সামর্থ্যবানদেরকে নিজ নিজ অবস্থান থেকে সহযোগিতা করার আহ্বান
চুয়াডাঙ্গায় সাক্ষাতের আয়োজনে শীতবস্ত্র-ছাত্রবৃত্তি ও হুইল চেয়ার প্রদান অনুষ্ঠিত
শৈত্যপ্রবাহের সঙ্গে যোগ হচ্ছে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি : আরেক দফা শৈত্যপ্রবাহের পূর্বাভাস
স্টাফ রিপোর্টার: শৈত্যপ্রবাহের সঙ্গে এবার যোগ হতে যাচ্ছে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি। আবহাওয়া অধিদপ্তর জানায়, আজ শনিবার খুলনা, রংপুর, রাজশাহী, ময়মনসিংহ ও সিলেট বিভাগের দু-এক জায়গায় হালকা বৃষ্টি হতে পারে। তবে রাজধানী ও দেশের মধ্যাঞ্চলের জেলাগুলোতে বৃষ্টির সম্ভাবনা নেই। কোথাও কোথাও আকাশ সামান্য মেঘলা হতে পারে।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ ওমর ফারুক বলেন, দেশের উপকূলীয় জেলাগুলোর আকাশে মেঘ আবার কোথাও কোথাও গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হতে পারে। মেঘবৃষ্টি চলে যাওয়ার পর সোমবার থেকে তাপমাত্রা কমে সারা দেশে আরেক দফা শৈত্যপ্রবাহ হতে পারে। ওই শৈত্যপ্রবাহ চার থেকে পাঁচ দিন স্থায়ী হতে পারে।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, গতকাল দেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিলো দিনাজপুরে ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। চুয়াডাঙ্গা সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় ৮ দশমিক ৮ ডিগ্রি এবং সর্বোচ্চ ছিলো ২৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ঢাকায় সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিলো ১১ দশমিক ৮ ডিগ্রি এবং সর্বোচ্চ ২৬ দশমিক ৬ ডিগ্রি তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে। দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিলো টেকনাফে ২৯ দশমিক ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এছাড়া যশোর, মৌলভীবাজার, কুষ্টিয়া, ফরিদপুর, মাদারীপুর, কুমিল্লা, মানিকগঞ্জ, ফেনী, বরিশাল ও ভোলা এবং রংপুর ও রাজশাহী বিভাগজুড়ে শৈত্যপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। কাল শনিবার এই জেলাগুলোর কয়েকটি এলাকা থেকে শৈত্যপ্রবাহ সরে যেতে পারে। সেখানে রাত ও দিনের তাপমাত্রা বাড়তে পারে।
এদিকে, টানা চতুর্থ দিনের মতো চুয়াডাঙ্গার ওপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে শৈত্যপ্রবাহ। এতে দুর্ভোগে পড়েছেন জেলার নিম্ন আয়ের লাখো মানুষ। গতকাল শুক্রবার সকাল ৯টায় জেলার সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করেছে ৮ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। বাতাসের আর্দ্রতা ৯১ শতাংশ। এর আগে কাল বৃহস্পতিবার এ জেলায় মরসুমের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছিল ৬ দশমিক ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
বৃহস্পতিবারের তুলনায় গতকাল শুক্রবার তাপমাত্রা ২ দশমিক ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়লেও ঘন কুয়াশা আর আকাশে মেঘ থাকায় এখনো তীব্র শীত অনুভূত হচ্ছে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে উত্তরের হিমালয় থেকে নেমে আসা কনকনে ঠা-া হাওয়া। এতে বিপাকে পড়েছেন দিনমজুর, নৈশপ্রহরীসহ নিম্ন আয়ের লোকজন। বৃহস্পতিবার রাতে শহরের ফেরিঘাট সড়ক এলাকায় কর্মরত নৈশপ্রহরী মো. বড় বুড়োর সঙ্গে কথা হয়। তিনি বলেন, ‘গ্যালো কদিন রাইত ১০টার পর থিকে এই এলাকায় ডিউটি করাই মুশকিল হয়ে পড়চে। বাসাত আর ঘন কুয়োর (বাতাস আর কুয়াশা) ঠেলায় খুপ কষ্ট হচ্চে। ছিঁড়া কাগজ-টাগজ কুড়ি তাতে আগুন ধরি রাইত পার করতি হচ্চে।’
চুয়াডাঙ্গা বড় বাজার মুক্তিযোদ্ধা সুপার মার্কেটের নৈশপ্রহরী আলমাছ হোসেন বলেন, ‘১৫ বচরেরও বেশি সময় ধইরে রাইত পাহারার কাজ করি। আগে অ্যারাম জাড় (শীত) লাইগতো না। কদিন ধরে হাড় কাঁপি দেচ্চে। তারপরও রাইত জাইগে ডিউটি করিত হচ্চে। প্রায়ই শুনি সরকারের পক্ক থেইকে আর বড় বড় লোকেরা গরম কাপুড়, কোম্বল দেচ্চে। আমাগের কতা কারুরই মনে থাকে না।’
শীত উপেক্ষা করেই আজ সকালে ঘর থেকে বেরিয়েছেন ষাটোর্ধ্ব রিকশাচালক হাফিজ উদ্দিন। তবে ছুটির দিনের সকালে তেমন যাত্রী নেই বলে তিনি আক্ষেপ প্রকাশ করেন। কেদারগঞ্জ নতুন বাজার এলাকার এই বাসিন্দা বলেন, ‘অনেক আশা নিয়ে জাড়ের মদ্দিই বাজারে আইচি। বেলা ৯টা পর্যন্ত অ্যাট্টাও প্যাসেন্দার (যাত্রী) পাইনি। গ্যালো কদিন ধইরেই অ্যারাম অবস্তা চলচে।’
আবহাওয়া অধিদপ্তরসূত্রে জানা গেছে, তাপমাত্রা ৬ থেকে ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে থাকলে মাঝারি শৈত্যপ্রবাহ আর ৮ থেকে ১০ ডিগ্রির মধ্যে থাকলে মৃদু শৈত্যপ্রবাহ বলা হয়। চলতি মরসুমে ৫ থেকে ১৩ জানুয়ারি, এই ৯ দিনের মধ্যে ৭ দিনই চুয়াডাঙ্গার ওপর দিয়ে শৈত্যপ্রবাহ বয়ে গেছে। এর মধ্যে দুই দিন মাঝারি ও পাঁচ দিন মৃদু শৈত্যপ্রবাহ ছিল। আজ তাপমাত্রা বাড়লেও এ অঞ্চলে কাল বৃষ্টির সম্ভাবনার কথা জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর।
চুয়াডাঙ্গার হাটকালুগঞ্জে অবস্থিত প্রথম শ্রেণির আবহাওয়া পর্যবেক্ষণাগারের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রকিবুল হাসান মাথাভাঙ্গাকে বলেন, ‘বৃহস্পতিবার রাত থেকে আকাশে মেঘের আনাগোনা শুরু হয়েছে। শনিবার থেকে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে। এছাড়া ১৬ জানুয়ারি থেকে তাপমাত্রা আরও নিচে নামতে পারে।’
অপরদিকে, চুয়াডাঙ্গার ঐতিহ্যবাহী ভিক্টোরিয়া জুবিলি হাইস্কুলের স্কুলের ’৯৬ ব্যাচে এসএসসি উত্তীর্ণদের প্লাটফর্ম ‘সাক্ষাত’-এর আয়োজনে শীতবস্ত্র, ছাত্রবৃত্তি ও হুইল চেয়ার প্রদান করা হয়েছে। গতকাল শুক্রবার বিকেলে ঐতিহ্যবাহী ভিক্টোরিয়া জুবিলি হাইস্কুলের অডিটোরিয়ামে এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন চুয়াডাঙ্গার জেলা প্রশাসক মো. আমিনুল ইসলাম খান। প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি বলেন, আমাকে ক্রেস্ট প্রদান করে সম্মানিত করায় আমি খুশি হয়েছি, তবে আমার জন্য ক্রেস্ট না বানিয়ে সেই টাকায় আরো কয়েকটি কম্বল কিনে বিতরণ করলে বেশি খুশি হতাম! তাতে করে আর্ত মানবতার সেবায় আরেকটু বেশি অবদান রাখা সম্ভব হতো। জেলা প্রশাসকের এমন মন্তব্যে হাস্য-রসাত্মক পরিবেশের সৃষ্টি হলেও উপস্থিত সুধীম-লী তার এই মনোভাবের ভূয়সী প্রশংসা করেন। প্রধান অতিথির মূল বক্তব্যে আমিনুল ইসলাম খান বলেন, চুয়াডাঙ্গা জনপদের আবহাওয়া চরম ভাবাপন্ন (শীতের সময় তীব্র শীত, আবার গরমের সময় প্রচ- গরম অনুভূত হয়) এবং অভাবী মানুষের সংখ্যাও তুলনামূলক বেশি; সেই বিবেচনায় আরো বেশি সহযোগিতা প্রয়োজন। তিনি সামর্থ্যবানদেরকে নিজ নিজ অবস্থান থেকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়ার উদাত্ত আহ্বান জানান। অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন পুলিশ সুপার আবদুল্লাহ আল মামুন, চুয়াডাঙ্গা প্রেসক্লাবের সভাপতি ও দৈনিক মাথাভাঙ্গার সম্পাদক, প্রকাশক কবি সরদার আল আমিন, ঢাকাস্থ অ্যালায়েন্স লেদার গুডস্ এন্ড ফুটওয়্যার লিমিটেডের ব্যাগ সেকশনের জেনারেল ম্যানেজার এসএম জাহিদুর রহমান, ভি.জে. স্কুলের সিনিয়র শিক্ষক মো, হাফিজুর রহমান ও সমাজসেবা অধিদপ্তরের অফিসার মো. ছানোয়ার হোসেন। সভাপতিত্ব করেন সাক্ষাত’র এই আয়োজনের আহ্বায়ক বিশিষ্ট পরিবহন ব্যবসায়ী মুন্সী আলমগীর স্বপন। অনুষ্ঠানে আরো বক্তব্য রাখেন চুয়াডাঙ্গার আঞ্চলিক ইতিহাস গবেষক, লেখক, মুক্ত সাংবাদিক ও ‘বিক্রয়বন্ধু’ খ্যাত রাজিব আহমেদ। পুরো অনুষ্ঠানটি নান্দনিকভাবে উপস্থাপনা করেন ইমন সিদ্দিক ও ডা. নূর আলম আকাশ। অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন অ্যালায়েন্স লেদার গুডস্ এন্ড ফুটওয়্যার লিমিটেডের ফুটওয়্যার সেকশনের সুযোগ্য জেনারেল ম্যানেজার সাহিদ আক্তার, ভবিষ্যত পরিচালক আরিফুর রহমান আবির, হাবিতুল্লাহ বেলালী সবুজ, বিনয় ভূষণ ধর, দীপক কান্তি দে প্রমুখ। পুরো আয়োজনের মিডিয়া পার্টনার দৈনিক মাথাভাঙ্গা পত্রিকা-মূলত তাদের মাধ্যমেই প্রকৃত অসহায় ও শীতার্ত মানুষদেরকে খুঁজে নেয়া হয়। বর্ণাঢ্য এই আয়োজনকে সফল করে তুলতে সাক্ষাত’র বন্ধু নাহিদ হাসান খাঁন নিপু, রেজোয়ান হোসেন রাজু, সাকিউল ইসলাম রাজন, ওয়াসিম, বাবুল আক্তার, জর্জ, মিল্টন, কামাল, ফারুক, কামরুল, পারভেজসহ অনেকে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন।
অ্যালায়েন্স লেদার গুডস্ এন্ড ফুটওয়্যার লিমিটেডের আগেও ভি.জে. স্কুলের মসজিদ নির্মাণে ও দুইজন গুরুতর অসুস্থ (মৃত্যু পথযাত্রী) শিশুর চিকিৎসার পুরো ব্যয়ভার (পনেরো লক্ষ টাকা) বহন করে শিশুদেরকে সুস্থ করে তুলে চুয়াডাঙ্গা জেলাবাসীকে চির কৃতজ্ঞতার বন্ধনে আবদ্ধ করেছে। রাজিব আহমেদ তার বক্তব্যে প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. সেলিমুজ্জামানকে সুগভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেন এবং ঢাকার কৃতীসন্তান হয়েও সুদূর চুয়াডাঙ্গাবাসীর যে কোনো বিপদে-আপদে পাশে থাকার জন্য জেলাবাসীর পক্ষ থেকে আন্তরিক ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন।
অন্যদিকে, চুয়াডাঙ্গার সদর উপজেলার শংকরচন্দ্র ইউনিয়নে শীতার্তদের মাঝে শীতবস্ত্র বিতরণ করা হয়েছে। গতকাল শুকবার সকাল ৯টার সময় শংকরচন্দ্র ইউনিয়নের ৪নং ওয়ার্ডের ক্যাম্প পাড়ায় প্রায় ২০০ জন শীতার্তদের মাঝে শীতবস্ত্র বিতরণ করা হয়। অনুষ্ঠানে বিশিষ্ট ব্যবসায়ী সাখাওয়াত হোসেন আশার সভাপতিত্বে প্রধান অতিথি ছিলেন চুয়াডাঙ্গা জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক যুগ্মসাধারণ সম্পাদক রিয়াজুল ইসলাম জোয়ার্দ্দার টোটন। বিশেষ অতিথি ছিলেন চুয়াডাঙ্গা পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি মো. আলাউদ্দিন হেলা, জেলা শ্রমিক লীগের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. আফজালুল হক বিশ্বাস ও সদর থানা উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও শংকরচন্দ্র ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. আব্দুর রহমান। এছাড়া আরো উপস্থিত ছিলেন শংকরচন্দ্র ইউনিয়ন পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান মো. শওকত আলীসহ স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীবৃন্দ।
ভ্রাম্যমাণ প্রতিনিধি জানিয়েছেন, আলমডাঙ্গার জামজামী ভোদুয়া গ্রামেরে জমিদার হাজি বাখের আলী মিঞার, উত্তরসূরী এমএ মান্নান রতন জমিদারের উদ্যোগে ৩শ শীতার্ত লোকের মাঝে কম্বল বিতরণ অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়েছে। গতকাল বেলা ৩টার সময় আলমডাঙ্গা জামজামী ইউনিয়নের ভোদুয়া গ্রামের আমেরিকা প্রবাসী এমএ মান্নান রতন জমিদার তার নিজ অর্থায়নে উপহার স্বরূপ গরিব দুঃখী, শীতার্ত অসহায় ও সুবিধা বঞ্চিত জনসাধারণের মাঝে আলমডাঙ্গা থানাপাড়ায় তার নিজ বাসভবনে ৩শ পরিবারের মধ্যে শীতবস্ত্র হিসেবে ১টি করে কম্বল বিতরণ করেন। এমএ রতন জমিদারের পক্ষে কম্বল বিতরণ করেন ঐশিকা সংস্থার শাখা হিসাবরক্ষক শাজ্জাত হোসেন, সাঈদ মিয়া, মোবারক হোসেন, সার্জেন্ট, সাংবাদিক মামুন কাইরুন, মির ফাইম ফয়সাল প্রমুখ।