ন প্রতিবন্ধী পরিবারের টাকা হাতিয়ে চম্পট
মেহেরপুর ও ঝিনাইদহের পর এবার চুয়াডাঙ্গার গ্রামে গ্রামে প্রতারণার নতুন ফাঁদ
উজ্জ্বল মাসুদ/নজরুল ইসলাম: প্রতিবন্ধীদের আর্থিক অনুদানের নামে চুয়াডাঙ্গায় প্রতারণার ফাঁদ পেতেছে একটি প্রতারক চক্র। সদর উপজেলার তিতুদহ ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রাম থেকে একাধিক পরিবারের কাছ থেকে তারা হাতিয়ে নিয়েছেন নগদ টাকা। গত বৃহস্পতিবার বিকেলে প্রতারণার শিকার হয়েছেন বড়সলুয়া গ্রামের ছাপড়াপাড়ার একটি প্রতিবন্ধী পরিবার। একটু সহায়তার আশায় ধার করে আনা নগদ টাকা হারিয়ে একপ্রকার দিশেহারা হয়ে পড়েছে দিন আনা দিন খাওয়া পরিবারটি। সহায়তা পাওয়ার আশা বাদ দিয়ে ধার শোধ করা নিয়েই দুঃশ্চিন্তায় পড়েছেন প্রতিবন্ধী রামিমের দিনমজুর পিতা নিজাম উদ্দিন।
শুধু চুয়াডাঙ্গায়ই নয়; সম্প্রতি মেহেরপুর ও ঝিনাইদহেও প্রতারণার ফাঁদ পেতে লাখ লাখ হাতিয়ে নিয়েছে চক্রটি। গত অক্টোবর ও নভেম্বর মাসে বিদেশি সংস্থা থেকে প্রতিবন্ধী, বয়স্ক ও বিধবা ভাতার কার্ড করে দেয়ার কথা বলে মেহেরপুরের গাংনীর বিভিন্ন গ্রাম থেকে কয়েক লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়ে সটকে পড়েছে একটি প্রতারক চক্র। মোটা অঙ্কের টাকা পাইয়ে দেয়ার কথা বলে বিভিন্ন জনের কাছ থেকে টাকা নিয়ে ভুক্তভোগীদের হাতে ধরিয়ে দেয়া হয় একটি সবুজ রঙের রশিদ। এছাড়া গত নভেম্বর ও ডিসেম্বর মাসে ঝিনাইদহের ছয় উপজেলার বিভিন্ন গ্রাম থেকে শতাধিক পরিবারের কাছ থেকে হাতিয়ে নেয়া হয়েছে লাখ লাখ টাকা।
চুয়াডাঙ্গা মেহেরপুর ও ঝিনাইদহের প্রতারিত সকল পরিবারেই একটি করে ফরম দিয়ে গেছে প্রতারক চক্রটি। তাতে লেখা আছে, বিদেশি সংস্থা ‘সৌদি আরব সিসিডিবি’ অনুদানের তালিকা। সেখানে সার্বিক সহায়তায় জেস ফাউন্ডেশন, ওয়ার্ল্ডভিশন বাংলাদেশ নামে একটি প্রতিষ্ঠানের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। চুয়াডাঙ্গা মেহেরপুর ও ঝিনাইদহের প্রত্যেকটা ফরমেই প্রতিবন্ধী ব্যক্তির নাম-ঠিকানার হাতের লেখার মিল রয়েছে। একই ব্যক্তির হাতের লেখা বলে ধারণা করা হচ্ছে। সকল ফরমেই এস এম বাবুল নামে আদায়কারীর স্বাক্ষর রয়েছে।
গত বৃহস্পতিবার চুয়াডাঙ্গার বড়সলুয়া গ্রামে প্রতিবন্ধি একটি পরিবারের সাথে ঘটেছে প্রতারণা। এ যেন মরার উপর খাড়ার ঘা। অভাব অনটনের সংসারে প্রতিবন্ধী সন্তানের টাকা পাইয়ে দেয়ার নাম করে ৬ হাজার টাকা হাতিয়ে নিয়ে চম্পট দিয়েছে প্রকারকচক্রের সদস্যরা। কোন কিছু বুঝে ওঠার আগেই ঘটনাস্থল থেকে সটকে পড়ে মোটরসাইকেলে আসা প্রতারকচক্রের দু’সদস্য। ধার করে দেয়া টাকা ফেরত দেয়া নিয়ে দুঃশ্চিন্তায় পড়েছে প্রতারিত পরিবারটি।
চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার তিতুদহ ইউনিয়নের বড়সলুয়া গ্রামের ছাপড়াপাড়ার মৃত চাঁন মিয়ার ছেলে দিনমজুর নিজাম উদ্দিনের ঘরে রয়েছে রামিম (৫) নামের একটি প্রতিবন্ধী সন্তান। গ্রামে ঢুকে পথচারিদের কাছ থেকে তথ্য নিয়ে বৃহস্পতিবার বিকাল ৪টার দিকে মোটরসাইকেলে করে নিজাম উদ্দীনের বাড়িতে প্রবেশ করে প্রতারকচক্রের দু’সদস্য।
নিজাম উদ্দীনর স্ত্রী নাছিমা খাতুন জানান, বাড়ির মধ্যে ঢুকেই মোটরসাইকেল থেকে একজন নেমে আমার স্বামীর নাম ধরে ডাকতে থাকে। ঘর থেকে আমি বাইরে আসতেই একজন একটি হলুদ রঙের কাজ এনে বলেন, আপনার ছেলে প্রতিবন্ধী না? আমরা চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলা থেকে এসেছি। নাম ঠিকানা বলেন। যে কথা সেই কাজ। নাম ঠিকানা লেখা শেষ হতেই প্রস্তাব দেয় আগামী রোববার প্রতিবন্ধী ছেলের জন্য ২৪ হাজার টাকা পাবেন। আর এ টাকা পেতে এখনই ৬ হাজার টাকা দিতে হবে। ঘরে তো টাকা নেই। এমন কথা বলতেই তারা বলে আমরা ধার করা টাকা নেয় না। তিনমাস পরে টাকা পাবেন। ভাবলাম হয় তো সত্যিই হবে। তাই ঘরে টাকা না থাকায় প্রতিবেশীর কাছ থেকে ধার করে এনে দেয়। টাকা হাতে পেতেই ফর্মটি হাতে ধরিয়ে দিয়ে আর কালক্ষেপন না করে দ্রুত মোটরসাইকেলে করে চলে যায় তারা।
তিনি আরও বলেন, যে ফর্মটি লিখছিলেন তার ডান হাত চিকন। দেখে মনে হলো সেও শারিরীক প্রতিবন্ধী। আর একজন মোটরসাইকেলেই বসেই ছিলো। মোটরসাইকেল থেকে নামেনি। মুখে মাস্ক পরা ছিলো। সব মিলিয়ে বাড়িতে ১০ থেকে ১৫ মিনিট অবস্থান ছিলো তাদের। তিনি আরও বলেন, জন্ম থেকেই রামিম প্রতিবন্ধী হয়ে জন্মগ্রহণ করে। সে কথা বলতে, হাটতে বা শুনতে কোনটাই পারে না। ছেলের বাবা পরের জমিতে কামলা খাটে। যেদিন কামলা চলে না, সেদিন পাখিভ্যান চালাই। মাসে ৩০ দিনের মধ্যে ২৯ দিনই ওষুধ খাওয়াতে হয় ছেলেকে। এই আগুন বাজারে সংসার চালানোই যখন দায়, তখন ছেলের চিকিৎসা করানো কতটা কঠিন তা বলে বোঝাতে পারবো না। জমি জায়গা বলতে এই ভিটেটুকুই। আমার ছেলে প্রতিবন্ধী হলেও আজ পর্যন্ত সরকারি কোনো সহায়তা পায়নি।
ঘটনার সময় পাশে দাঁড়িয়ে থাকা রামিমের খালা ছালমা খাতুন বলেন, তারা যখন মোটরসাইকেলে করে বাড়িতে ঢোকে তখন আমি ও আমার বোন একই জায়গায় বসেছিলাম। উপজেলার কথা বলতেই আমি বলি উপজেলাতে আমার আত্মীয় আছে তার নাম হেলাল। তাকে ফোন দেয়। উত্তরে তাদের মধ্যে একজন বলেন, হ্যা আমার নাম বাবু। আমাকে হেলাল ভাই ভালোভাবেই চেনে। পরে বুঝলাম সবটাই ছিলো প্রতারকচক্রের কৌশল। রামিমের মায়ের কাছে দেয়া এ ফোর সাইজের হলুদ রঙের ফর্মে লেখা আছে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক অনুমোদিত। রেজি নং-২০৮৬৫১। বিদেশী সংস্থা সৌদিআরব সিসিডিবি অনুদানের তালিকা। এদিকে অভাব অনটনের সংসারে ধার করে ৬ হাজার টাকা খুয়ে দুঃশ্চিন্তায় পড়েছে পরিবারটি। অপরদিকে সন্তান প্রত্যেক পিতা-মাতার কাছে মহামূল্যবান। সে যেমনই হোক। সকল দুঃখ কষ্টের মধ্যেও সন্তানকে ভালো রাখার প্রাণপন চেষ্টা থাকে পিতা-মাতার। জন্মের পর থেকে নিজাম উদ্দিন ও নাছিমা খাতুন ৫টি বছর সে চেষ্টায় করে যাচ্ছে তাদের সন্তানের জন্য। এতকিছুর মধ্যে ৬ হাজার টাকা খুইয়েছে পরিবারটি। এ যেনো মরার ওপর ঘাড়ার ঘা’র মত।
এ ব্যাপারে তিতুদহ ইউপি চেয়ারম্যান শুকুর আলী বলেন, এমন ঘটনা আমার জানা নেই। আমার কাছে এলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবো। চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসার শামীম ভূইয়া বলেন, বিষয়টি খুবই দুঃখজনক। সরকারি কোন অনুদান পেতে টাকা লাগে না। কেন টাকা দিতে গেলো। এখন যখন জানতে পেরেছি দেখি কিভাবে সহযোগিতা করা যায়।